Ads

ভালবাসার নানা প্রকাশ

ডাঃ জোবায়ের আহমেদ

পারস্যের কবি হাফিজ তাঁর প্রিয়ার গালের কালো একটি তিলের জন্য লিখে দিতে চেয়েছিলেন মহা প্রতাপশালী সম্রাট তৈমুর লং এর রাজধানী সমরখন্দ ও বোখারা শহর।
মজুন যখন পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিলো লাইলীর বিরহে, তখন রাস্তায় একদিন দেখা পায় লাইলীর কুকুরের সাথে।
মজনু সেই কুকুর কে জড়িয়ে কুকুরের পায়ে সেদিন চুমু খেয়েছিলো।মজনুর ব্যাখ্যা ছিলো এটা লাইলীর কুকুর।
এর গায়ে লাইলীর স্পর্শ আছে।আমি লাইলীর সেই স্পর্শকেই চুমু খেলাম।

সিন্ধু নদীতে ভেসে মেঘলা মতীর দেশে এসেছিলো যে ইরানী গুলিস্তান, নূর জাহান তার প্রেমে আকূল হয়েছিলো মহামতি আকবর পুত্র জাহাঙ্গীর।

কবি নজরুল লিখলেন
তব প্রেমে উন্মাদ
ভুলিলো সেলিম
সে যে রাজাধিরাজ
চন্দনসম মাখিলো অঙ্গে
কলঙ্গ লোকলাজ।

জীবনানন্দ দাশ কে দু’ দণ্ড শান্তি তো দিয়েছিলেন শুধু নাটোরের বনলতা সেন ই।।

ফজিলাতুন্নেসা কে না পাওয়ার বেদনায় ব্যাথিত সাম্য ও প্রেমের কবি নজরুল যখন উনার বন্ধু কাজী মোতাহের হোসেন কে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, বন্ধু ক’ফোঁটা রক্ত দিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল হয়,তোমাদের বিজ্ঞান বলতে পারে?

তখন বিজ্ঞানও চুপসে যায়।।

একজন নারীর ভালবাসা পাবার এই আকুলতা একজন পুরুষের জন্য চিরন্তন।।
এই ভালবাসা সুন্দর, পবিত্র।।
এই ভালবাসার উপাখ্যানে শিরি ফরহাদ, রাধা কৃষ্ণ, রোমিও জুলিয়েট, লাইলী মজনুর কাহিনী আমাদের জানা।

এক উর্দু কবি একবার লিখেছিলেন,
আজ যদি উনার প্রিয়ার বাবার মৃত্যু হতো
তবে দাফনের উছিলায় সেই বাড়িতে গিয়ে উনি উনার প্রেমিকাকে এক নজর দেখতে পেতেন।

প্রেমিকাকে এক নজর দেখার জন্য প্রেমিকার বাবার মৃত্যু কামনা করতেও কুন্ঠিত হননি সেই কবি।।

সম্ভবত এই জন্যই প্রেমিকার বাবারা প্রেমিকদের দেখলে সতর্ক হয়ে যেতেন যুগে যুগে।।

ভালবাসার অনুভূতি অনন্য।এক একজনের অনুভূতির সাথে অন্যজনের মিল নেই।গভীর রাতে একাকী কারো বিরহে অশ্রুসিক্ত হবার মাঝেও যে কত সুখ, তা শুধু প্রেমের সমজদারই বুঝেন।কত জীবন, কত সংসার উলোটপালোট হয়ে গেলো এই অবিনশ্বর প্রেমের জন্য।।

এগুলো ভালবাসার একটা দিক।
এবার অন্য দিকের গল্প শুনি।

আমার একজন বন্ধু সূদুর প্রবাসে থাকে । দুই বছরে একবার এক মাসের ছুটিতে দেশে আসতে পারে।তার একটা রাজপুত্তুর।
ছেলেটাকে সে দেখে ভিডিও কলে শুধু।খুব ইচ্ছে করে ছেলের ছোট ছোট হাত ধরে পড়ন্ত বিকেলে সবুজ পথ ধরে হেঁটে যেতে।কিন্ত সে পারে না।
দায়িত্ব ও সবাই কে ভালো রাখার জন্য নিজের প্রিয় সন্তান, প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে থাকতে হয় বছরের পর বছর।সবাই কে ভালো রাখার জন্য এই যে স্যাক্রিফাইস এটাই ভালবাসা।।

আমার একজন মায়াবিনী বন্ধু আছে।আমার বন্ধুত্বের জন্য তাকে অনেক নিন্দা ও অপবাদ সইতে হয়েছিলো।
আমাদের সমাজ তার সংকীর্ণ চোখ দিয়ে সব দেখে অভ্যস্ত।এই সমাজ একজন ছেলে ও মেয়ের মাঝে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব কে কালিমা লেপে দিতে অস্থির থাকে।আমার ক্রাইসিস।
লোনের ই এম আই দিতে পারছিনা।সেই বন্ধু তার স্বর্ণগুলো বিক্রি করলো, নিজের সার্টিফিকেট বন্ধক দিয়ে আমাকে টাকা এনে দিলো শুধু বন্ধুর পাশে দাঁড়াতে।বন্ধুর প্রতি বন্ধুর এই অকৃত্রিম মায়াকেই আমি ভালবাসা বলে জানি।।

শীতের সকাল।হাড় কাঁপুনি শীত।কুয়াশায় অন্ধকার চারপাশ।সবাই কম্বলের নীচে ওম খুঁজছেন।
আব্বা আম্মা তখন সিলেটে।আগের রাতে খাবার খেতে গিয়ে গাইগুই করেছি।তাই এই তীব্র শীত উপেক্ষা করে আব্বা গেলেন আমার বাসা থেকে ১৬ কিমি দূরের এক বাজারে।গরুর মাংশ কিনে আনলেন।ছেলের গরুর মাংশ ও চাউলের রুটি প্রিয় খাবার।সন্তান পেট পুরে খেলে মা বাবা সুখী হউন।ছেলের জন্য তীব্র শীতকে উপেক্ষা করতে পারেন বলেই তিনি বাবা।এটাই সন্তানের প্রতি বাবার ভালবাসার একটা অতি সামান্য নমুনা।

আমার একজন রুগী ছিলেন।পরতেঙ্গা বিবি।আমি উনাকে মাই (মা) বলে ডাকতাম।উনাকে কখনোই অন্য ডাক্তার দেখানো যেত না।আমার কাছে আসলেই উনি শান্ত হয়ে যেতেন।মৃত্যুর আগে উনার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেলো।
উনার সন্তানরা উনাকে সিলেটে নিয়ে গেলেন।চিকিৎসক আইসিইউ তে এডমিট করতে বললেন।কিন্ত তাকে রাজি করানো গেলো না।উনার এক কথা।আমার সময় শেষ।আমি আমার ছেলের হাতে মরবো।।তাকে নিয়ে আসা হলো।আমি চিকিৎসা দিলাম।রাতে মেডিসিন দিচ্ছি, আমি তাকিয়ে দেখি উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম

কি দেখো মাই?
উনি বললেন, তোমার সুন্দর মুখ দেখি বাবা।
পৃথিবীতে পরতেঙ্গা বিবির শেষ বাক্য ছিলো আমার উদ্দেশ্য।
“তোমার সুন্দর মুখ দেখি বাবা”
তারপর আর তিনি কথা বলেননি।পরের দিন উনার ইন্তেকাল হলো।আমার ভাবনার রাজ্যে তোলপাড় উঠলো।
একজন রুগী যিনি আমার মা হয়ে উঠেছিলেন,আমি হয়ে গেছিলাম উনার সন্তান তার শেষ বাক্য আমাকে নিয়ে।।এটাই তো ভালবাসা।।এই ভালবাসার মূল্য পৃথিবীর কোন মূদ্রায় পরিশোধ যোগ্য??

আমার মা এক জীবনে কাপড়ের অনেক কষ্ট করেছেন।আমার নিজ চোখে দেখা।মায়ের একটা কাপড় ছিলো।
তাই তিনি দিনে গোসল কর‍তেন না।রাতে গোসল করে সেই কাপড়টা আমাদের টিনশেডের ঘরে লম্বা করে শুকাতে দিতেন।পেটিকোট ও ব্লাউজ পরে শুয়ে থাকতেন।সকালে সেই কাপড় পরে বের হতেন।কিন্ত আমার মা কখনো বাবার প্রতি অনুযোগ করেননি।আমি এখন শত শত কাপড় কিনি মায়ের জন্য।আম্মার কাপড় রাখার জন্য ই আলাদা একটা আলমারী কিনে দিয়েছি অটোবি থেকে ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে।

একবার সিলেট থেকে আম্মার জন্য দুইটা শাড়ি নিলাম আড়ং থেকে।আমি আম্মার জন্য আড়ং থেকেই সব শাড়ি কিনি।
কাপড় দেখে উনি রাগ করলেন।।আমাকে অপচয়কারী বলে তিরস্কার করলেন।।কাপড় খুলেও দেখলেন না।
সেইদিন বিকেলে সবাই ঘুমাচ্ছে বাসায়।
আমি ঘুম থেকে উঠে আম্মার রুমে গিয়ে দেখি আম্মা কাপড় গুলো দেখছেন।।তারপর একটা কাপড় শরীরে জড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছেন।।আর মুখে মিষ্টি স্বর্গীয় হাসির আভা।আমি সেই দৃশ্য দেখে চোখের কোনে অশ্রুজলের উপস্থিতি টের পেয়েছিলাম।
সেদিন ই শপথ করেছিলাম আমি আমৃত্যু মা বাবার জন্য অমিতব্যয়ী অপচয়কারী হয়েই থাকবো।।এটাও তো ভালবাসার একটা প্রকাশ।।

ভালবাসা কে পবিত্র থাকুন।
ভালবাসার অনুভূতি কে পবিত্র রাখুন।
ভালবাসার মানুষের সাথে প্রতারণা করা থেকে বিরত থাকুন।
ভালবাসার মানুষদের ভালবাসায় আগলে রাখুন।
ভালবাসা কে শারীরিক না ভেবে আত্মিক ভাবতে শিখুন।
ভালবাসা কে আত্মিক ভাবতে পারলেই সেই ভালবাসা স্বর্গসুখ হয়ে দেখা দিবে।

লেখকঃ কলামিস্ট ও ডাক্তার 

আরও পড়ুন