Ads

আমাদের আর পশুর মাঝে ব্যবধান শুধু বিবেকবোধের

এইচ বি রিতা

বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা ভিন্ন হলেও আমরা সাধারণ মানুষেরা বিশ্বাস করি যে, আমাদের সৃষ্টিকর্তা রয়েছে। এবং আমাদের ছাড়াও তিনি পৃথিবীতে হাজারো প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। মানুষের মতই তাদের চোখ, হাত-পা, নাক, কান সবই দিয়েছেন। যা দেননি, তা হল- হৃদপিণ্ড আর বিবেক। এখানেই পশু আর মানুষের মাঝে পার্থক্য।বলা হয়, বিবেক আমাদের এমনই এক মূল্যবান সম্পদ যা আমাদের মৌলিক মানবীয় প্রাণশক্তির উৎস।বিবেকবোধ এটি একটি প্রবণতা, দক্ষতা, প্রজ্ঞা যা আমাদের ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ নির্ণয়ে সাহায্য করে। একারণেই হয়তো আমরা যখন নৈতিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে কাজ করি, অসততাকে ধারণ করি, তখন বলা হয় ‘মানুষ পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট’।

এখানে একটা জিনিস আমি মিলাতে পারি না! তা হল, পশুরা শুধুমাত্র ক্ষুধার জ্বালা নিবারণে অন্য পশুকে শিকার করে। অন্যের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ, অহমিকা, লোভ, প্রভাব-প্রতিপত্তি চরিতার্থ করার জন্য পশুরা কখনো অন্য পশুদের আক্রমণ করে না। কিন্তু বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ সেটা অবলীলায় করে থাকেন। তাহলে ‘মানুষ পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট’ বাক্যটা না বলে আমরা কেন বলি না, ‘পশু অনেক ক্ষেত্রে মানুষের চেয়ে উন্নত’?

বিবেকহীন নেতৃত্বে বিচারবহির্ভূত সিদ্ধান্ত ও দায়হীনতার কারণে এন্সিয়েন রাজত্বের উপলব্ধ স্বৈরশাসনের প্রতীক হিসেবে গননা করা হয়, ফরাসী বিপ্লবের সময়ে রাজতন্ত্রের পতনের ঠিক আগে, ফ্রান্সের শেষ রাজা ষোড়শ লুইকে। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে বিপ্লবের স্থানে গিলোটিন দ্বারা শিরচ্ছেদ করা হয় তাকে। শিরচ্ছেদের আগে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবী করে বলেছিলেন,‘ আমি আমার অশ্রুসংবরণ করতে চাই কারণ সকল চোখ আমার ওপরে থাকবে।’
তিনি নির্দোষ ছিলেন নাকি অনুতপ্ত ছিলেন, আমার জানা নেই। তবে বিবেকহীন নেতৃত্ব যে তার মৃত্যুর কারণ, তা সুস্পষ্ট।

এ তো গেল রাষ্ট্রের সাথে বেইমানী করার অভিযোগে ষোড়শ লুইয়ের শিরচ্ছেদের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের স্বৈরশাসনের বিলুপ্তির কথা। এমন বেইমানী আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অহরহ ঘটছে। তাদের বিলুপ্তির জন্য কোন নির্দিষ্ট শাস্তির বিধান কিংবা ব্যবস্থা আমাদের পরিবার, সমাজ কিংবা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়নি।

গেল বছরের কথা। সরলা, আমার প্রতিবেশী দিদি। প্রথম স্বামী চলে যাবার পর বিয়ে করলেন আবারো ৪ বছর পর। সন্তানটিকে বুকে করে কত কষ্ট তার, একা একা। ভাবলেন, এবার বুঝি মাথার উপর ছাদ হল। কিন্তু বিধিবাম। নিজের সবটুকু সপে দিয়ে যে মানুষটার উপর ভরসা করে পথ চলতে দাঁড়ালো, সেই ধরা খেল কিছুদিন পর চোর বলে। সারাটা জীবন সৎ পথে লড়াই করে চলা সরলা একদিন হয়ে গেল চোরের বউ। তারপর এ সংসারটাও গেল। সরলা এখন তাপে অনুতাপে জ্বলে মরে। কে দেখে তারে? কে বুঝে আঁধার ঘরে নিঃস্বঙ্গতা তাকে প্রতি রাতে কেমন করে বুকে লাথি মেরে যায়! এইসব বিবেকবোধ হীন বেইমানদের কোন বিলুপ্তি নেই। বিলুপ্তি কেবল সরলাদের অর্জনের, সততার।

সরলার কথা বাদ দিলাম। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আল্লামা মামুনুল হকের কথাই ধরুণ। তিনি একজন বাংলাদেশি দেওবন্দি ইসলামি পন্ডিত, অধ্যাপক, সমাজ সংস্কারক হিসাবে পরিচিত। নাস্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দিয়ে যিনি বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেছেন, তিনি ইসলামের দোহাই দিয়ে করে গেলেন নানান সমালোচিত কর্মকান্ড। যে স্ত্রী তাকে সালাম দিয়ে ঘুম ভাঙাতেন, আপনি আপনি করে তাঁর সকল নির্দেশ পালন করতেন, নিজের দুটো চোখ ছাড়া আর কিছুই পৃথিবীকে দেখতে দিতেন না, সেই স্ত্রীর সাথেই প্রতারণা করলেন মামুনুল। স্ত্রী জানলও না তার স্বামীর বুকে অন্য এক নারীর স্থান। অথচ সেই প্রতারক স্বামীকে মিডিয়া থেকে বাঁচাতে আবার তাকেই মিথ্যা কথা বলতে বাধ্য করা হল।

পর্দার আড়ালে বন্দি এই নারী বহির্বিশ্বকে দেখেননি। তিনি কি করে স্বামীর বিবেকবোধ হীন কর্মকান্ড নিয়ে সচেতন হবে? তার চিন্তাধারার প্রসার কতটুকুই বা? এখন একাধীক সন্তানের মা সেই নারীকেও সন্তান, সন্মান ও পরকালের চিন্তা করে সবকিছু মেনে নিতে হবে। তিনি এর থেকে বের হতে পারবেন না। তিনি স্বাবলম্বী নন, তিনি ধর্মীয় আদর্শে স্বামীর উপর নির্ভরশীল।

একবার ভেবে দেখুন তো এই নারীটির কথা? কতটা অসহায়ত্ব নিয়ে বুক পুড়ে মরছেন তিনি? এই যন্ত্রণা নিযেই তাকে ‘আল্লাহ্ ভরসা’ বলে প্রতারক ও বিবেকবোধ হীন স্বামীর পাশে শুতে হবে। এই প্রতারণা-বেইমানির বিরুদ্ধে কোন রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় কঠোর আইন নেই, আছে সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ। সেই সুযোগ মামুনুলের স্ত্রী বা সরলাদের মত সবাই পান না।

এই প্রতারণার ফাঁদে পড়েছিল রক্ষিতা পরিচয়ে মুনিয়াও। শেষ পর্যন্ত তাকে নিজের জীবনটাও দিতে হল। এই সব বিবেকহীন পশুদের সংখ্যা সমাজে কম নয়। সমস্যা হল এদের কোন জড়িপ নেই, শাস্তি নেই, এদের প্রতিরোধে কোন আলোচনা হয় না-টক-শো, মানববন্ধন হয় না। জীবিত থাকায় এদের কোন অনুশোচনাবোধ হয় কিনা, জানা নেই।

‌অথচ অপরাধ নয়,বিবেকবোধ এর কারণে এমনই এক সামান্য বিবেকহীন কাজ করে অনুশোচনাবোধে আত্মহত্যা করেছিলেন সাউথ আফ্রিকার পুরস্কারপ্রাপ্ত ফটোজার্নালিস্ট কেভিন কার্টার

১৯৯৩ তে, সুদানের দুর্ভিক্ষের সময় কেভিন কার্টার একটি ছবি তুলেছিলেন। ছবিটিতে একজন কঙ্কালসার ক্ষুধার্ত বাচ্চা মেয়ে,খাবারের খোঁজে একটু দূরে অবস্থিত খাদ্য- গুদামের দিকে যাবার চেষ্টা করছে। ক্ষুধায় মেয়েটির নড়ার জোর নেই বলে মাঝ পথে বসে পড়ে। দূরে দাঁড়িয়ে একটি শকুন অপেক্ষা করছে বাচ্চাটির মৃত্যুর জন্য। বাচ্চাটি মারা গেলেই শকুনটি তাকে দিয়ে নিজের ক্ষুধা মিটাবে ! সেই ছবিটির জন্য কার্টার
‘পুলিৎজার’ পুরষ্কার পান।

কার্টার এর প্রফেশনালিজম এর কারণে তার দায়ীত্বটাই এমন ছিল যে, ছবি তুলে তাকে সেখান থেকে চলে আসতে হবে। তাই, ছবি তুলেই কার্টার সেখান থেকে চলে আসেন। বাচ্চাটির শেষ পরিণতি কি হয়েছিল, তা কার্টার এর আর জানা হয়নি।

ছবিটি তুলার প্রায় ৩ মাস পর, মাত্র ৩০ বছর বয়সে কার্টার সুইসাইড করেন। অনেকের ধারণা, এই ছবিটি তোলার পর পরই তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন। তার সাফল্য, তার বিবেককে শান্ত করতে পারেনি । বাচ্চাটিকে সাহায্য করতে না পারার অনুশোচনায়, কার্টার মানসিক ভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়েন, যার পরিনাম হয় ”মৃত্যু“। মৃত্যুর পর রেখে যাওয়া তাঁর ডায়েরির পাতায়ও এ নিয়ে লিখা ছিল।

একটি নোটে লিখা ছিল……”Dear God, I promise I will never waste my food no matter how bad it can taste and how full i may be. I pray that He will protect this little child, guide and deliver her away from her misery. I pray that we will be more sensative towards the world around us and not be blinded by our own selfish nature and interests. I hope this picture will always serve as a reminder to us that how fortunate we are and that we must never ever take things for granted.”

আরেকটি নোটে লিখা ছিলো……”I am depressed … without phone … money for rent … money for child support … money for debts … money!!! … I am haunted by the vivid memories of killings and corpses and anger and pain … of starving or wounded children, of trigger-happy madmen, often police, of killer executioners … I have gone to join Ken, if I am that lucky”।

কেভিন কার্টার
কেভিন কার্টার

( কেভিন কার্টারের ফটোগ্রাফি নিয়ে সুদানের দুর্ভিক্ষের ভিডিও )

বিবেকবোধ এমন একটি বিষয়, এমন একটি আবেগশীল অনুভুতি, যার ভিতর এটি জাগ্রত থাকে, তার সমস্ত অস্তিত্ব, স্বত্বা ভিন্ন রুপে আমাদের সামনে আসে। কার্টার ছিল তার প্রফেশনালিজম এর হাতে বন্দি। কিন্তু সে প্রায়োশ্চিত্ত করে হয়ে উঠে একজন মানসিক বিকারগ্রস্থ্য মানব। বিবেকের তাড়নায় নিজেই মৃত্যুর পথ বেছে নেন। কার্টারের এই বিষয়টা এতটাই অর্থবহ যে, আমি এটা নিয়ে ২০১৫ তেও অসংখ্যবার লিখেছি।

দাদীমা বেঁচে থাকাকালীন সময়ে প্রায়ই বলতেন, রিতা! ও রিতা। তোর মাথায় এত ঘিলু কই থেকে আসে? এক পকপক করিস। আমি হাসতাম।
তাই দেখে দাদীমা খুব শীতল চোখে তাকাতেন আমার দিকে। তারপর মাথায় হাত রেখে বলতেন, “এতো হাসিস না। তোর এই হাসি দেখলে আমার বুকের ভিতর হাতুরীর শব্দ হয়। কেন হয় জানি না। এমন করে হাসিস না। তোর এই হাসি একদিন পৃথিবীর ঘনত্ব কমাই দিবে।”

লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিক

লেখকের প্রকাশিত লেখা-

শুধু মুনিয়া নয়, আদিকাল থেকেই নারীরা সমাজে ভোগপণ্য

আরও পড়ুন