Ads

সমকালীন আত্মসমালোচনা

।। শামিম হোসাইন ।।

“হঠাৎ ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি
অজান্তেই চমকে ওঠি
জীবন, ফুরালো নাকি!
এমনি করে সবাই যাবে, যেতে হবে…”
পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে বড়ো শত্রু হলো একাকিত্ব। নিঃসঙ্গতার অসহনীয় যন্ত্রণা কাউকে একদণ্ড প্রশান্তি দেয় না। বলছিলাম সদ্য প্রয়াত হতাশাগ্রস্ত সবার কাছে প্রতারিত মহসিন খানের প্রয়ানের কথা। এই বিষয়টা বড্ড স্পর্শকাতর ও হৃদয়বিদারক। তাই লেখার ইচ্ছে ছিলনা। কিন্তু একজন প্রিয়জনের অনুরোধে লিখলাম। এই ঘটনা যদি আজ থেকে চার-পাঁচ মাস আগে ঘটতো। তাহলে আমি ভিন্ন আঙ্গিকে লিখতাম। আত্মহত্যাকারী লোকটার বিরুদ্ধাচারণ করে তার শত ভুল ধরে দোষারোপ করতাম। কিন্তু এখন বিষয়টা আমার কাছে ভিন্ন। আমি বুঝি এখন একাকিত্বের তীব্র যন্ত্রণা কতটা ভয়ংকর হয়। মহাসুখে কেউ আত্মহত্যা করতে যায় না। অবশ্যই আমি এখানে মহাপাপকে সমর্থন করবো না। আবার মোটিভেশনাল ডেফিসিয়েন্সি লোকদের মতো আমি তার সমালোচনা করে এটাও বলবো না যে এটা ভুল ছিল। সে বেঁচে থাকতে পারতো। আমি শুধু কিছু কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো।

 

লোকটা মারা যাবার আগে একাধিকবার বলেছে, ‘প্রতিটি লোক আমার সাথে প্রতারণা করেছে।’ প্রতারণা করেছে। প্রতারক দিয়ে এই সমাজ ভরপুর। গতকাল ভিডিও চিত্রটা দেখে কেমন এক ভয়ংকর অনুভূতি হলো। জীবনে প্রথম কাউকে এভাবে মারা যেতে দেখলাম। ‘ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অবহেলা, মানুষকে অমানুষ করে তুলতে পারে।’ ডিপ্রেশন! এক ভয়ংকর রোগ। হারানো এবং প্রিয় মানুষকে জীবনের মানে হারিয়ে অন্ধের মতো আলোর মশাল জ্বেলে খুঁজতে থাকা সেই প্রিয়জনকে। দিনশেষে সবাই হারিয়ে যায়। হারানোই যে এই সমাজের মানুষের প্রধান কাজ। কেউ সত্যিই ভালো থাকে। আবার কেউ ভালো থাকার অভিনয় করে। তিমির রাত্রি যাপন করে ভাবতে থাকে পুরনো কিছু অদ্ভুত স্মৃতি রোমন্থন। এ যেনো এক যন্ত্রণার কবদ্ধ নিরাশা।

 

‘একদিনের আত্মহত্যা মহাপাপ বলে আমরা অনেকেই তা ধীরে ধীরে করি।’ লাইনটার মধ্যে গভীর এক অনুভূতি কাজ করে। চিরস্থায়ী ঠিকানায় একদিন আমরা যাবো। এটা আমরা জানি। আত্নহত্যা নিশ্চয়ই কোনো সমাধান নয়! বেঁচে থেকে প্রিয়জনদের ভালো দেখাই তো এক কাব্যিক পরমানন্দের মূর্তরূপ। জাহান্নামের ভয়ে, সবাই করে না আত্নহত্যা। কিন্তু অনেকেই কিন্তু বেঁচে থাকে জীবন্ত লাশের মতো। জীবন শেষ হয় না। কিন্তু স্বপ্ন,আবেগ ও অনুভূতি শেষ হয়ে যায়। শেষ হয় মানে শেষ করে দিতে বাধ্য করা হয়।

 

লোকটা একাকিত্বে ছিল। কী নেই? টাকা, বাড়ি, গাড়ি, সন্তান, আত্মীয়পরিজন। সবই ছিল। শুধু ছিলনা ভালোবাসা। মানুষ সব কিছু ছাড়া থাকতে পারে, বাঁচতেও পারে। কিন্তু ভালোবাসা ছাড়া বেঁচে থাকতে চায় না। হাজার কোটি টাকা,, দামি পোশাক প্রসাধনী। কোনো কিছু অতোটা প্রয়োজন পড়ে না। দিনশেষে যখন চামড়ায় ভাজ ধরে, চুলগুলো সাদা হয়ে যায়, চোখ ঝাপসা দেখে। পাশে তখন বর্ধিত সৌন্দর্য ও শারীরিক সৌন্দর্য থাকে না। থাকে অকৃত্রিম ভালোবাসার মানুষটা। দিনশেষে সে হাতদুটো ধরে বলে ভালোবাসি। অফুরন্ত সময় দিয়ে সবসময় আগলে রাখে। সম্পদ কোনো কাজে আসে না। কাজে আসে শুধু বিশ্বাসী একজন পরিশুদ্ধ আত্মার মানুষ। মহসিন সাহেবের আত্মাহুতি দেখে নির্মূলের লাইনটায় মনে পড়ে,
“রমণীর ভালোবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী,নীল হয়ে জমে আছে ঘাসে,–এর ঠিক ডানপাশে, অইখানে হাত দাও, হ্যাঁ, ওটা বুক, অইখানে হাত রাখো, ওটাই হৃদয়। অইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্পনি ; অই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল তুমিই থাকো নি।”

 

মহসিন খানের এটার বড্ড অভাব ছিল। সব থেকেও যে নেই। তাই দুনিয়াবী সকলের সাথে রাগ করে চলে গেলো চিরস্থায়ী ঠিকানায়। সম্পদের মধ্যে কোনো সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নেই। সুখ যে কোথায় থাকে। তা মহসিন সাহেব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। ছলচাতুরীর লোকদেখানো ভালোবাসা মানুষকে বানিয়ে ফেলেছে অমানুষ। তাকে আমি কটাক্ষ করবোনা। তিনি একবুক যন্ত্রণা নিয়ে চলে গেছেন। তার যন্ত্রণা তিনিই বোঝেন। কেউ আবার এটাতে অনুপ্রাণিত হবেন না। নিশ্চয়ই আত্নহত্যা মহাপাপ।মহাগ্রন্থ কোরআনের সূরা নিসার (৪-২৯) আয়াতে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে,
“তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অত্যন্ত দয়াশীল।”

 

আত্মহত্যা মহাপাপ। এরপরেও মানুষ আত্মহত্যা করে। নিঃসন্দেহে সেটি করে যখন তার সামনে কোনো উপায়ান্তর না থাকে। এরপরেও কোনো মুমিন আত্মহত্যা করতে পারে না। কেননা এটা করলে সে ইহকাল ও পরকাল দুটিই হারাবে। তাকে এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, উপায়-উপাদানের মালিক আল্লাহ। নিরুপায় মানুষ আল্লাহর উপর একান্ত ভরসা করে বৈধ পন্থায় চেষ্টা করে গেলে আল্লাহ অবশ্যই তার জন্য উত্তম পথ বের করে দিবেন।

 

‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট’ প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী দেশে গত চার বছরে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছে। যাদের বয়স ২১-৩০ মধ্যে। যারা অল্পে তুষ্ট হতে পারে না। বরং সর্বদা অধিক পাওয়ার আকাংখায় পাগলপারা হয়। তারা তা না পেয়ে আত্মহত্যা করে। আল্লাহ বলেন, তোমাদেরকে আমার স্মরণ থেকে উদাসীন করে তোমাদের অধিক পাওয়ার আকাংখা’। ‘অবশেষে তোমরা কবরস্থানে উপনীত হও’ (তাকাছুর: ১০২-২)।

 

মনের যখমের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে জনৈক ব্যক্তি আত্মহত্যা করলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘বান্দা আমার আগেই নিজের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করেছে। অতএব তার উপরে আমি জান্নাতকে হারাম করে দিলাম’ (বুখারী)। এমনকি জিহাদের ময়দানে আত্মঘাতি বীর মুজাহিদকেও রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহান্নামী বলেছেন (বুখারী হা/৪২০৩)।
তাই কারো কাছে প্রতারিত হয়ে, আবেগতাড়িতভাবে আত্মহত্যা কেন, হাত কাটা, নিজের শরীরে আঘাত করাও কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের কাজ হতে পারে না। ভালোবাসি এটা প্রমাণ করতে হাত কাটা বা বিষ- ফাঁস খাওয়া নয়, আত্মার প্রতিধ্বনিই অপর মানুষটাকে বুঝিয়ে দেয় যে তার জন্য ভালোবাসা কতটুকু হৃদয় গহ্বরে আছে। আত্মহত্যা আর এসব কাটাছেঁড়াকে আর যায় বলা যাক, ভালোবাসা বলা যায় না। ভালোবাসা হলো হৃদয় গহ্বরের গগনবিদারী ডাক। যা শোনার ক্ষমতা সবার থাকে না। এসব ন্যাকামি মার্কা কর্ম কখনো ভালোবাসা প্রকাশ করে না। সেই যাইহোক মহসিন খানের জন্য দোয়া করতে পারছি না। পাশাপাশি তার সাথে প্রতারণা করা সকলের জন্য লানত কামনা করি। এসব স্বার্থান্বেষীদের জন্যই মানুষটা চলে গেলো। সারাটা জীবন যাদের জন্য করে গেলো। তারাই তার সাথে নিকৃষ্ট প্রাণীর মতো ব্যবহার করলো। অদ্ভুত এই জাতি। আসুন আমরা আত্নহত্যা নামক মহাপাপ থেকে বিরত থাকি। একা হয়ে গেলে ইবাদত করুন। বেশি বেশি বই পড়ুন। বই আত্মার খোরাক। বই আপনাকে সব ভুলিয়ে দিবে। আবার শান্তিও দিবে। আর অর্থ সম্পদের পিছনে দৌঁড়ানো বাদ দিয়ে, আসুন পরিশুদ্ধ আত্নার ভালোবাসা ভালোবাসার পিছনে দৌড়াই। তাহলে দিনশেষে এসে এভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে। ভালোবাসার অভাব অনুভব করে জীবন্ত লাশের মতো থাকতে হবে না। আর্থিকসম্পদ ও চাকচিক্য নয়, দিনশেষে ভালোবাসায় মহা মূল্যবান সম্পদ। ‘রাব্বে তায়া’লা’ আমাদের সকলকে সহীহ্ বুঝ দান করুক (আমীন)।

 

লেখকঃ কলাম লেখক 

 

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ, পরিবার ও নিজেকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য নানা ধরণের

আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিন  এবং

আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন