নোমান মাহফুজ
জালালুদ্দিন রুমী বলেছেন, “তুমি যত বেশি নিশ্চুপ থাকবে, তত বেশি শুনতে পাবে।” হাদীসেও এসেছে ‘যে চুপ থাকে সে নাজাত পায়’। কিন্তু নিশ্চুপ থাকার চেয়ে আমরা বলি বেশি। আর মনে করি কেউ শুনবে না। তবে প্রবাদ বাক্য রয়েছে, দেয়ালেরও কান আছে! এবং তা সত্য। অন্যের অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে বলাটা গীবত। তা জানি। মানি কয়জন? অন্যের বিরুদ্ধে সত্য বা মিথ্যা যেটাই বলো। সেটা আপনার পাশের দেয়ালটা শুনতেছে। আর সেই দেয়ালের পরিচালক কিন্তু মহান রাব্বুল আলামীন। আপনি অপরাধ করবেন। আর তিনি ছাড় দিবেন? না কখনো নয়।
দেয়ালের কান আছে বলতে মনে করেন। একটি বল যখন আপনি দেয়ালে ছুড়বেন সেটা ঠিক আপনার দিকে ফিরে আসবে। ঠিক তেমনি আপনি যখন কারো অগোচরে তার বিরুদ্ধে কিছু বলবেন তখন সে কথাগুলো দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে একসময় সে ব্যক্তির কাছে ফিরে যাবে। তখন আপনি কি করবেন? তাই কারো অগোচরে কিছু বলতে হলে মনে রাখবেন দেয়ালেরও কান আছে।
দেয়ালেরও কান আছে, এ বাক্যটি আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। দেয়ালের কান থাকবার কথা নয়, দেয়াল নিথর এক জড় পদার্থ। কিন্তু দেয়ালের শুধু কানই নয় তার চোখ, মুখ, অবয়ব আছে। তার ভাষা আছে। দেয়াল তার জলদবল পাথর ভেঙে জল, কাদা, শেউলিতে অথবা রঙের ওপর রঙ চড়িয়ে এক সর্বগ্রাহ্য কথা কয়ে যায় নিয়ত। দেয়াল কষ্টে, বিষণ্নতায়, আনন্দ-বেদনায় প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে।
কিন্তু সে ভাষা ক’জন বোঝে! প্রতিদিনের ঘামঝরা মুখোশবদন নাভিশ্বাস তুলতে তুলতে কেবলই দৌড়ায় মানুষ। দেখবার চোখ কই? ক’জনেরই বা সে ত্রি-নয়ন আছে! আমরা প্রতিদিন চলতে-ফিরতে কত কিছুই তো দেখি! শুনি! দেখা হয় না! শোনা হয় না! বোঝা হয় না! সময় কই আমাদের! সময়ের সঙ্গে দৌড়ে দৌড়ে এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরি। বিছানায় এলিয়ে পড়ি। ভাববার ও ভাবানোর সময় কই? আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক গৎবাঁধা রুটিনে চলে জীবন। আসলে চলে কি জীবন! মুখোশে মুখোশে ভরে গেছে টেবিল-চেয়ার! টেবিলের ফাঁক গলিয়ে চলে দু’হাতের কারবার! ফাইল মুক্তি পায়। শুধু মুক্ত হয় না জীবন, মুক্তির গানে গানে। আমাদের চলাফেরায় মুখ-চোখে কেবলই ঠাসা মুখোশ। আসল মুখ ঢাকা পড়ে মিথ্যার ঘোরজালে। কিন্তু মানুষের ভাবনার বাইরে দেয়াল তার নিজস্ব ভাষা বলে যায় সময়ের বাঁকে বাঁকে।
দেয়াল কখনও কান্না হয়ে ঝরে, কখনও আনন্দে আত্মহারা, কখনও দেয়ালের ফাটল আমাদের ভেতরকার ফাটলকেই যেন বা ইঙ্গিত করে, কখনও সম্পর্কভাগের কথা আমাদের জানান দেয়। কখনও বা দেয়াল সব প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে ‘না’ উচ্চারণ করে। দেয়াল কথা কয়, হাসে-কাঁদে। ধ্যানমগ্নতায় খুঁজে ফিরলে দেয়ালগুলো মনে হয় তাদের চষা জমি। স্বাভাবিক চোখে দেয়ালের দিকে তাকালে ভেসে ওঠে ছবির পর ছবি। নোনাধরা দেয়াল, ফাটল অথবা শেউলি ধরা দেয়াল হয়ে ওঠে চোখের নিমিষেই এক একটি পূর্ণ ছবি। যেন দেয়াল কথা বলে আলো-আন্ধারিতে। সব অন্ধকার বা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।
কাউকে সতর্ক করার জন্য আমরা বলি, ‘দেয়ালেরও কান আছে’। এটা না বলে যদি বলি, ‘ফিরিশতাদেরও কলম আছে! তাহলে আল্লাহভীরু একটি প্রজন্ম গড়ে উঠবে। মানুষকে নয়, আল্লাহকে ভয় করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। আর যখন একজন মানুষের ভিতরে ভয় হবে যে, দেয়ালের কানের চেয়ে কাঁধের দুটি কান (দু’জন ফেরেশতা) আছে তখন সে কোন অপরাধ করতে পারবে না। কারো বিরুদ্ধে কথা বলবে না।
তাই বলি আজ আপনি “কাননের” বিরুদ্ধে “হাসানের” কান ভারী করছেন। কাল “হাসানের” বিরুদ্ধে “কাননের”কান ভারী করছেন। পরশু যখন “কানন” আর “হাসানের” মিলন হবে তখন আপনি কানন আর হাসানের নিকট চিরদিন বেঈমান হিসেবে থাকবেন।
লেখকঃ কবি ও সাহিত্যিক