মোসাঃ নাছরিন সুলতান
শবে কদর নিয়ে অনেকের অনেক রকম ব্যাখ্যা থাকতেই পারে এটা যার যার ব্যাপার । তবে আমি বিশ্বাস করি আল্লাহর কাছে যদি কেউ মন থেকে কিছু চায় আল্লাহ তাকে ফিরিয়ে দেয় না! আমার দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয় রমজানের ১৬ তারিখ! তাই স্বাভাবিক ভাবে রোজা বা নামাজ কোনটাই পড়তে পারতাম না আমি! আম্মা ছিল আমার বাসায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় ইফতারের পর আম্মা এসে আমার ছেলের সাথে শুয়ে শুয়ে হাজার গল্প করত আর দোয়া করতেন! নিজের কষ্টের গল্প সন্তানের নিয়ে আনন্দের গল্প যেদিন যেটা মনে আসত সেই দিন সেই গল্পই বলতেন ! আমি শুনতাম কারণ আমার বাবা মারা যাবার আগেও সবাইকে আব্বা এমন গল্প বলতে চাইত আমার ভাইবোনের সাথে সবাই ব্যাস্ত থাকার কারণে অনেক সময়ই শুনতে চাইতো না! পরে আব্বা এসে আমাকে বলতো তোর তো কোন কাজ নেই তুই শুনে রাখ দেখবি কখনো হয়ত কাজে লাগবে! আমি অবাক হয়ে যেতাম আব্বা কেন এমন কথা বলে???? বিভিন্ন নবী রাসুলের জীবনী, সমাজের বিভিন্ন সমস্যার গল্প কোন দিনে কি করলে আল্লাহ খুশি হন ইত্যাদি গল্প বলতেন, আমি বলতাম চলেন শুয়ে শুয়ে শুনি আমি আব্বার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতাম সকালে আব্বা দুঃখ করে বলত পুরো গল্পটা না শুনে তো ঘুমিয়ে গেলি!!! বলতাম আজ আবার শুনবো! সত্যি সত্যি বাবা একদিন রাতে আমাদের সাথে খেয়ে ঘুমাতে যেয়ে স্ট্রোক করে এবং শেষে পর্যন্ত মারা যায়! আমার আজও যেটা মেনে নিতে কষ্ট হয় একজন সুস্থ মানুষ এভাবে মারা যেতে যারে????!
যাই হোক সেজন্য আম্মা যখন গল্প বলে আমি আর না করি না সব গল্প শুনি! সেই রমজানে শবে কদর রাতে মা আমার সাথে কি যেন একটা বিষয়ে কথা বলতে বলতে অনেক কান্না করছিল! আমি হঠাৎ বলে ফেললাম মাগো আপনার তো মেয়ে আছে সব কষ্টের কথা বলে অন্তত কান্না করতে পারেন আমার তো দুই ছেলে আমি তো সেটাও পারবো না!!! ছেলেরা তো মাদের কষ্টের গল্প শুনতে চায় না বা মারাও সহজে বলতে পারে না!
আমার মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে আজ এই শবে কদর রাতে আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে দোয়া করি আল্লাহ যেন তোকে একটা মেয়ে সন্তান দেয়!!! আমি বললাম মা এটা কি বললেন আর দরকার নেই দোয়া করেন এরা যেন সুস্থ থাকে! কিন্তু এরপর বাস্তবতা হলো এই, আমার একমাস, দুমাস করে প্রায় ছয় মাস কেটে গেল কিন্তু মিন্স হচ্ছে না ডাক্তার এর কাছে গেছি বলল এটা ব্যাপার না অনেকের দুই বছরেও হয় না! এদিকে আমার পেট বড় হচ্ছে আমার বর ব্যাল্ট এনে দিয়েছে! আমার এক বান্ধবী ডাক্তার সে বলল অনেকে দিন কিরমির ঔষধ খাস না খেয়ে দেখ পেট কমে যাবে! আমারও তাই মনে হলো তাই খেলাম কিরমির ঔষধ! কিন্তু কোন লাভ হল না দেখতে দেখতে ছয় মাস শেষ হয়ে গেল এবং আমি অফিসে জয়েন্ট করে ফেললাম! অফিস বাসা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে গেলাম, অফিসে একদিন এক ম্যাডাম বলল ম্যাডাম আপনার পেট তো কমেনি আনারস খান চর্বি থাকলে চলে যাবে আমি আনারস খেলাম প্রায় ১৫ দিন টানা! কিন্তু তাতেও কোন লাভ হল না, এর মধ্যে ওয়ান টাইম টেস্টর দিয়ে টেস্ট করলাম নেগেটিভ এসেছে তাই মনে হলো এটা আমার মনের ভুল! একদিন নায়েমে একটা প্রোগ্রাম ছিল শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় আসবেন আমাদের থাকতে হবে এদিকে আমার এমন জায়গায় একটা ফোরা উঠেছে যে বসতেই পারছিনা রাতে ডাক্তারকে বলার পর ডাক্তার আমাকে ডাবল ডোজের এন্টিবায়েটিক দিয়েছে ব্যাথা কমানোর জন্য! আমি খেয়ে পরদিন গেলাম প্রোগ্রামে কিন্তু আমার শুধু মাথা ঘুরছে আর কেমন একটা স্মেল পাচ্ছি যা আর কেউ পাচ্ছে না! পরে ঐখান থেকেই সেন্ট্রাল হসপিটালে যাই ডাক্তার তখনও বলে তুমি তো ডাবল ডোজের ঐষধ খেয়েছে তাই হয়ত খারাপ লাগছে! তবুও বললাম আমাকে একটা আল্ট্রাসোনোগ্রাম করিয়ে দিন! পরে যখন টেস্ট করতে গেলাম ডাক্তার একবার আমার দিকে আরেক বার স্ক্রিন এর দিকে তাকাচ্ছে কারণ ওনি আমাকে চিনেন এবং জানেন কিছু দিন আগে আমার একটা বেবি হয়েছে আবার এটা কি করে সম্ভব???? জিজ্ঞাসা করলেন মিন্স কবে হয়েছে আমি বললাম আমার ঐ বেবির বয়স আট মাস মিন্স হয়নি এখনও! ওনার মুখের ভাব দেখেই বুঝতে পেরেছি কিছু একটা গন্ডগোল তো আছেই!!! তিনি আর কিছু না বলে শুধু বললেন তুমি তোমার ডাক্তার এর রুমে যাও আমি রিপোর্টা পাঠিয়ে দিচ্ছি! আমি ডাক্তার এর রুমে গিয়ে সেকি কান্না! কোন ভাবেই মানতে পারছি না! ডাক্তার বুঝাতে চেষ্টা করলেন রিপোর্টা আসুক আমি দেখি! শেষ যখন রিপোর্ট এলো ডাক্তার ও চুপ এটা কি করে সম্ভব???? আমি তখন চার মাসের প্রেগন্যান্ট??!!!!! বাচ্চা অনেক বড় হয়ে গেছে এছাড়া মাত্র আট মাস আগে একটা সিজার তাই এবোরসন বা অন্য কিছু চিন্তাও করা যাবে না! এছাড়া আমার এমনিতেই হিমোগ্লোবিন কম তাই এটা করতে গেলে আমাকে আর বাঁচানো যাবে না!
ডাক্তার শুধু এটুকু বললেন আল্লাহ চাইলে মানুষের কিছুই করার থাকে না! আমি জানি না আল্লাহ তোমার কি পরীক্ষা নিচ্ছেন? এমন করে কেউ প্রেগন্যান্ট হতে আমার এই ডাক্তারী জীবনে দেখি নাই । জানি না বাচ্চাটা কেমন আছে??? বাসায় এসে তো খুবই মন খারাপ । বরের সাথে সব ঝাল মিটালাম, মারামারি জগড়া যা করার করলাম! পরিচিত এমন কোন ডাক্তার নেই যার সাথে কথা বলিনি! সবাই একটাই কথা চার মাসের বাচ্চা কিছুই করার নেই!!!! পরে আম্মাকে ফোন দিয়ে দিলাম বকা আপনার জন্যই আজ আমার এ অবস্থা! আম্মাতো শুনে খুব খুশি বলল কিচ্ছু করবি না তুই । আমি বিশ্বাস করি তোর মেয়ে হবে আর আমি সেটা দেখে যেতে চাই! আম্মাসহ সবাই আমাকে অনেক বুঝালেন এবং একসময় আমিও মেনে নেই সত্যিটাকে । আর ভরসা রাখি আল্লাহর উপর, কারণ আল্লাহর ইচ্ছার উপরতো কারও কোন হাত নেই! বাকি সময়টা খুব টেনশনে ছিলাম বাচ্চাটা সুস্থ আছে তো? নামাজ পড়ে পড়ে শুধু দোয়া করতাম আল্লাহ্ বাচ্চাকে সুস্থ সুন্দর ও স্বাভাবিক ভাবে পৃথিবীতে আনিও! এমন কোন টেস্ট নাই যা করিনি কারণ কিরমির ঔষধ, আনারস, এন্টিবায়োটিক এসবই প্রেগন্যান্ট অবস্থা খাওয়া যায় না! আলহামদুলিল্লাহ, তবে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর অসীম দোয়ার বরকতে আমার কন্যার জন্ম হলো!!!!
হে এই সময়টায় অনেকেই আমাকে অনেক কিছু বলেছে শিক্ষিত হয়ে সচেতন ছিলাম না! দুইটা বাচ্চার পর আরেকটা ইত্যাদি ইত্যাদি! আমার খুব কাছের কিছু মানুষ ছাড়া সবাই নেগেটিভ ভাবে নিয়েছে!কথায় বলে না যার ব্যাথা সেই বুঝে ব্যাথা কি জিনিস? শুধু আমি জানি কি কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে আমাকে ! একএতো প্রেগন্যান্ট, অন্য দিকে ছোট্ট দুইটা বাচ্চা । তার উপর অফিসের কাজ! সব মিলিয়ে কি যে অবস্থায় গিয়েছে শুধু উপরওয়ালা জানেন!!!
আজ এ গল্পটা শেয়ার করার একটাই উদ্দেশ্য কাল শবে কদর রাতেই মনে হয়েছে তাই আজ লিখলাম! আমি বিশ্বাস করি আমার মার সেদিনের দোয়াই আল্লাহ কবুল করেছেন তাই এতো কিছুর পরও আল্লাহর রহমতে সুস্থ সুন্দর একটি কন্যা আল্লাহ আমাদের উপহার দিয়েছেন! যদিও এটা শুধু আমার একান্ত নিজের বিশ্বাস বা ধারণা! এর জন্য আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া জানাই প্রতিনিয়ত! তাই বলি কি, রমজান মাস আল্লাহর খুব প্রিয় মাস আর মাত্র এক/ দুই রাত বাকি আছে, আল্লাহ কখন কি ভাবে কার ডাক কবুল করেন সেটাতো বলা যায় না, তাই আসেন আমরা আল্লাহর কাছে সবাই মিলে একবার মন থেকে দোয়া করি এই কঠিন অবস্থা থেকে আল্লাহ যেন আমাদের রক্ষা করে! কারণ আমরা সবাই বুঝে গেছি আল্লাহ্ ছাড়া এ থেকে রক্ষা পাবার আর কোন পথ নেই! এই মৃত্যুর মিছিল থেকে যেন তিনি আমাদের রক্ষা করেন !!!
লেখকঃ সাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং থানা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার