Ads

“অলসতা একটি ব্যাধি”

 

(এক)

‘করোনা’ ভাইরাস আজ গোটা বিশ্বকে থমকে দিয়েছে- একথা ঠিক। কিন্তু…..না, থাক।

“একেতো নাচুনে বুড়ি, তার মধ্যে ঢাকে বারি”।

আমরা বাঙালিরা এমনিতেই কিছুটা অলস প্রকৃতির- তারমধ্যে ‘করোনা’ এসে তা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে ‘অলসতা’ নামক জ্বীন-পরী ভর করেছে অতিমাত্রায়। নইলে পড়তে বললেই বলে,
“দূর, খালি পড়া-পড়া। স্কুল- কলেজ তো বন্ধ। আগে খুলুক, তারপর দেখা যাবে”।
কথাটা বলেই ওরা অলসভংগিতে পাশ ফিরে শোয় আরেকবার।
খোঁজ নিলাম- শুধু আমার বাসাতেই না, প্রায় সব বাসার-ই একই চিত্র। বাচ্চাকাচ্চারা নাকি ভীষণ অলস হয়ে গ্যাছে।

‘অলসতা’ একটি ব্যাধি। জাতীয় ব্যাধি, মরণ ঘাতক।
যার মাঝে এই অলসতার রোগ আছে- তার জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছা খুবই কঠিন।

কথায় আছে-
“সময়ের এক ফোঁড় আর অসময়ের দশ”।
“অলস মস্তিষ্ক শয়িতানের আখড়া”।

সময়ের কাজ যথাসময়ে না করে দেরিতে করা অথবা ‘পরে করবো’ বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার নাম হলো- অলসতা।
অলসতা মানে কর্মবিমুখতা, নিষ্ক্রিয়তা। কাজেকর্মে মন্থর, উদাসীন অথবা উদ্যমহীন ব্যক্তিকে সাধারণত আমরা অলস বলে থাকি। অলসতা নিজের ও সমাজের নিশ্চিত অবক্ষয় ডেকে আনে। অলস ব্যক্তি পরিবার ও সমাজের কাছে বোঝা স্বরূপ।
অলসতা অলওয়েজ উন্নয়নের পথে বাধা। হোক তা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয়।
মাথায় রাখতে হবে যে- আমরা সুস্থ মানুষ প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করা না করার জন্য আল্লাহ্‌ পাকের কাছে আমাদের জবাবদিহিতা আছে।

অলসতা মানুষকে সুন্দর ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বদলে অবমাননাকর জীবনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। অলসতার কারণে সম্পদশালী ও শক্তিশালী ব্যক্তিরাও ক্রমেই নিঃস্ব- দুর্বল হয়ে পড়ে।
অলসদের মেধা বিকারগ্রস্ত হয়।
তাই একজন সুস্থ-সবল ও চিন্তাশীল মানুষের দায়িত্ব হলো, অলসতাকে পরিপূর্ণভাবে ত্যাগ করে- নিজেকে সদা মহৎ- জনকল্যাণমূলক কাজে নিযুক্ত রাখা।

আমার বান্ধবী লোপা।
‘ও’ খুব ভাল ছাত্রী ছিল, সাংঘাতিক ট্যালেন্ট! এক লাইন পড়ে দশ লাইন বলতে পারত। কিন্তু সমস্যা হলো- ‘ও’ একটা আস্ত অলসের ঢেঁকি। সারাবছর গড়িমসি, আলসেমি করে সময় পার করে দিয়ে- পরীক্ষার ঠিক আগের রাতে-কোমর বেঁধে সারারাত জেগে পড়াশুনা করে।
তো একবার এক ফাইনাল পরীক্ষার দিন। লোপা ঘুম ঢুলুঢুলু চোখে পরীক্ষা হলে ঢুকতে ঢুকতে সাত মিনিট লেইট করলো। স্যারের সাথে কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ মাথা ঘুরে সে অজ্ঞান হয়ে পড়লো… শেষতক ওর আম- ছালা সবই গ্যালো-ডাব্বা!!
সুতরাং অলসতা ত্যাগ করে- সময় থাকতেই সাবধান হওয়া উচিত !!

ইসলামেও অলসতার কোনো স্থান নেই।

‘ইসলাম’ কর্মবিমুখ, বৈরাগ্যবাদী কোনো ধর্ম নয়।
রাসুল (সা.) কর্মের দ্বারা রুজি উপার্জনকে ফরজ ইবাদত হিসেবে গণ্য করেছেন। শ্রম বা কর্ম দ্বারা অর্জিত খাদ্যকে তিনি সর্বোৎকৃষ্ট খাদ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

রাসুল (সা.) বলেন,

“তোমাদের কারো পক্ষে এক বোঝা জ্বালানি সংগ্রহ করে পিঠে বহন করে নিয়ে আসা- কারো কাছে কিছু চাওয়ার চেয়ে উত্তম।
অনেক সময় চাইলে সে দিতেও পারে, আবার নাও পারে”।
(বুখারী, হাদিস নং : ২০৭৪)

খুবই কমন একটি হাদিস। মোটামুটি সবারই জানা আছে হয়ত।
এক সাহাবি রাসুল (সা.) এর কাছে আর্থিক সাহায্য চাইলে তিনি তার শেষ সম্বল বাটি ও কম্বল বিক্রি করে তা দিয়ে কুঠার কিনতে বলেন। রাসুল (সা.) নিজ হাতে কুঠারের হাতল লাগিয়ে দেন। সে সাহাবিকে জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে তা বাজারে বিক্রি করার নির্দেশ দেন। এভাবে কর্মমুখী জীবন নির্বাহের ব্যবস্থা করে দেন তিনি।
রাসুল (সা.) বলেন,

“নিজ হাতের শ্রমে উপার্জিত জীবিকার চেয়ে উত্তম আহার কেউ কখনও গ্রহণ করেনি। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন”।
(বুখারী, হাদিস নং : ২০৭২)

‘ইসলাম’ কর্মমুখী জীবন ব্যবস্থাপনাকে বেশি উৎসাহিত করেছে।
প্রাত্যহিক কাজকর্মও ইবাদত এবং অনেক সওয়াবের-পুণ্যের।

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
“অতঃপর নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর ও আল্লাহ্‌কে অধিক স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও”।
(সুরা জুম’আ- ১০)।

তবে একটা কথা–
‘ইসলাম’ শ্রমিকের পারিশ্রমিক তার ঘাম শুকানের আগেই প্রদানের নির্দেশনা দিয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন,
“মহান আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন, কেয়ামতের দিন আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হব।
এক. যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে।
দুই. যে কোনো আজাদ মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল।
তিন. যে কোনো মজুর নিয়োগ করে তার থেকে পুরো কাজ আদায় করে এবং তার পারিশ্রমিক দেয় না।
(বুখারী, হাদিস নং : ২২২৭)।

(দুই)

ইসলাম ‘অলসতা’কে কখনোই সাপোর্ট করেনা। প্রাত্যহিক কাজে অলসতা একধরণের মারাত্মক ব্যাধি। যা আমাদেরকে দুনিয়া এবং আখেরাতের সাফল্য থেকে একদম পিছিয়ে দেয়। আলসেমি আমাদের জীবনে চরম ব্যর্থতা এবং অবনতি ডেকে আনে।
‘অলসতা’ নামক এই রোগ তাড়ানোর প্রধান চিকিৎসা হলো-
★ সর্বপ্রথম মন থেকে এই ধারণা চিরতরে দূর করতে হবে যে, আমার হাতে তো এখনো অনেক সময় আছে, আমি আরও অনেকদিন বাঁচবো। সুতরাং কাজটি ধীরেসুস্থে পরে করলেও চলবে।
না, প্রথমেই আমাদের এই ‘দীর্ঘমেয়াদি আশা’ ত্যাগ করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি আশা মানুষকে ধোঁকায় নিমজ্জিত করে।
★ মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করা এবং মৃত্যুকে অতি নিকটে জেনে- সর্বদা নিজেকে প্রস্তুত রাখা। তাহলে ‘অলসতা’ এবং ‘পাপ’ উভয়ই কমে যাবে।
★ ছোট-বড় কোনো কাজই জমিয়ে না রেখে দ্রুততার সাথে তা সম্পন্ন করে ফেলা।
★ আলসেমির বিরুদ্ধে মনে মনে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া।
★ সর্বদা মনে এই হিম্মত রাখা যে- কাজটি আমাকে যথাসময়েই কমপ্লিট করতে হবে এবং আমি তা পারবোও ইনশাআল্লাহ।

কথায় আছে- “সময় এবং স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না”।
চালাক এবং লাভবান তারাই- যারা আলসেমি বা গড়িমসি না করে সময়ের কাজ সময়েই সমাধা করে ফেলে।

কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে-“তোমরা তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং এমন জান্নাতের দিকে দ্রুত ধাবিত হও, যার প্রশস্ততা হবে আকাশসমূহ ও জমিনসম। তা মুত্তাকিদের জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে”।
(সূরা আলে ইমরান ১৩৩)!

আল্লাহ্‌ পাক আরও ইরশাদ করেছেন-
“আমার বান্দাদের বলে দাও, আমি তো পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আর আমার শাস্তি—সেটাও অতি মর্মন্তুদ!”
(সুরা- হিজর, ৪৯-৫০)

কুরআনের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- ‘হা-মিম। এই কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহর পক্ষ থেকে, যিনি পাপ ক্ষমা করেন, তাওবা কবুল করেন। যিনি শাস্তিদানে কঠোর, শক্তিশালী।’
(সুরা : মুমিন, ১-৩)
এই জন্য ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ আকিদা ও বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় করতে হবে আশা ও ভয়ের সমন্বয়ে।

(তিন)

যা বলছিলাম-
অলসতার অন্যতম কারণ চেতনা ও স্পৃহা না থাকা।
নিজের মধ্যে প্রেরণা, চেতনা ও উদ্দীপনা জাগাতে মনীষীদের জীবনী ও বাণী পড়া খুব জরুরি । এতে অলসতা দূর হবে।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন,

“পূর্বপুরুষদের কাহিনিতে বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষা রয়েছে। এটা (কুরআনের বাণী) মিথ্যা রচনা নয়; বরং তা আগের ধর্মগ্রন্থগুলোর সমর্থক, সব কিছুর বিশদ বিবরণ এবং ঈমানদার সম্প্রদায়ের জন্য পথ নির্দেশ ও রহমত।’
(সুরা : ইউসুফ- ১১১)।

জ্ঞানী-গুণী, কর্ম-তৎপর, উদ্যমী সৎ মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করলে- অলসতা কমবে। তখন নিজের মধ্যে কাজ করার উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হবে।
আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,
“হে ঈমানদাররা, আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো”।
(সুরা : তাওবা- ১১৯)।

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে- আমরা অলসতার ধোঁকায় নিমজ্জিত। দুনিয়াবি এবং পরকালিন সফলতা অর্জন করতে চাইলে আমাদের এই অলসতার বেড়াজাল থেকে দ্রুত বের হয়ে আসতে হবে।

মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদেরকে অলসমুক্ত জীবন দান করুন এবং বেশি বেশি আমলে সলেহ (ভাল কাজ) করার তাওফিক দান করুন, ওয়ামা তাওফিকী ইল্লাহ বিল্লাহ, আমিন।
——-
অধ্যাপিকা মৌলুদা খাতুন মলি,কবি ও সাহিত্যিক।
১৪ জিলক্বদ, ১৪৪২ হিঃ
২৫ জুন, ২০২১ ইং, শুক্রবার।
আরও পড়ুন