Ads

আল কুরআনের ভাষায় সওম ও রমাদন (পর্ব-২)

মুনতাসির মামুন

এখানে আল্লাহ পুরা মানবজাতির জন্য বলেছেন, আগে ১৮৩ নং আয়াতে আল্লাহ ঈমানদারদের বলেছিলেন তাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে। কিন্তু এখানে এসে তিনি বললেন, আল কুরআন আরো বরকতময় একটি জিনিস, এটি পুরা মানবজাতির জন্য পথের দিশা।

এই বিষয়টা বুঝতে আরেকটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন। আগের সব কিতাব এসেছিল একজন নবীর উম্মাতের উপর, নির্দিষ্ট কিছু মানুষের উপর নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু যেহেতু মুহাম্মাদ (স) শেষ নবী তাই তাঁর উপর নাযিল হওয়া কুর আনকে তাঁর পরে আগত সকলের জন্যই প্রযোজ্য হতে হবে। এই সূরার শুরুর দিকে বর্নিত হয়েছে, মুহাম্মাদ (স) এর কাছে আল কুরআন নাযিল হওয়ার আগে বনী ইসরাঈল বংশে অনেক নবী ও ওহী/কিতাব এসেছিল। ইসহাক (আ) এর বংশধরেরাই মূলত বনী ইসরাঈল। এই বংশে অনেক নবী আসলেও বনী ইসমাঈল বা ইসমাঈল (আ) এর বংশে তখনো ১ জনও নবী আসেননি। এর ফলে একসময় বনী ইসরাঈল মনে করতে থাকে যে নবী ও ওহী তাদেরই পাওনা, তাদেরই একান্ত নিজেদের সম্পত্তি। কিন্তু আল কুরআন এসে সে ভুল ভেঙ্গে দেয়। তা মুহাম্মাদ (স) এর উপর অবতীর্ন হয়, যিনি ইসহাক (আ) নন বরং ইসমাঈল (আ) এর বংশধর।

এখানে ‘হুদাল্লী আরব’ বা ‘হুদাল্লী বনী ইসমাঈল’ বলা হয়নি; এখানে ‘হুদাল্লী বনী ইসরাঈল’ বা ‘হুদাল্লী বনী ইবরাহীম’ ও বলা হয়নি। বলা হয়েছে “হুদাল্লীন নাস”। অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতির জন্য। আল কুরআন বনী ইসরাঈল বংশে নাযিল না হয়ে বনী ইসমাঈলের মুহাম্মাদ (স) এর উপর নাযিল হলেও তা শুধু বনী ইসমাঈলের জন্য নয় বরং তা নাযিল হয় সমগ্র মানবজাতির জন্য হেদায়াত হিসাবে।

আল কুরআন নাযিল হয়েছে এই রমাদন মাসে যা সব ধর্মের মানুষের জন্যই পথ প্রদর্শক। এই সময়ে শয়তানও শৃংখলাবদ্ধ থাকে তাই অন্য ধর্মের মানুষেরাও ইসলাম সম্পর্কে কম আক্রমনাত্মক থাকে, তাদের মন নরম থাকে, মনে কম ঘৃনার উদ্রেক হয়। তাই রমাদন মাসই সকল ধর্মের মানুষের প্রতি ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়। মুহাম্মাদ (সঃ) সকল ধর্মের মানুষের জন্যই এসেছেন; সকল ধর্মের মানুষের পথ প্রদর্শক আল কুরআন নিয়ে। তিনি আল কুরআন এর সৌন্দর্য্য দিয়েই তিনি মানুষকে ইসলাম গ্রহন করতে সাহায্য করেছেন। তাই আসুন, মুহাম্মাদ (সঃ) এর উম্মত হিসাবে এবং অন্য মানুষের শুভাকাঙ্খি হিসাবে রমাদন মাসে আমাদের প্রচেষ্টাকে বৃদ্ধি করি, মানুষকে ইসলামের আলো পেতে সহায়তা করি।

এরপর আল কুরআন কে ‘ওয়া বায়্যিনাতিম মিনাল হুদা’ বলা হয়েছে। এর মানেটা আসলে কি? কিতাব/পথ প্রদর্শনের ভিতরেই সুস্পষ্ট নিদর্শন বলতে আসলে কি বুঝায়? এটি আসলে এই আয়াতে হেদায়াতের মধ্যে হয়েছে দ্ব্যর্থহীন শিক্ষা সম্বলিত নিদর্শন (মোজেজা)। এই অংশটুকুর ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

আল্লাহ তা’আলা অনেক নবীকেই মোজেজা (বিস্ময়কর নিদর্শন) দান করেছেন। যেমন মুসা (আ) এর লাঠি সাপে পরিনত হওয়া। ঐসব নবীরা যখন বেঁচে ছিলেন তখন তাদের আশেপাশের মানুষেরা সেই মোজেজা দেখেছে এবং তা দেখে অবাক হয়ে তা মোজেজা হিসাবে মেনে নিয়েছে। কিন্তু নবীরা মারা যাবার পর নবীদের সাথে সাথে মোজেজাও চলে গেছে তাই তখন মানুষেরা তা কাহিনী বা গল্প হিসাবে মেনে নিয়েছে।

অন্যান্য নবীদের মোজেজা আশেপাশের মানুষেরা দেখেছে কিন্তু তারা যখন তা পরের প্রজন্মকে বলেছে এবং অন্যরা শুনেছে কিন্তু তারা তো নিজ চোখে দেখেনি, তখন শ্রোতাদের নিকট তা আর মোজেজা থাকেনি, হয়ে গেছে গল্প। মোজেজা সাধারনত চোখে দেখা যায়, এই দেখা অন্যকে পাস করা যায় না। মানুষের এক জোড়া চোখই থাকে, অন্যদিকে কানে কিতাবের ম্যাসেজ শোনে যা মানুষ আবার অন্যকে শোনাতে পারে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। মোজেজা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দেখানো যায় না কিন্তু কিতাবের ম্যাসেজ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পাস করা যায়। এই জন্য মোজেজা কেউ চাইলে বিশ্বাস করেছে কেউ চাইলে বিশ্বাস করেনি। অর্থাৎ আগের নবীদের মোজেজা ছিলো চোখে দেখার মোজেজা। কিন্তু মুহাম্মাদ (সঃ) এর মোজেজা হলো জীবন্ত মোজেজা, কানে শোনার মোজেজা; যা আজীবন অপরিবর্তিত থাকবে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই মোজেজা দেখছে। এই মোজেজা আল কুরআন যেমন চোখের সামনেই দেখার মোজেজা হিসাবে আছে তেমনি এটি শোনার মোজেজাও বটে কারন মানুষ শোনার পর তা নিজেই দেখে মিলিয়ে নিতে পারছে।

অর্থাৎ অন্যান্য রসূলদের কিতাব বা হেদায়াত এবং মোজেজা আলাদা ছিল। আল্লাহর দেয়া কিতাব (হুদা) পাঠ করতেন ও মানুষদের বলতেন এবং আলাদাভাবে বিস্ময়কর কিছু স্পেশালি দেখাতেন যা ছিল সুস্পষ্ট নিদর্শন (ব্যায়িনাহ)। কিন্তু মুহাম্মাদ (স) এর মোজেজা (ব্যায়িনাহ) তাঁর কিতাব (হুদা) এর মধ্যেই নিহিত। এজন্য বলা হয়েছে বাইয়িনাতিম (মোজেজা) মিনাল হুদা (কিতাব)।

এরপর আল্লাহ কুরআনকে ‘ফুরকন’ বা পার্থক্যকারী হিসাবে বর্ননা করলেন। এটা সহজেই বোঝা যায় যে আল কুরআন সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী। অর্থাৎ আল কুরআন ই হলো রমাদন মাসের মূল বিষয়। রোযা নয়, রোযার কথা এজন্য পরে বলা হয়েছে।

তাকওয়ার ব্যাপারে আগে যে বলা হলো, না খাইয়ে রাখার ফলে দেহকে দূর্বল করে দেয়া হচ্ছে তাঁর বিপরীত প্রতিপক্ষ ছিল হৃদয়। অর্থাৎ দেহ আর হৃদয়ে দ্বন্দ্ব বাধছিল। এই আয়াতে আল্লাহ হৃদয়ের খাবারের ব্যবস্থা করে তাকে দেহের বিপরীতে শক্তিশালী করে দিলেন। রমাদন মাসে আল কুরআন নাযিল করা হয়েছে যা হলো রুহের খাদ্য। এই দেহ পৃথিবীতেই তৈরি তাই পৃথিবীর খাদ্য খেয়েই তা বড় হয়। রুহ আল্লাহ উপর থেকে দান (নাযিল) করেন। আর আল কুরআন ও উপর থেকে নাযিল হয়েছে। তাই পৃথিবীর কিছু এই রুহের চাহিদা মেটাতে পারে না। উপর থেকে আসা রুহের খাদ্য হলো উপর থেকে আসা আল্লাহর বানী (আল কুরআন)। এজন্য রমাদন মাসে দেহকে না খাইয়ে রেখে রুহকে বেশি বেশি খাদ্য (আল কুরআন) যোগান দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহ দেহের উপর রুহের কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠা করার ট্রেনিং দেন।

এরপর আল্লাহ বললেন, যে এই মাসের সাক্ষী হবে সে যেন পুরা মাস রো্যা রাখে। মানুষ সাধারনত মোজেজা, অলৌকিক, বিস্ময়কর বস্তু চোখ দিয়ে দেখে, সাক্ষী হয়, একটু আগে যেমন বলা হলো, মানুষ আগের নবীদের মোজেজাগুলো চোখ দিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতো। মানুষ যখন কোন বিস্ময়কর কিছুর সাক্ষী হয় তখন হতভম্ভ হয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। নিজের তীব্র চাহিদাগুলোও ম্লান হয়ে যায় এবং মশগুল হয়ে দেখতে থাকে। অর্থাৎ আগের নবীদের উম্মাতদের মত তারা নিজ চোখে মোজেজা দেখতে থাকার মত অবস্থায় উপনীত হয়। রমাদন মাসও তেমন হিসাবে আল্লাহ বর্ননা করেছেন!!! এই মাস শুধু পালন করার জন্য না বা অনুভব করার জন্য না বরং এই মাসের বরকত, সৌন্দর্য্য, বিস্ময়ভরে দেখার জন্যও।

ঠিক যেন নামাজের মত। নামাজরত ব্যক্তি নামাজে মশগুল হয়ে অল্প সময়ের জন্য নিজের তীব্র চাহিদাগুলো যেমন পানাহার ও জৈবিক চাহিদা হতে বিরত থাকে; তেমনি রোযাদার ব্যক্তি রোযায় মশগুল হয়ে পুরোটা দিনই পানাহার ও জৈবিক চাহিদা হতে বিরত থাকে! বিস্ময়ে থ হয়ে পুরা মাস আল্লাহর মোজেজা দেখতে থাকে! অর্থাৎ এখানো ‘শাহিদা’ (সাক্ষী হওয়া) শব্দটি ব্যবহার কত সুনিপূনভাবে আল্লাহ করেছেন। সুবহানাল্লহ।

 

(চলবে)

আগের পর্ব-আল কুরআনের ভাষায় সওম ও রমাদন (পর্ব-১)

লেখকঃ বুয়েটের প্রাক্তন ছাত্র, ইঞ্জিনিয়ার, কলাম লেখক ও সমাজকর্মী

আরও পড়ুন