Ads

আল কুরআনের ভাষায় সওম ও রমাদন (তৃতীয় ও শেষ পর্ব)

মুনতাসির মামুন

সূরা জ্বীন থেকে জানা যায়, আল কুরআন নাযিল এমন বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল যে তা জ্বীনরাও বুঝতে পেরেছিল কিছু একটা হতে যাচ্ছে। তারা অবাক হয়েছিল যে, তারা আগে আসমানের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারতো কিন্তু এক সময় সব লকডডাউন হয়ে গিয়েছিল। উল্কা, তারকা নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল তাদের চলাচল নিয়ন্ত্রনের জন্য। এজন্য তারা পৃথিবীতে অবস্থান করতে বাধ্য হয়েছিল। তখন তারা ভাবছিল, সব কিছু বন্ধ শুধু পৃথিবী খোলা, পৃথিবীতে নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক কিছু হতে যাচ্ছে। পরে তারা কুরআন শুনলো। তখন তারা বুঝতে পারলো, ও! এই জন্য সব কিছু লকড হয়ে ছিলো!

কুরআন নাযিলের সময়ে পুরা আসমানে একটি প্রস্তুতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল যেন তাঁর কোন অংশ চুরি করে জ্বীন বা শয়তান নিয়ে নিতে না পারে বা জেনে যেতে না পারে।

উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য রোযার বিধান আল্লাহ দিলেন। আগের উম্মতদের ছিল ‘আইয়ামাম মা’দুদাত’ তথা দশ দিনের কম দিন। এর জায়গায় উম্মাতে মুহাম্মাদীর জন্য এলো শাহরুন অর্থাৎ পূর্ন এক মাস! আল্লাহ এক মাস রোযা ফরয করে দিলেন।

এরপর আল্লাহ বললেন, যারা এই রো্যা রাখা মিস করবে তারা বিকল্প কি করতে পারবে। আগের আয়াত ১৮৪ তে আল্লাহ আগের নবীদের উম্মতদের রোযা ভাঙার ফিদিয়ায় ২ টি অপশন রেখেছিলেন। এরপর ১৮৫ আয়াতে মুহাম্মাদ (স) এর উম্মতদের ফিদিয়ায় ২ টি অপশন এর জায়গায় একটি কমিয়ে মাত্র ১ টিই অপশন রেখেছেন।

তাহলে ব্যাপার দাড়ালঃ আগে ফরয রো্যা ছিল ১০ দিনের কম এখন রো্যা হয়ে গেল ১ মাস মানে রো্যার সংখ্যা বেড়ে গেল। অন্যদিকে আগে ফরয রো্যা রাখতে না পারলে পরে রাখার এবং মিসকিনকে খাওয়ানোর মাধ্যমেও তা আদায়ের অপশন ছিল। অর্থাৎ ২ টা অপশনের জায়গায় এখন শুধু পরে রো্যা রাখার ১ টি অপশনই রইলো। সুতরাং একদিকে রো্যার সংখ্যা বাড়লো অন্যদিকে সময়মত রোযা না পারলে পরে তা পূরন করার অপশন কমলো। তাহলে কি বিষয়টা আগের চেয়ে কঠিন হয়ে গেল না? এর পরের আয়াতেই আল্লাহ বলছেন, আল্লাহ তোমাদের কারনে সহজতা চান, কঠিনতা চান না! এখানে সহজ হলো কই? বরং আরো কঠিনই তো হয়ে গেল! বোঝা যাচ্ছে?

আল্লাহ ১৮৪ আয়াতে পূর্ববর্তিদের ফিদিয়ার ২ টি অপশন দিলেও রো্যা রাখাই যে বেটার সেটা বলেছিলেন। সাথে এও বলেছলেন যদি তোমরা অনুধাবন করার চেষ্টা করো তাহলে সেটা বুঝতে পারবে যে রোযা রাখাই বেশি ভাল। উম্মতে মুহাম্মাদীর চিন্তায় আগের উম্মাতদের চেয়েও বেশি পরিপক্কতা এসেছে। তাছাড়া আগের উম্মতদের দায়িত্ব তেমন বেশি ছিল না কারন তাদের পর আবার নবী এসেছেন। কিন্তু উম্মাতে মুহাম্মাদীর উপর দায়িত্ব বেশি কারন আর নবী আসবেন না। আল্লাহর বানী আমাদেরকেই ছড়াতে হবে। এর জন্য সহায়ক হলো তাকওয়া। আর আর তাকওয়া অর্জনের বড় ট্রেনিং হলো রমাদন মাস। অর্থাৎ আগে মাত্র ৩ থেকে ১০ দিনের ট্রেনিং নিয়েছিল আগের উম্মাত, সেখানে আল্লাহ আমাদেরকে পুরা এক মাসের ট্রেনিং নেয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। এই ট্রেনিং নিয়ে সারা বিশ্বের সকল ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে সকল মানুষের কাছে দাওয়াত পৌছাতে এই ট্রেনিং এর এতটুকু কষ্ট করতেই হবে।

সাধারনত মিলিটারী ট্রেনিং এর মত কঠিন ট্রেনিং এ ঐ ট্রেনিংকালীন সময়টা থাকে খুব কষ্টের। এটা এজন্য কষ্টকর করা হয় যে এটাই সর্বোচ্চ কষ্টের নমুনা হিসাবে থাকে এবং পরে যে কোন কাজই এর চেয়ে সহজ, ডালভাত মনে হয়। আবার ট্রেনিং যত গুরুত্বপূর্ন হয় তাতে উপস্থিতিও তত গুরুত্বপূর্ন হয়। কিছুই মিস করা ঠিক নয় সেখানে। যেমন বার্ষিক পরীক্ষায় সব বিষয়ে পরীক্ষা না দিলে, পাস না করলে সাধারনত পরের ক্লাসে ওঠান না শিক্ষকেরা। আবার ভার্সিটিতে একটি কোর্সে ফেল করলে সেটা আবার দেয়া লাগে। তাই এখানে সব গুলোতে অংশগ্রহন খুবই গুরুত্বপূর্ন, অনুপস্থিতি কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য না। তেমনই আল্লাহ পুরা মাস এর রোযা পূরন করতে বলেছেন এবং কোন ওযরের কারনে রাখতে না পারলে তা গুনে পূরন করার কথা বলেছেন ১৮৫ নং আয়াতে। অর্থাৎ রো্যা পূরন না করলে ট্রেনিং সম্পন্ন হবে না।

ট্রেনিং এর একটি ফলাফল আল্লাহ ঐ আয়াতেই বলেছেনঃ যেন তোমরা তাকবীর দিয়ে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব বর্ননা করতে পার। এটা আমরা আক্ষরিক অর্থেই করি। রো্যা শেষে আমরা ‘আল্লহু আকবার আল্লহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লহু ওয়াল্লহু আকবার আল্লহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’ এই তাকবীর দেই ঈদের সময়ে। সারা রমাদনে আমাদের চাহিদাগুলো ছিল ‘আসগর’ (ছোট) আল্লাহ ছিলেন আকবার (বড়)। এটি বাকি মাসগুলোতেও করতে হবে।

যে সারা মাস নিজের দেহের ও মনের আবেগের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন, নিয়ন্ত্রন করা সবচাইতে কঠিন উপাদানগুলোর নিয়ন্ত্রন নিয়ে তা আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত করতে পারে; আশা করা যায় সে সারা বছরও এমনটি করে তাকওয়া অর্জন করতে পারবে, বাকি ১১ মাস তার জন্য সহজ হবে, এবং এর জন্য সে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ হবে। এজন্য আয়াতের শেষে বলা হয়েছে আশা করা যায়, তারা কৃতজ্ঞ হতে পারে। ইসলামের আলো ঘরে ঘরে পৌছে গেলে, রোযার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হলে সেটা শুধু নিজের জীবনে নয়, পুরা মানবজাতির জন্যই সহজতা নিয়ে আসবে। ব্যাপারটা এভাবে চিন্তা করলে বোঝা যাবে আল্লাহ কীভাবে সহজতা চান, কাঠিন্য চান না।

এভাবে তাকওয়া অর্জিত হলে মানুষ একটি ঢাল পাবে যা রোযার পর শয়তান এর মোকাবেলায় সাহায্যকারী হবে। কঠিন ট্রেনিং এর পর অপেক্ষাকৃত সহজ পরিবেশ, পরিস্থিতি মোকাবেলায় এই তাকওয়া কাজে লাগবে।

আগের আয়াতগুলোতে আল্লাহ বলেছেন আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে (আয়াত ১৮৩), আশা করা যায় তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারবে (আয়াত ১৮৫) অর্থাৎ আল্লাহ পুরাপুরি নিশ্চিত করে দেননি আমরা কি পাব। এর পরের আয়াতে তাই আল্লাহ নিশ্চিতভাবে দিলেন। কি দিলেন? আসুন দেখি।

এতক্ষন আল্লাহ কথা বলে এবার আমাদের বলার সুযোগ দিলেন। ১৮৬ নং আয়াতের ১ম অংশে আল্লাহ বলছেন, “যখন আমার বান্দা তোমাকে আমার সম্পর্কে প্রশ্ন করে; নিশ্চয়ই আমি নিকটেই”। (আল কুরআন; ২:১৮৬)। প্রতিটি শব্দ বিশ্লেষণ করলে এর সৌন্দর্য্য ভালোভাবে বোঝা যায়।

# আল্লাহ এখানে বলেননি যে, ‘যদি’ বরং বলেছেন ‘যখন’। যদি বললে বোঝায় সম্ভাবনা আছে আবার নেই, আর যখন বললে বোঝায় অবশ্যই। অর্থাৎ আল্লাহ চান এবং আশা করেন অবশ্যই আমরা তাঁর সম্পর্কে জানি।
# এখানে বান্দা নিজেকে তুচ্ছ মনে করে হতাশ হয়ে আল্লাহ থেকে দূরে ভেবেছে তাই মুহাম্মাদ (স) কে বা অন্যকে আল্লাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। তবে আল্লাহ অতি নিকটেই যা তিনি পরে বলেছেন।
# তিনি বিশেষত্ব এর ব্যাপার রাখেননি। তিনি বলেননি; মুমিন, নামাজী, হাজী, সত্যবাদী বা অন্যকিছু – শুধু বলেছেন আল্লাহর বান্দা। এখানে নিজেকে সম্পৃক্ত করে তিনি তাঁর ভালোবাসাও প্রকাশ করেছেন
# আল্লাহ এখানে স্পেসিফিক বলেনননি যে বান্দা কোন বিষয়ে জানতে চায়, তিনি এখানে ওপেনভাবে প্রশ্ন করার ও জানার সুযোগ দিয়েছেন।
# বান্দা অন্যকে প্রশ্ন করেছে কিন্তু আল্লাহ অন্যের মাধ্যমে উত্তর না দিয়ে বান্দার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শনস্বরুপ নিজেই সরাসরি উত্তর দিয়েছেন।
# বান্দা নিজেকে আল্লাহ থেকে দূরে ভাবলেও তিনি আসলে অতি নিকটে। সকল চাহিদা, প্রশ্ন তিনি জানেন। তাঁর সাথে যোগাযোগের জন্য সময় ক্ষেপন বা কোন মাধ্যম এর প্রয়োজন পড়ে না।

এরপর আল্লাহ বলছেন যে আমাকে ডাকে তাঁর ডাকে তৎক্ষণাৎ পরিপূর্নভাবে আমি সাড়া দেই। এখানেও আল্লাহ কোন বিশেষ ব্যক্তির কথা বলেননি, যে কিনা নামাজী বা হাজী অথবা মুত্তাকী এমন কিছু নয় শুধুমাত্র যে ডাকে। এই ডাক অনেকবার ও নয় শুধুমাত্র একবার, হতে পারে সে সারা জীবনে আগে কখনো একবারও আল্লহকে ডাকে নি। এবারই ১ম বার। সে এই ডাকটা কখন ডাকে? তার নিজের সিডিউল অনুযায়ী। সাধারনত আমরা উচ্চ পদস্থ ব্যক্তির সিডিউল অনুসারে আমরা নিজেদের সময় চেয়ে নেই। কিন্তু আল্লাহ এখানে কোন সিডিউল দেননি। বান্দার যখন ইচ্ছা তখন সে ডাকতে পারে। আবার একই সময়ে এমন অনেক বান্দা ডাকলেও আল্লাহ এমন নন যে তিনি সময় নেন। আগে একজনের টা শোনেন পরে সিরিয়াল দিতে বলেন, এমন না। তিনি তৎক্ষণাৎ শোনেন এবং সাথে সাথেই সাড়া দেন! প্রতিটি ডাক তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ন, সুবহানাল্লহ। কতবড় নিয়ামত তিনি আমাদের দিয়েছেন।

এতকিছু নেয়ামতের বিপরীতে আল্লাহ আমাদের বলছেন, তোমার উচিৎ আমার ডাকে সাড়া দেয়ার ইচ্ছা ও চেষ্টা করা। এখানে আল্লাহ বলেননি পুরাপুরি সাড়া দাও বরং সাড়া দেবার এই ইচ্ছা ও চেষ্টাটুকুও আল্লাহ কবুল করবেন। আল্লাহ তাৎক্ষনিক সাড়া আসা করেন নাই, পুরাপুরি সাড়াও আশা করেননি শুধুমাত্র চেষ্টাটা আশা করেছেন। আল্লাহ সাড়া দেওয়ার রেজাল্ট আশা করছেন না তিনি শুধু প্রচেষ্টাটুকু আশা করছেন, যা মানুষ করে না, মানুষ চায় রেজাল্ট। রেজাল্ট না পেলে সেই প্রচেষ্টার মূল্য দিতে চায় না মানুষ কিন্তু আল্লাহ এই প্রচেষ্টার মূল্য দিচ্ছেন!

আল্লাহ এই মাসে তাঁর কথা আমাদের কাছে পেশ করেছেন আল কুরআন এর মাধ্যমে (আয়াত ১৮৫)। কিন্তু তিনি শুধু ওয়ান ওয়ে কমিউনিকেশন এ থামে থাকেননি। তিনি আমাদেরও বলার সুযোগ দিয়েছেন, Two Way Communication (দ্বিমুখী যোগাযোগ) এর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আয়াত ১৮৬ থেকে বলা যায় যে, আল কুরআন মানুষকে আল্লাহর দিকে অগ্রসর হতে সাহায্য করে। দোয়া আল্লাহকে মানুষের দিকে অগ্রসর হতে সাহায্য করে।

সুতরাং আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের ডাক, কথা শোনার এবং জবাব দেয়ার নিশ্চয়তা দিলেন। এভাবে আল্লাহর কথা ও আমাদের কথা শেষ হলে তিনি বললেন, আমার উপর বিশ্বাস রাখো এবং এইবার আশা করা যায় তোমরা সত্য, সোজা পথের সন্ধান পাবে।

দিনের রোযাকালীন সময়ে তো পানাহার ও জৈবিক চাহিদা বর্জন করা হয় কিন্তু রোযা শেষ হবার পর রাতে কি হবে? তখন সাহাবীরা এই নিয়ে একটু দ্বিধা দ্বন্দ্বে ছিলেন। কেউ কেউ মনে করছিলেন আগের উম্মতদের বিধানের মত রোযার রাতে স্ত্রীর কাছে যাওয়া যাবে না, আবার পুরা এক মাস এটা করা যাবে না ভেবেও মনের মধ্যে কেমন কেমন যেন করছিল। কেউ আবার নিজেকে ধরে রাখতে নাক পেরে স্ত্রীর কাছেও গিয়েছিলেন, যদিও তারা ভেবেছিলেন এটা নিষিদ্ধ। এরপর আবার অনুতপ্ত হয়েছিলেন। তারা দোটনার মধ্যে ছিলেন, মনে অপরাধবোধ কাজ করছিল।

আবার অন্য আঙ্গিকে বলা যায় যে, কিছু মানুষ ভাবছিল যে এই পবিত্র মাসে স্ত্রীর নিকট যাওয়াটা অপবিত্রতা, খারাপ কাজ। নিজের হালাল জৈবিক চাহিদাকে উপেক্ষা করাটাই ধার্মিকতা কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা সেটা নয়।

১৮৭ নং আয়াতে আল্লাহ বললেন, তিনি রোযার রাতে স্বামী-স্ত্রীর Intimacy (অন্তরঙ্গতা) কে হালাল করে দিয়েছেন। এখানে লাইলাতা বলা হয়েছে, যার মানে রাত, বলা হয়নি লায়ালি মানে রাতসমূহে অর্থাৎ এই বিষয় প্রতি রাতেই প্রযোজ্য। শুধু হালাল করে দিয়েই তিনি থেমে থাকেননি বরং আরো বাড়িয়ে বেশ কিছু বললেন। হালাল রোমান্টিসিজম এর অন্যতম খোলাখুলি শ্রেষ্ঠ বর্ননা সূরা আল বাকারার ১৮৭ নং আয়াতে তিনি দিয়েছেন। আল কুরআনের অন্যান্য স্থানে কাছে আসা, স্পর্শ করা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করলেও এখানে আল্লাহ ব্যবহার করেছেন ‘রফাস’ শব্দটি। এটি রোমান্টিকতার শুরু থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের শেষ সময় পর্যন্ত সকল ধরনের কার্যক্রমকে অন্তর্ভূক্ত করে। এটুকু বলেই আল্লাহ থেমে যাননি তিনি এরপর বলছেন, তারা তোমাদের পোশাক, তোমরা তাদের পোশাক। পরে আবার বলেছেন, তোমরা তাদের সাথে মিলিত হও এবং বৈধ ভালবাসার স্বাদ গ্রহন করো। আল্লাহ এভাবেই বলেছেন। আমাদের জীবনের সবচেয়ে আধ্যাত্মিক সময়েই এই বর্ননা, এভাবে এগিয়ে যেতে বলেছেন তিনি! রমাদনের বর্ননা তিনি এই বিষয়টা বাদ দিয়ে করেননি। তিনি জানেন, এই রিলেশনে যদি কোন কমতি, ঘাটতি থাকে তাহলে তা তার অন্য কর্মকান্ড, দক্ষতা, ধার্মিকতা এক কথায় সব কিছুতেই প্রভাব ফেলবে। নিজে পরিবারে প্রশান্তি না থাকলে এই মানুষ বাইরে, সমাজে প্রশান্তি আনতে পারবে না। তাই আল্লাহ চেয়েছেন তাদের সম্পর্ক যেন সবচাইতে দৃড় হয় এই মাসে। তাইসব ধরনের দূরত্ব ভুলে আল্লাহ তাদের নিজেদের মধ্যে এমনি ভালবাসার সম্পর্ক চান এবং তাদের উভয়ের সাথে আল্লাহর ভালবাসার সম্পর্ক চান এই বিষয়টিকে হালাল করে দেয়ার কারনে। হালাল রোমান্টিকতা ধার্মিকতার সাথে সাংঘর্ষিক নয়।

 

মনে প্রশ্ন আসতে পারে, এই মাস একটি পবিত্র মাস এই মাসে এই বিষয়ের কথা এত খোলাখুলি বলার দরকার ছিল কি?এর দ্বারা বোঝা যায়, দ্বীন বলতে জৈবিক চাহিদাকে অগ্রাহ্য করা বোঝায় না বরং মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিকে সঠিক সময়ে সঠিকভাবে ব্যবহারে নামই হলো দিন। আল্লাহ চান না মানুষকে অত্যন্ত কঠিন অবস্থায় ফেলে দিয়ে তাঁর কাছ থেকে আনুগত্য আদায় করতে বরং তিনি চান মানুষ স্বেচ্ছায় তাঁর নিয়ন্ত্রন আল্লাহর কাছে দিয়ে দিক। ইসলাম কোন সন্ন্যাসবাদ নয় বরং শুদ্ধ পারিবারিক বন্ধনের মাধ্যমে দ্বীনকে পূর্ণতা দেয়ার এক মহান বিধান। আল্লাহ এই মাসে যেমন তাঁর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলেছেন আগের আয়াত ১৮৬ তে তেমনি মানুষের সাথেও সম্পর্ক উন্নয়নের কথা এনেছেন। অর্থাৎ হাক্কুল্লাহ ও হাক্কুল ইবাদ এর বিষয়টি একসাথে পাশাপাশি রেখেছেন।

এরপর আল্লাহ পানাহার এর কথা বলেছেন! আল্লাহ পানাহার এর কথা আগে না বলে আগে স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গতার কথা বলেছেন কারন এটাকে তিনি বেশি গুরুত্বপূর্ন মনে করেছেন। পানাহার কম হলে তেমন সমস্যা হয় না কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ঘাটতি থাকলে অনেক ভয়াবহ সমস্যা দেখা দিতে পারে। পানাহার কম হলে একজন ব্যক্তি অ্যাফেকটেড হতে পারে কিন্তু স্বামী স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ঘাটতি থাকলে তা দুজন, পুরা পরিবার এমনকি এভাবে এর প্রভাব পুরা সমাজেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। সুতরাং এইসব অপেক্ষাকৃত সবচাইতে রোমান্টিক কথা তিনি আল কুরআনের অন্য কোথাও না বলে এই সময়েই বলাকে পারফেক্ট মনে করেছেন কারন ইসলাম বৈরাগ্যবাদে বিশ্বাসী নয়।

আয়াতের মাঝ অংশে আল্লাহ সাহরীর কথা বলেছেন। এবং এর সময় নির্ধারন করে দিয়েছেন। এরপর রোযা রাখার সময়কালও বলে দিয়েছেন।

এর পর বলা হচ্ছে, রমাদনের রাতে স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গতা হালাল করা হলেও আল্লাহর ঘরে তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা এক দিকে মানুষের ঘরের সাথে আল্লাহর ঘরের মর্যাদা ও অন্যান্য সময়ের চেয়ে ইতকাফের মর্যাদা এর পার্থক্যকে বোঝানো হয়েছে।

এগুলো বলার পর আল্লাহ বলছেনঃ আগে যা যা আল্লাহ বলে দিলেন এগুলো হলো আল্লাহর কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব, সীমানা অতিক্রম করা তো দূরের কথা, সীমানার কাছেও যেও না। আশা করা যায় যে তোমরা আল্লাহর ভয়ে আত্মরক্ষা করতে পারবে। এভাবেই আয়াতটি

পরিশিষ্টঃ

আল্লাহর কুরআন এর বিন্যাস, শৈল্পিকতা অনন্য। এর মধ্য থেকে হঠাৎ একটা আয়াত বা বিষয় তুলে নিয়ে আলোচনা করলে পুরাটা আসলে বোঝা যায় না। একটা বিষয় বা আয়াত এর আশেপাশের আয়াতগুলো, সেই আয়াতগুলো কোন সূরায় আছে, সেই সূরার থিমটা কি? সেই সূরার অবস্থান কি এইসব বিষয় জানতে পারলে মোটামুটি ওভারঅল একটা ধারণা পাওয়া যায় তা না হলে খন্ডিত, আংশিক ধারণা থেকে যায়।

এই অংশটুকু সূরা আলা বাকারার মাঝামাঝি থেকে নেয়া হয়েছে। এজন্য এই সূরার মূল থিমটা বোঝা জরুরী। মূল কথা হলো আগের জাতিসমূহের ব্যর্থতার কারনে উম্মাতে মুহাম্মাদীকে নতুন ব্যালান্সড, মধ্যমপন্থি জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেন আল্লাহ।

আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েই পথহারা রাখেননি, যুগে যুগে নবী রাসূল পাঠিয়েছেন। এক এক জন নবীর শিক্ষা যখন খুব বেশি পরিবর্তিত হয়ে গেছে বা আল্লাহ যখন চেয়েছেন তখন নবী পাঠিয়েছেন। নবী ইবরাহীম (আ) আমাদের মুসলিম জাতির পিতা। তাঁর সন্তানদের থেকে দুইটি বংশে নবীরা আসছিলেন। ইসহাক ও ইসমাঈল (আ)। ইসরাঈল ছিলেন ইসহাক (আ) এর ছেলে, তার বংশেই ঈসা (আ) পর্যন্ত নবীরা এসেছেন। তাদের উম্মতেরা বানী ইসরাঈল নামে পরিচিত। তারা ঠিকভাবে পরিচালিত হতে পারে নাই। এরপর আল্লাহ ইচ্ছা করলেন ইসমাঈল (আ) এর বংশে নবী দিবেন। তবে তারা সবাই ছিলেন মুসলিম। কিন্তু একসময় আল্লাহ চাইলেন ইহুদী ও আহলে কিতাবদের থেকে উম্মাতী মুহাম্মাদী অর্থাৎ যারা আসল, বিশুদ্ধ মুসলিম তাদের আলাদা করতে।

এজন্য তিনি প্রথমে কিবলা পরিবর্তন করে দিলেন। মক্কায় থাকা অবস্থায় কাবা ও মসজিদুল আকসা একই দিক বরাবর ছিলো। মুহাম্মাদ (স) মদীনায় গেলে ২ মসজিদ ২ দিকে হয়ে যায়। এরপর আল্লাহ ক্বিবলা পরিবর্তন করে দেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ মদীনায় বাস করা ইহুহী জাতি হতে মুসলিম জাতির স্বাতন্ত্র ভালোভাবে প্রকাশ করে দেন। এ বিষয়টি আছে সূরার মাঝখানে। আয়াত ১৪২-১৫২ এর মধ্যে।

এরপর আল্লাহ কিছু রীতিনীতি পরিবর্তন করে দিলেন। যেটা বলা হয়েছে ১৮৩-১৮৫ আয়াতে। আগে ৩ টা রোযা ছিল এরপর হয়ে গেল ৩০ টা। এই পরিবর্তন টা মূলত এলো আল কুরআন নাযিলের মাধ্যমে (আয়াত ১৮৫)। এরপর আল্লাহ বললেন তাকবীর দিতে ঈদের সময়ে।

বিষয়টা আসলে একটি নতুন জাতির উত্থানের ঘটনা। কাবা পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রথমে এই নতুন জাতির রাজধানী স্থাপন করলেন মক্কার। এরপর সেই নতুন জাতির (আয়াত ১৪৩) কি প্রয়োজন? হা স্বাধীনতা, স্বাধীনতা দিবস ও সংবিধান। দেখুন তো…

আল্লাহ স্বাধীনতার রাত এনে দিলেন লাইলাতুল কদরে, সেটা এত মর্যাদার যে সেটাকে পুরা স্বাধীনতার মাস বলা যায়, রমাদন মাস!!! এই মাস শেষে আবার বিপুল আনন্দের সাথে তা উদযাপনের জন্য উৎসব হিসাবে ঈদুল ফিতর এর বিধান দিয়ে দিলেন। আল্লাহু আকবার।

সূরা আল বাকারার সারমর্ম এর সাথে এই রোযা ও রমাদনের সম্পর্ক বোঝার পর আসুন আমরা বুঝি এই আয়াতগুলোর আগে পরের বিষয় সম্পর্কে। এই ১৮৩ থেকে ১৮৭ আয়াতে মূল বিষয় বলা হলো রোযার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন, রমাদন মাসের মাধ্যমে কুরআন এর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি এর কথা। এই ১৮৩-১৮৭ আয়াতের আগে পরে ধন সম্পদ, অর্থ উপার্জন, ব্যয়, ম্যানেজমেন্ট এর বিষয় বলা হয়েছে। তাকওয়া ও কুরআনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির ১ম ও সরাসরি প্রভাব পড়া উচিৎ আমাদের ধন সম্পদ, অর্থ উপার্জন, ব্যয়, ম্যানেজমেন্ট এ। এছাড়া অন্যান্য মোয়ামেলাত বা পারস্পরিক কর্মকান্ডগুলোতে।

আসুন রমাদন মাসে আমরা আমাদের পরিচিতি ভালভাবে বুঝি, আল্লাহ যা যা পাওয়ার আশা দিয়েছেন (তাকওয়া অর্জন, কৃতজ্ঞ হওয়া, সত্য-সরল পথের সন্ধান পাওয়া) সেগুলো পাবার চেষ্টা করি। মুসলিম জাতি হিসাবে নিজেদের রাজধানী, স্বাধীনতা ও সংবিধান এর প্রচার, প্রসার, প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা রক্ষায় কাজ করে যাই।

আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন। আমীন।

আরো ভালো বুঝতে ভিডিও দেখুন নোমান আলী খানের

Ramadan in Allah’s Words – How to Approach Ramadan – Nouman Ali Khan,

Youtube link:   How to Approach Ramadan

বিঃ দ্রঃ এই নোটটি দরকারী মনে হলে শেয়ার করে নিজের টাইমলাইনে রাখতে পারেন, কপি করে প্রিন্ট করতে পারেন, অন্যকে দিতে পারেন।

এই নোটের পিডিএফ নামাতে চাইলেঃ

আল কুরআনের ভাষায় সওম ও রমাদন সিরিজের সম্পূর্ণ পিডিএফ

লেখকঃ ইঞ্জিনিয়ার, কলাম লেখক এবং সমাজ সেবক

আরও পড়ুন