Ads

কুরআনিক থট প্রসেস: আল কুরআনের চিন্তামানস (২)

জিয়াউল হক

রাজনীতিতে ব্যক্তিগত ও সামষ্ঠিক পর্যায়ের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কোন ধরনের মনস্তাত্তিক আবহকে লালন করতে হবে সেটা কুরআনের চিন্তামানস আমাদের সামনে তুলে ধরে ন্যায়নীতি, সততায় অটল, অবিচল এবং সত্যকে আঁকড়ে থাকার কথা বলে। রাজনীতি বা সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোহাই দিয়ে কোন অন্যায়কে বৈধতা দেওয়ার কোন সুযোগই রাখা হয়নি।

বলাই বাহুল্য, অধূনা বৈশ্বিক রাজনৈতিক আবহে এটাই হলো বহূলচর্চিত পথ, বিশ্বের সামনে সর্বজনগ্রাহ্য নীতিও অনুসৃতব্য পদ্ধতি। একটা দেশ ও সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা কোন একটা বিশেষ কাজ ও পথকে বৈধ মনে করছে বলেই সেটা গ্রহণ করতে হবে, তাকে কোনমতেই এবং কোন যুক্তিতেই অগ্রাহ্য করা যাবে না। ফলে বিশ্ব আজ সমকামীতা, ব্যক্তিগত অধিকারের নামে যথেচ্ছাচারের, বাকস্বাধীনতার নামে যা কিছুু বলার স্বাধীনতা প্রদান করায় বিশ্ব হতে ভব্যতা, শালীনতা শ্লীলতা উধাও হয়ে গেছে।

সময়ের সাথে সাথে গণমানুষের চাওয়া, ইচ্ছা অনিচ্ছার পরিবর্তন উত্থান পতন ঘটে। কোন কুশলী মহলের প্ররোচনায় মন্দ ও অশ্লীল বস্তুর প্রতিও তাদের ঝোঁক বেড়ে যেতে পারে, আবার এর পাশাপাশি মানবতার জন্য শ্বাশত কল্যাণময় কোন পথ ও পদ্ধতিকে তারা ঘৃনা করতেও পারে।

আধুনিক বিশ্বে এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে এবং প্রফেশনাল প্রচারবীদদের সহায়তায় নানা প্রচারযন্ত্র কাজে লাগিয়ে গণমনস্তত/সোশ্যাল সাইকোলোজি (Public perception / Social Psychology) তৈরি হচ্ছে, পরিবর্তনও ঘটানো হচ্ছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকাান জনগণ কোনমতেই জড়াবে না, এমন পরিস্থিতিতে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী’সহ কর্তাব্যক্তিদের পরিকল্পনা, রাষ্ট্রীয় স্বিদ্ধান্ত ও নির্দেশনায় কিছু রাজনীতিবীদ, প্রোপাগান্ডানিষ্ট, পত্রিকার সম্পাদক, লেখক, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক ও বক্তাদের মাত্র বসর দু’য়েকের ক্রমাগত প্রচারনায় মার্কিন জনগণের মানসিকতা, যুদ্ধে জড়ানোর ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভংগী বদলে দেন এবং আমেরিকাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর পক্ষে নামাতে সফল হন।

অথচ মাত্র বসর দুয়েক আগেও মার্কিন জনগণ আটলান্টিকের অপরপাড়ে ‘ইউরোপের যুদ্ধে’ আমেরিকা জড়িয়ে পড়–ক, তা চাচ্ছিল না, অথচ প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন ও তার মন্ত্রীরা আগেই স্বিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন যে তারা ইউরোপের সহায়তায় যুদ্ধে নামবেন। ফলে তারা নিজেদের স্বিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করতে শেষপর্যন্ত পাবলিক পারসেপশন বদলে দিতে মাঠে নামেন এবং অত্যন্ত সফলভাবে তা বাস্তবায়নও করেন।

কৌশলটা সারা বিশ্বজুড়ে নানা মহল প্রয়োগ করে চলেছে সেই থেকে। আর তার শিকার হচ্ছে দেশ, জাতি, সমাজ ও সভ্যতা। অবস্থাটা এমন পর্যায়ে গেছে যে, যে ভ্যটিকান সমলিঙ্গের বিবাহকে কোনদিনই বৈধতা দেয়নি, খৃষ্টবিশ্ব পোপ ও পাদ্রিদের নির্দেশে সমকামীদের মৃত্যুদন্ড দিয়েছে অবলীলায়, সেই ভ্যাটিকানই শেষ পর্যন্ত সমকামীতাকে মেনে নিয়েছে ব্যক্তির অধিকার হিসেবে। এই মেরুকরণ সম্ভবপর হয়েছে কেবলমাত্র একটা কারণে; নীতি নৈতিকতা, ভালো মন্দ ও ন্যায় অন্যায়ের সঙ্গা পরিবর্তনের কারণে।

অথচ এই ইউরোপের, তথা, হেলেনিক রোমান সভ্যতার আধুনিক রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার বুনিয়াদি ভিত্তি গড়ে উঠেছে যে রাষ্ট্রচিন্তক ও বুদ্ধিজীবির দর্শনকে ভিত্তি করে, সেই সিসেরো’র (Cicero, জন্ম: খৃষ্টপূর্ব: ১০৬- মৃত্যু: খৃষ্টপূর্ব ৪৩) বহুলচর্চিত ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক মন্ত্র বিদ্যমান। রাজনীতিবীদ ও রাষ্ট্রনায়কদের জন্য সিসেরো তার এক বক্তব্যে বলেছিলেন;

Just that you do the right thing. The rest doesn’t matter. Cold or warm. Tired or well-rested. Despised or honored. Dying…or busy with other assignments.

সিসেরো এরকম একটা কর্মপন্থা অবলম্বনের উেেদ্দশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে সারাজীবন ‘চুড়ান্ত সত্য’ প্রতিষ্ঠা বা ‘সর্বোচ্চ কল্যাণ’ ল্যাটিন ভাষায় ‘ Summum Bonum ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন, আজও তা পশ্চিমা দর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে আছে। ব্যক্তি, সামষ্টিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সর্বোচ্চ ও চুড়ান্ত কল্যাণ নিশ্চিত করাটাই একমাত্র অর্জনীয় লক্ষ্য।

বক্তব্যটিই শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে ইউরোপসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রচিন্তা ও রাষ্ট্রদর্শনের ভিত্তি রচনা করেছে, যদিও সেই সমাজ এই দর্শনের উপরে অনড়, অটল থাকেনি। তারা এ দর্শন থেকে সরে গিয়ে ইচ্ছামত রাষ্ট্রপরিচালনা করেছেন, নীতি নৈতিকতায় অটল থাকেন নি।
আমরা যদি কুরআনের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই পৃথিবীর বুকে এবং সৃষ্টিজগতের সকল কিছুর মালিক এবং সে সবের উপরে কর্তৃত্ব করার একমাত্র সার্বভৌম শক্তি হলেন আল্লাহ নিজে, আর কেউ নয়। (সুরা মু’মিনুন: ৮৪-৮৮, সুরা আনকাবুত : ৬১-৬৪)।

পুরো সৃষ্টির একচ্ছত্র মালিকানা যেহেতু আল্লাহর, তাই তাদের কল্যাণ অকল্যাণের সঙ্গা নির্ধারণের এখতিয়ারও একমাত্র তাঁরই (সূরা ইউসুফঃ ৪০)। যারা এ বোধকে লালন করে না তাদেরকে তিনি সোজা সাপ্টা জালিম হিসেবে অভিহিত করেছেন (সূরা মায়েদাঃ ৪৫)। মানুষ, সমাজ ও সভ্যতার জন্য কল্যাণ অকল্যাণের ধারনা পরিবর্তনের কোন অধিকার বিশ্বে কারো নেই (আলে ইমরানঃ ১৫৪, আল কুরআন )

এখতিয়ার বিষয়টি ভালো ও মন্দ বা ন্যায় ও অন্যায়, কল্যাণ ও অকল্যাণ নির্ধারণের অধিকার ও জ্ঞানের সাথে জড়িত। নির্ধারিত পথটি প্রয়োগে প্রতিনিধিত্বের বিষয়। সকল কল্যাণ, সকলের কল্যাণ অর্জন ও নিশ্চিত করার পথ ও পদ্ধতি নিশ্চিত করতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সা: যে কর্মপন্থা নির্দিষ্ঠ করেছেন, সেটা নিশ্চিত করাটাই হলো রাজনীতিবীদদের একমাত্র লক্ষ্য। আল্লাহ স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে সেটা বলেছেন (সূরা আল হজ্জঃ ৪১)।

এই দায়িত্বটা যেমন গোষ্ঠী ও সমাজের, তেমনই তা ব্যক্তিগত পর্যায়ে একক পরিমন্ডলেও। প্রত্যেকের জন্য, প্রতিটি পর্যায়ের জন্য। এটই হলো, পন্ডিত ও রাষ্ট্রচিন্তক সিসেরো (Cicero) যে ধরনের সর্বোচ্চ কল্যাণ (Summum Bonum) এর কথা বলেছেন, কিন্তু অর্জন করতে বা করাতে পারেননি, কুরআন সেটাকেই সর্বোচ্চ কল্যাণ; ফাউজান আজিমা (সুরা নিসা:১৩,আল কুরআন)। ব্যক্তি, গোষ্ঠী. সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অর্জনীয় লক্ষ্য এটাই। এটাই কুরআনের চিন্তামানস (Quranic Thought Process).

(চলবে)

আগের পর্ব-কুরআনিক থট প্রসেস, আল কুরআনের চিন্তামানস ( পর্ব-১)

লেখকঃ ইংল‍্যান্ডের বেসরকারী মানসিক হাসপাতালের সাবেক উপ-পরিচালক ও লেখক, ইংল‍্যান্ড

আরও পড়ুন