Ads

ভ্রমণ কাহিনীঃ লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক (পর্ব-০২)

নুরে আলম মুকতা

বিমানের লাউঞ্জে সবাই চলে গিয়েছে। কিন্তু আমরা ভাই-বোন একটি পুলিশ বক্সে আটকে আছি। প্রিয় বন্ধু, কখনো এ বিষয়গুলো নিয়ে ছটপট করার প্রয়োজন নেই। সমাধান তো হবেই। এজন্য ধীর আর স্থির থাকাই শ্রেয়।

পাঁচমিনিটের মধ্যে আমাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। বোর্ডিং পাস চেঞ্জ করার সময় ভাগ্নে বিমানের সীল দিতে ভুলে গিয়েছিল। ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে ঐ সীল থাকার জন্য ঝামেলা হয়নি। সহযাত্রীরা চিন্তিত হয়েছিল আর আমি উপভোগ করেছিলাম মানুষের ভালোবাসা ! বাংলাদেশ বিমানের উষ্ণ অভ্যর্থনায় সিক্ত হয়ে বিজনেস ক্লাসে ভাইবোন আসন নিলাম। বেশ কিছু সময় কেটে গিয়েছে। স্বজনদের সাথে ফোন কল তো শেষ হয় না, বিমানও ওড়ে না।

কিছুক্ষণ পর পাইলট বিনীত স্বরে ঘোষণা করলেন, “আমাদের বিমানে সামান্য যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য বিলম্ব হচ্ছে। সম্মানীত হাজীসাহেবগণ আমাদের বিমানে চিলিং সিস্টেম বিকল হবার কারনে আপনাদের গরম অনুভূত হচ্ছে, এজন্য আমরা দুঃখিত। আমরা বিমানে বিশেষ পদ্ধতিতে জল দিয়ে উড়াল দেয়া পর্যন্ত অবস্থা ম্যানেজ করছি, আপনারা বিমানের উপরে তাকালে ফোটা ফোটা জল দেখতে পাবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা জেদ্দা বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো ইনশাআল্লাহ……….. বিসমিল্লাহে মাজরেহা ওয়া মুরসাহা ইনা রাব্বি লাগাফুরুর রাহিম।”

বিকেল তিনটা দশ মিনিটে আমাদের বিমান উড়ে চললো স্বপ্নের রাজ্যে। দীর্ঘ প্রতিক্ষীত স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছি আমরা। আপার যেন খুশির জোয়ার বইছে। বিমান বালাদের মা সম্বোধন করার জন্য আপা আমার প্রতি নাখোশ। বলে, “তোর মেয়ে তো ছয় বছরের, তুই কিনা এ মহিলাদের সমানে মা বলছিস?” আমি বললাম, “আমি যদি আপা বলি? না আপা, তাই কি আর হয়? আমার মা হলে আপনারও।” একজন বালা সমাধান টানে। “স্যার যার যা ইচ্ছে বলুন, আপনাদের প্রয়োজন সার্ভ করার চেষ্টা করি আমরা”।

হজ্বের প্রতি ওদের আবেগ আর ভালোবাসা কোনদিনই ভোলার নয়।ভারতের আকাশ সীমা পেরিয়ে যাবার সময় আমরা বেশ কিছু মহাসাগরীয় ছোট ছোট ঝড়ের কবলে পড়ি। সুযোগ্য পাইলট আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন, ল্যাট্রিনে থাকলে দ্রুত বেরিয়ে আসুন, সীট বেল্ট ভালো করে বেঁধে নিন, আপনার আসনের ডান হাতলের সবুজ বাটনে চাপ দিন অক্সিজেন মাস্ক আর লাইফ জ্যাকেট বেরিয়ে আসবে। জরুরী প্রয়োজনে এগুলো ব্যাবহার করবেন, শিশুদের আগে এগুলো ব্যাবহার করতে দিবেন। দীর্ঘ ভ্রমণ তাই সর্বোচ্চ সতর্কতা।

বিমানের খাদ্য সরবরাহ এক কথায় চমৎকার। দু’ ভাই-বোন গল্প আর আনন্দে কখন এত সময় পেরিয়ে এসেছি বুঝতে পারিনি। মাঝে মাঝে মনিটর দেখে সুশিক্ষিত, দক্ষ শিক্ষক আপাকে দূরত্ব, বিমানের গতি আর অবস্থান জানান দিয়েছি। একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিলাম। হঠাৎ পাইলটের ঘোষণা শুনে আমরা সবাই প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। সম্মানিত হাজীবৃন্দ, আমরা ইনশাআল্লাহ এক ঘন্টার মধ্যে জেদ্দা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতে যাচ্ছি। আপনারা দয়া করে আমাদের নির্দেশনা মেনে চলুন। আমরা সাড়ে আটঘন্টা আকাশে উড়ে জেদ্দার মাটি স্পর্শ করি…লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখরিত হয় চারিধার।প্রায় সবার চোখে আনন্দাশ্রু।

বিমান থেকে নামার সময় অপেক্ষাকৃত কম বয়সী বিমান বালার অশ্রুসিক্ত দোয়ার জন্য করজোড়ে মিনতি হৃদয় ছুয়ে যায়। আরেক দুনিয়ায় প্রবেশ করলাম। কিছু জানি না,চিনি না। মোয়াল্লেম ছাড়া মুভমেন্ট অসম্ভব। কোনদিকে হাঁটছি,কোথায় যাচ্ছি? বহর যেদিকে যাচ্ছে ফলো করছি। আপার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই।

গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে জমায়েত হলাম। একজন সৌদি ডাক্তার সবার টিকার কার্ড পরীক্ষা শুরু করলেন। আমরা উৎরে গেলাম কিন্ত আমাদের দক্ষিণের জেলার কিছু ভাই-বোন আটকে গেলেন। কষ্ট পেলাম। যাবার আগে আমাদের সিভিল সার্জন অফিসে মেনিনজাইটিস আর ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধী ভ্যাকসিন দেয়া হয় সকল হজ্ব গমনেচ্ছুদের। এ কার্ডটি যত্ন করে সংরক্ষণ জরুরী।

জেদ্দা এয়ারপোর্টের চেকিং কস্টকর। তিনটি পয়েন্টে তাও আবার একস্থানে নয়। সঙ্গে থাকা মালসামান আর সাথী টেনে নিয়ে যাওয়া ভুক্তভোগী মাত্র জানেন। রাত কত হয়েছে জানি না, দুনিয়ার পুলসিরাত অতিক্রম করছি যেন। সবশেষে এক্সিট পয়েন্টে লাগেজ স্ক্যানিং। আপার লাগেজ আটকে দিল ওরা। চাকু দিয়ে কেটে ফেলবে লাগেজ। অনেক অনুনয় করে থামালাম। কিন্তু এমন করে বাঁধা ছিল যে খোলার সময় পর্যন্ত ওরা অপেক্ষা করতে নারাজ।
শেষে আপত্তিকর কিছুই পেল না। পেরেশান হলাম আমি। ভাষা এখানে বিশাল বাঁধা। আমি যখন হাঁফ ছেড়েছি,

ততক্ষণে আমাদের কাফেলা বাংলাদেশ পয়েন্টে চলে গিয়েছে। আমি আর এগোতে পারছি না। না চিনে তো যাওয়া ঠিক হবে না। বিশ্বের সকল মানুষের আপ-ডাউন! কোন দিকে যাব? তাই অপেক্ষা ছাড়া গত্যন্তর নেই। বসে পড়লাম সমস্ত সামান নিয়ে। গায়ে ইহরাম থাকলে পুলিশ কিছু বলবে না। বেশ কিছুক্ষণ পর মোয়াল্লেমের সহযোগী এসে আমাকে নিয়ে যায়। আপার চোখে জল। সবাই ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছি কিন্তু কেহ খাবার বিষয়ে মুখ খুলছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পবিত্র মক্কা নগরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো।

রাতের কারনে আশ-পাশ দেখতে পাচ্ছি না। সবাই কাফেলার জন্য নির্দিষ্ট বাসে উঠে পড়লাম। মোয়াল্লেম দেখে নিলেন সবাই উঠেছি কিনা। প্রায় পঁচাশি কিলোমিটার পথ আমাদের অতিক্রম করতে হবে। বাইরের কিছুই ঠাহর করতে পারছি না। মাঝে মাঝে পুলিশ চেকিং আমার কাছে বিরক্তিকর মনে হয়েছে।

এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো যে, মানুষ আর লাগেজ পরিবহনের জন্য ওখানে সর্বদা আলাদা যানবাহন।

বেশ কিছুক্ষণ পর এক প্যাকেট করে শুকনো খাবার আর পানি দেয়া হলো। আহ ,প্রশান্তি। আর কিছু না পাই, পানিটুকু আত্মা শান্তি করলো। তেমন উল্লেখ করার মতো স্থাপনা চোখে পড়েনি। মাঝে মাঝে গুচ্ছ আলো দেখেছিলাম। পরে জেনেছিলাম ওগুলো বিচ্ছিন্ন স্থাপনা,সরকারি চেকপোস্ট আর তেল সরবরাহ কেন্দ্র। চেকপোস্টে আবার গাড়ী থেমে গেলে আমরা বিরক্ত হই। এবার অন্য কারণ। মোয়াল্লেমের প্রতিনিধি বললো, আপনারা সবাই যার যার পাসপোর্ট হাতে নিন,বিমানের টিকিট আর কিছু হলোগ্রাম যুক্ত কাগজ আপনাদের জেদ্দায় দেয়া হয়েছে ওগুলো নিজের কাছে রাখুন। অনেক বিলম্ব হলো। সৌদি পুলিশ ও গুলো না পেলে গাড়ি ছাড়বে না। জেদ্দার ধকলে সবার পাসপোর্ট বের করে দিতে ঝামেলা হলো। মোয়াল্লেম আমাদের আগেই এ তথ্যটি দিলে আমাদের সুবিধা হত।

পুলিশের কাছে পাসপোর্ট জমা দিয়ে দিলাম। মোয়াল্লেমের সহযোগী বলল,সামনেই মক্কা গেট। চোখ রাখুন। এবার ঘন স্থাপনা দেখে মনে হচ্ছে উপশহরে আমরা। মূল মক্কা শহর প্রবেশ অল্প সময় মাত্র । চির স্বপ্নের শহর, মহানবীর(সাঃ) জন্মভুমি,কাবা বায়তুল্লাহর মক্কা! বিবি খাদীজা, মা আয়েশা, আল হেরার মক্কা!

আনন্দ আর আনুগত্যের সাথে সবার কন্ঠে,” লাব্বাইক আল্লাহুমা লাব্বাইক” ধ্বনিত হলো। বিশাল রেহেলে রাখা পবিত্র মহাগ্রন্থ আল- কুরআন সদৃশ গেট এর গায়ে লেখা,ONLY FOR MUSLIMS. শরীর-মনে অদ্ভুত শিহরণ!

পবিত্র মক্কা নগরীর রাজপথে প্রবেশ করছি আমরা। তখন সৌদী সময় রাত দুটো বেজে তিরিশ মিনিট। আমাদের বাড়ি ভাড়া করা ছিলো আল মিসফালাহ ওভার ব্রীজ থেকে সামান্য দূরে আলমানসী ফাইভ স্টার হোটেলের পাশে। রাতে কিছুই বুঝতে পারছি না। কোথায় যাচ্ছি। শুধু বোঝা যাচ্ছে যে মক্কা নগরী সত্যিই কখনও ঘুমায় না। অবশেষে রাজপথে এক স্থানে এসে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। আপনারা দ্রুত নেমে পড়ুন, লাগেজের গাড়ি এক্ষুনি পৌঁছে যাবে,আপনারা নিজ নিজ লাগেজ বুঝে নিয়ে যাবেন, মোয়াল্লেমের সহযোগী বলল। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম রাস্তার পাশে লম্বা শপিং মলের আইল্যান্ডে একটি মৃত বৃক্ষের তলায় দাঁড়িয়ে আমরা।

আপার জন্য যেভাবেই হোক গ্রাউন্ড ফ্লোরে ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য আমি ছটফট করছি এমন সময় লাগেজের গাড়ি চলে এলো। লাগেজ আর টানতে পারছি না। শরীর বিধ্বস্ত। কোনমতে টেনে হিচড়ে বাড়িতে উঠলাম। আপাকে সেট আপ দিয়ে ছুটলাম নিজের রুমের খোঁজে । আমার জায়গা হলো থার্ড ফ্লোরে। হায় আল্লাহ! আমার জন্য পাঁচ জন অপেক্ষমান। আমি যে রুমে যাব ওরাও সাথী হবে। শেষে শিক্ষক বন্ধুকে অনেক বুঝিয়ে পাশের রুমে দিয়ে বললাম, তুই ওখানে রাতটুকু কাটা তারপর যেভাবেই হোক আমি আমার কাছে নিয়ে আসব। ও সস্ত্রীক ছিলো।
(চলবে)

আগের পর্ব-  ভ্রমণ কাহিনীঃ লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক (পর্ব-০১)

লেখকঃ সাহিত্যিক, শিক্ষক ও সহ-সম্পাদক, মহীয়সী 

আরও পড়ুন