Ads

ভ্রমণ কাহিনীঃ লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক (পর্ব-০৪)

নুরে আলম মুকতা

কিং আবদুল আজিজ গেট দিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম। আল্লাহু আকবর! চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা, আবেগ ধরে রাখা যাচ্ছেনা,শরীর থর থর করে কাঁপছে, আপা আমার হাত ধরে বলছে পানি চাই৷!লাব্বায়িক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক মুখরিত চারিধার…..পৃথিবীর সমস্ত কিছু বিলীন হয়ে গিয়েছে,সমস্ত সৌন্দর্য এখানে এসে শেষ হয়ে গিয়েছে! একটি ঘর! আল্লাহু আকবর..

 

অসীম শক্তি আর ভালোবাসা দিয়ে বিশ্বের সৃষ্টি ধারণ করছে। আর কিছু দেখার দরকার নেই, শুধু কাবা দেখলেই সব দেখা হয়ে যায়। কিয়ামত পর্যন্ত কোন সৌন্দর্য এর ধারে কাছে ঘেষতেও পারবে না। সুবহানাল্লাহি অবি হামদিহি।অশ্রু গড়িয়েই যাচ্ছে। কে কার মুছবে? আমি আপার আর আপা আমার ! শুকরিয়া আর আনন্দাশ্রু!

 

মাকামে ইব্রাহিমের কাছে এসে আপা দুবাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে,আমি বলছি ছেড়ে দেন,মানুষের চাপে মারা যাবো আপা, নড়তে পারছি না,আমার দম বন্দ হয়ে যাচ্ছে,নিশ্বাস নিতে পারছি না। আপা চুমুর পর চুমু দিয়েই চলেছে পাগলের মতো। আলহামদুলিল্লাহ…. আমরা তাওয়াফ শেষ করলাম।

 

নামাজ আর দোয়া সেরে দৌড়ালাম সায়ী করার জন্য। সাফা-মারওয়া…. মা হাজেরা র দৌড়! আহ্, বক্ষ বিদীর্ন হয়ে যায়! ছোট্ট শিশু ইসমাঈলের কান্না কর্নকূহরে ধাক্কা মারে, প্রভু পানি দাও,আমার সন্তান রক্ষা করো, প্রভু দাও,দাও দাও………মায়ের গগন বিদারী ফরিয়াদ…দুই পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে নারীর কবুল হওয়া ফরিয়াদ এখনও কি হাজীরা শুনতে পায়?

 

না হলে এভাবে দৌড়াবে কেন? সবাই তো ক্লান্ত! প্রাণের বিনিময়ে হলেও দৌড়ায় সবাই। বলে রাখা ভালো যে এখন দুই পাহাড়ের মধ্যেবর্তী আর চারপাশ দারুনভাবে সুরক্ষিত। বিশেষ স্থাপত্যরীতির মাধ্যমে এ দুটিকে সুরক্ষা করা হয়েছে। হাজীদের প্রান্তে শক্ত আর মোটা কাঁচের দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে আশ্চর্য পাহাড়! তারপরেও কেউ যেন আবেগ বশত শিরক বিদআতের মতো কিছু যেন না করে বসে এজন্য পুলিশ সতর্ক, দন্ডায়মান। ওরা কিছুই বলবে না, শুধু বলবে… হাজ্জা..হা..রা..ম ।

 

আমাদের কাফেলার লোকজন পাওয়া গেলো না। পাওয়া সম্ভবও নয়। আমি পানির জন্য পাশে একটি জমজম কুপের ট্যাপ সার্ভিসের কাছে গেলাম। পানি এমন করে পান করছি মনে হচ্ছে ভেতরে সব চলে যাচ্ছে। মরুভুমিতে পানি ঢেলেই যাচ্ছি। শুকিয়ে কাঠ। অনেকক্ষণ শুয়ে থাকলাম মেঝেতে। মাথার ওপর ছাদ, নীচে এমন পাথর দেয়া যে, কোন তাপেই গরম হয় না। বিস্ময়কর। পরে জেনেছিলাম। এগুলো গ্রীস,ফ্রান্স আর ইটালী থেকে আমদানী কৃত। আর এগুলো পৃথিবীতে নেই। যা আছে সব সৌদী আরব কিনে নিয়েছে। হোটেলে ফিরে এলাম। কিন্তু লোকজন নেই। ক্ষুধায় কাতর অবস্থা। মাথা মুন্ডন করে পরিস্কার হতে হবে। এহরামের কাপড় ত্যাগ করে গোসল সারতে হবে। দুপুরের পরে জানলাম সবাই ফিরেছে। কিন্তু এক দম্পতি নিরুদ্দেশ। আপা আর আমার খুবই প্রিয় মালি বুবু আর দুলাভাই কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এক পাকিস্তানি নরসুন্দরের দোকানে গিয়ে ট্রাই করলাম। মাথা প্রতি দশ রিয়াল। আমরা নিজের মুদ্রায় সবসময় হিসাব করি। মাথা মুন্ডনের জন্য শুধু দুইশত কুড়ি টাকা! হবেনা! ফিরে এলাম আমাদের বাড়ি। হেডমাষ্টারের সেভিং কিট রেডি করে আমি আর আমার এক জামাতা নরসুন্দরের ভুমিকায় অবতীর্ণ হলাম

 

আমি জানি বিমান সেনা দুলাভাই আমার সাহায্য নেবে আবার ক্ষেপাবেও। ঠিক আছে কৌশল করেই এগোতে হবে। পুলিশ সুপারের কূটবুদ্ধি কাজে লাগিয়ে অর্ধেক ন্যাড়া করে রেখে দিলাম। সকলকে বিকালের নাস্তা না দিলে ওটা থেকে যাবে ঘোষণা দিলাম। বেলা পড়ে গেলে সন্ধ্যার আগে আগে আমি আর হেলাল ভাই, মালি বুবু আর দুলাভায়ের তালাশে বাংলাদেশ হজ্ব মিশন অফিসে গেলাম।

 

খুব দূরে নয় বাংলাদেশ মক্কা হজ্ব মিশন। সহজে পৌঁছে গেলাম। আপনারা পুলিশের কাছে যান,আমাদের বেশ কয়েকজন ওদের হেফাজতে আছে,মিশনের এক কর্মকর্তা বললেন। আমরা প্রায় দৌড়ে গিয়ে দেখলাম মালিমা আপা বসে আছে। বিধ্বস্ত চেহারা,সুন্দরী মহিলা কিন্তু কেমন যেন কালো হয়ে গিয়েছে দুই দিনের মধ্যে। আমাদের রিলেশন পুলিশকে বলার পর আপা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। তোমার দুলাভাই বলে চিৎকার করতে লাগলো। আমরা আপাকে শান্ত করে বের হব এমন সময় পুলিশের আরো একটি গাড়ী এলো। অনেকের সঙ্গে দেখছি দুলাভাই নামছে। বাংলা সিনেমার সমাপ্তি, নায়ক-নায়িকার মিলন। আমাদের সাথে সৌদি পুলিশও হেসেছিলো।

 

আপাকে মূহুর্তের মধ্যে জানালাম নায়ক-নায়িকা কে পাওয়া গিয়েছে। পুরো কাফেলায় শান্তির বাতাস বয়ে গেল। হেলাল ভাই ভালো খানার ব্যবস্থা করলো।
ওখানে সব রকমের আমাদের দেশী খাবার সুলভ। শুধু খুঁজে বের করতে হবে দোকানটি।দিনের বেলা কদম বাড়ানোই মুশকিল। দাবদাহ সহ্য করা যায়না। পানির বোতল সবসময় সাথে আছে।
আরেকটি তথ্য এখানে আমি দিয়ে রাখি। তৃষ্ণা পেলে বাইরে যদি পানি না পাওয়া যায়, তবে পাশের মসজিদে ঢুকে পড়ুন। অনেক মিনারাল ওয়াটারের বোতল ইনটেক থরে থরে সাজানো। নিয়ে নিন। ভয় বা লজ্জার কারণ নেই। ওগুলো মুসল্লী আর হাজীদের জন্যেই।
আরও পড়ুন