Ads

রমযানের শেষ দশকে রাসুল ( সাঃ) যা করতেন

।। ডঃ আব্দুল্লাহ আল মামুন আযহারী ।।

 ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,“যখন রমযানের শেষ দশক আসতো তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত্রে জেগেথাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন।” (বুখারী, হাদীস নং ২০২৪)

‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন,“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যান্য সময়ের তুলনায় রমযানের শেষ দিকে অধিক পরিমানে এমনভাবে সচেষ্ট থাকতেন যা অন্য সময়ে থাকতেন না।” (মুসলিম, হাদীস নং ১১৭৫)

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে এত পরিমাণ আমল করতেন যা তিনি অন্য কোন মাসে করতেন না। তাঁর আমলসমূহের মধ্যে অন্যতম আমল হলো: রাত্রি জাগরণ। রাত্রি জাগরণের আরেক অর্থ হতে পারে রাতের অধিকাংশ সময় জেগে ইবাদত করতেন। এক বর্ণনায় এসেছে, যে ব্যক্তি অর্ধরাত জাগরণ থেকে ইবাদত করল সে যেন পুরো রাত জেগে ইবাদত করল। সহীহ মুসলিমে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সকাল পর্যন্ত জেগে ইবাদত করতে দেখিনি।” (মুসলিম, হাদীস নং ৭৪৬)

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কেউ জামা‘আতের সাথে ইশার সালাত আদায় করে ফজরের সালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করার দৃঢ় ইচ্ছা থাকলে তার সারারাত জাগরণের সাওয়াব অর্জিত হবে। ইমাম শাফে‘ঈ রহ. বলেন, কেউ ইশা ও  ফজরের সালাতের জামা‘আতে উপস্থিত হলে সে লাইলাতুল কদরের অংশ প্রাপ্ত হবে। ইবন মুসাইয়্যেব থেকে ইমাম মালিকের থেকেও অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মারফু‘ সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি ইশার সালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করবে সে লাইলাতুল কদর প্রাপ্ত হবে। [1]

আবু জা‘ফর মুহাম্মাদ ইবন আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে মারফু‘ সুত্রে বর্ণনা করেন,“যে ব্যক্তি সুস্থ ও মুসলিম অবস্থায় রমযান পেয়ে দিনের বেলায় সাওম পালন করল, রাতের বেলায় সালাতে কুরআন তিলাওয়াত করল, চক্ষু অবনমিত রাখল, নিজের লজ্জাস্থান, যবান ও হাত হিফাযত করল, জামা‘আতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করল ও খুব তাড়াতাড়ি জুম‘আত সালাতে গেল, তাহলে সে যথাযথভাবে সাওম পালন করল, পুরোপুরি সাওয়াব প্রাপ্ত হবে, লাইলাতুল কদর লাভ করবে এবং তার রবের পুরস্কার প্রাপ্ত হয়ে সফলকাম হবে।[2] ইমাম জা‘ফর রহ. বলেন, দুনিয়ার রাজা-বাদশার পুরস্কারের সাথে সাদৃশ নয় (বরং এটি মহান রবের বিশেষ পুরস্কার)।

পরিবারের লোকদেরকে জাগানো:

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশকে তাঁর পরিবার-পরিজনকে সালাতের জন্য জাগাতেন, যা তিনি অন্য মাসে করতেন না। আবু যার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, “রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তেইশ, পঁচিশ ও সাতাশ রমযান তার পরিবারকে সালাতের জন্য জাগাতেন। আরও বর্ণিত আছে যে, তিনি বিশেষ করে সাতাশ রমযান তাঁর পরিবার-পরিজনকে সালাতের জন্য আহ্বান করতেন। এটি প্রমাণ করে যে, যে সময় লাইলাতুল কদর হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তিনি সেসময় তাদেরকে জাগিয়ে দিতেন। “রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামরমযানেরশেষদশ দিনতারপরিবারের লোকদেরকে জাগাতেন।”[3]

সুফইয়ান সাওরী রহ. বলেন, আমার কাছে সর্বাধিক প্রিয় কাজ হলো রমযানের শেষ দশ দিন আসলে রাতে বেশি পরিমাণ তাহাজ্জুদ পড়া, এতে কঠোর অধ্যবসয়ী হওয়া, পরিবার-পরিজন ও সন্তানদেরকে সম্ভব হলে জাগিয়ে দেওয়া। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতিমা ও আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর দরজায় কড়া নাড়তেন এবং বলতেন, তোমরা কি উঠেছ ও সালাত আদায় করেছ?। [4] তিনি রাতের বেলায় তাহাজ্জুদ সালাত শেষে বিতরের সালাত আদায় করার সময় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে জাগাতেন। তারগীবে বর্ণিত আছে, তিনি তাঁর এক স্ত্রীকে সালাতের জন্য জাগিয়েছেন এবং তার চেহারায় পানির ছিটে দিয়েছেন।

মুয়াত্তায় বর্ণিত আছে, উমাররাদিয়াল্লাহু ‘আনহুথেকেরাতেরপ্রথম অংশে যতটুকু সম্ভব সালাত আদায় করতেন। রাতের শেষাংশ হলে তিনি তার পরিবারের লোকদেরকে সালাতের জন্য জাগাতেন এবং বলতেন, সালাত, সালাত। অত:পর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করতেন, “আর তোমার পরিবার-পরিজনকে সালাত আদায়ের আদেশ দাও এবং নিজেও তার উপর অবিচল থাক।” [সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ১৩২][5]

 শক্ত করো কোমর বাঁধা:

তিনি রমযানের শেষ দশকে লুঙ্গি শক্ত করে বাঁধতেন (অর্থাৎ খুব বেশি ইবাদত করতেন) এবং স্ত্রীদের থেকে আলাদা থাকতেন (অর্থাৎ তাদের বিছানায়া যেতেন না), এভাবে রমযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত করতেন।

তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের শেষ দশদিন যেহেতু ই‘তিকাফ করতেন তাই ই‘তিকাফ অবস্থায় স্ত্রীদের নিকটবর্তী হওয়া তাদের সাথে মেলামেশা করা কুরআন, হাদীস ও ইজমা‘ দ্বারা যেহেতু নিষিদ্ধ তাই তিনি সে সময় স্ত্রীদের কাছে যেতেন না। কোন কোন সৎপূর্বসূরী নিম্নোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন যে,“অতএব, এখন তোমরা তাদের সাথে মিলিত হও এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিখে দিয়েছেন, তা অনুসন্ধান কর। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭]অর্থাৎ লাইলাতুল কদর তালাশ করো। এ আয়াতের ব্যাখ্যা এরূপ, সাওমের রাতে আল্লাহ স্ত্রী সহবাস হালাল করেছেন যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কাল রেখা থেকে স্পষ্ট হয়। তবে সাথে সাথে তিনি লাইলাতুল কদরও তালাশ করার আদেশ দিয়েছেন যাতে রমযানের সারারাত স্ত্রী উপভোগে কেটে না যায়। আর সারারাত স্ত্রী উপভোগে মত্ত্ব থাকলে লাইলাতুল কদর ছুটে যাবে। এ কারণে রাতে তাহাজ্জুদের সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়ে লাইলাতুল কদর অন্বেষণের নির্দেশ দিয়েছেন; বিশেষ করে সে সব রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের প্রথম বিশ দিন তার স্ত্রীগণের কাছে গমন করতেন অত:পর শেষ দশকে স্ত্রীদের থেকে আলাদা থাকে লাইলাতুল কদরের তালাশে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন।

 রাতের খাবার বিলম্ব করে সাহরীতে গ্রহণ:

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশকে রাতের খাবার বিলম্ব করে সাহরীতে একসাথে গ্রহণ করতেন। আবু সা‘ঈদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেবলতে শুনেছেন যে,“তোমরাসাওমে বেসাল পালন করবে না। তোমাদের কেউ সাওমে বেসাল পালন করতে চাইলে সে যেন সাহরীরসময় পর্যন্ত করে। লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যে সাওমে বেসাল পালন করেন? তিনি বললেন, আমি তোমাদের মতো নই, আমি রাত্রি যাপন করি এরূপঅবস্থায় যে, আমার জন্য একজনখাদ্য পরিবেশনকারী থাকেন যিনি আমাকে আহার করান এবং একজন পানীয় পরিবেশনকারী আমাকেপান করান।”[6]

এ হাদীসে রাসূলের সাওম, রবের উদ্দেশ্যে নির্জনে থাকা, তাঁর মুনাজাত ও যিকিরে মশগুল থাকার জন্য আল্লাহ তাঁর রাসূলের জন্য তাঁর ভালোবাসা ও তাঁর পবিত্র ফুৎকার ইত্যাদি যা কিছু নি‘আমত দান করেছেন সে সবের ইঙ্গিত বহন করে। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার অন্তরে আল্লাহর পরিচয় অনুভব করতেন, রবের প্রদত্ত খাবার গ্রহণ করতেন এবং মানবীয় পানাহার মুক্ত থাকতেন।

আল্লাহর জ্ঞানপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে তাঁর যিকির হলো তাদের অন্তরের খাদ্য যা তাদেরকে পানাহার থেকে মুখাপেক্ষীহীন রাখে। আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনে নিবেদিত কঠোর পরিশ্রমীগণ ক্ষুধা অনুভব করলে মুনাজাতের খাদ্য দ্বারা তৃপ্তি লাভ করে। অত:এব, তাদের জন্য অত্যন্ত পরিতাপ যার অতিরিক্ত খাওয়ার কারণে রবের মুনাজাতের স্বাদ থেকে বঞ্ছিত।

মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময় গোসল করা:

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশকে মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময় গোসল করতেন।[7]

ইবন জারীর বলেন, তারা (আলেমগণ) রমযানের প্রতি রাতে গোসল করতেন, কেউ আবার রমযানের শেষ দশকে যেসব রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি সে সব রাতে গোসল করে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন।

হাম্মাদ ইবন সালামাহ রহ. বলেন, সাবেত ও হুমাইদ রহ. রমযানের শেষ দশকে যে রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি সে সব রাতে সুন্দর পোশাক পরিধান করে সুগন্ধি ব্যবহার করে মসজিদে যেতেন এবং মসজিদ সুগন্ধি ও ধোঁয়া দিয়ে সুগন্ধময় করতেন। অত:এব, রমযানের শেষ দশকে যে রাতে লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি সে সব রাতে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া, সুগন্ধি ব্যবহার করা, গোসল করে সুন্দর জামা-কাপড় পরিধান করা মুস্তাহাব, যেভাবে অন্যান্য ঈদের দিনগুলোতে করা হয়। এছাড়া সব সালাতে পোষাকের দ্বারা সুসজ্জিত হওয়া শরী‘আতসম্মত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,“তোমরা প্রতি সালাতে তোমাদের বেশ-ভূষা গ্রহণ করো।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৩১] ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আল্লাহর জন্যবেশ-ভূষা গ্রহণ করা অধিক হকদার। তবে ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ সুসজ্জা ব্যতীত বাহ্যিক সুসজ্জা পরিপূর্ণ হয় না। আর আল্লাহর কাছে নিবেদিত হওয়া, তাওবা করা, সমস্ত গুনাহ থেকে পবিত্রতা অর্জন করা ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা ও সুসজ্জা অর্জিত হয়। কেননা বাতেনী সৌন্দর্য ব্যতীত বাহ্যিক সৌন্দর্য কোন কাজে আসে না। কবি বলেছেন,

কেউ যদি তাকওয়ার পোশাক পরিধান না করে, তবে সে সাধারণ পোশাক পরিধান করলেও উলঙ্গই হয়ে থাকে।

আল্লাহ কারো বাহ্যিক অবস্থা ও সম্পদের দিকে তাকান না; বরং তিনি তাদের অন্তর ও আমলের দিকে লক্ষ্য করেন। সুতরাং যেব্যক্তি তাঁর সম্মুখে সালাতে দাঁড়াবে সে যেন উত্তম পোশাকে বাহ্যিক সুসজ্জিত হয়ে এবং তাকওয়ার পোশাকে বাতেনী সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,“হে বনী আদম, আমি তো তোমাদের জন্য পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকবে এবং যা সৌন্দর্যস্বরূপ। আর তাকওয়ার পোশাক, তা উত্তম।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ২৬]

ই‘তিকাফ করা:

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রমযানের শেষ দশকে ইবাদতের মধ্যে অন্যতম ছিল ই‘তিকাফ করা। ‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাথেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামমারাযাওয়ারআগপর্যন্তরমযানের শেষ দশক ই‘তিকাফ করতেন।”[8] তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাইলাতুল কদরের তালাশে রমযানের শেষ দশ দিন সমস্ত কাজ-কর্ম ছেড়ে, অন্যান্য চিন্তা-ভাবনা মুক্ত হয়ে তার রবের মুনাজাত, যিকির ও দু‘আয় মগ্ন হতে ই‘তিকাফ করতেন।

ইমাম আহমাদ রহ. বলেন, ই‘তিকাফকারীর জন্য মানুষের সাথে মিলিত না হওয়াই মুস্তাহাব; এমনকি ইলম ও কুরআন শিক্ষার জন্যও নয়; বরং তার জন্য উত্তম হলো একাকী থাকা, তার রবের মুনাজাত, যিকির ও দু‘আয় একাগ্র থাকা। এ ধরণের ই‘তিকাফ হলো শর‘ঈ নির্জনবাস যা মসজিদে করতে হয়, এতে মানুষের সাথে একত্রিত হওয়া বাদ পড়ে না আবার জামা‘আতে সালাত আদায়ও বাদ না পড়ে। অন্যদিকে মানুষের থেকে একেবারেই আলাদা হয়ে নির্জনবাস করা শরী‘আতে নিষেধ। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে একলোক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো যে রাত জেগে সালাত আদায় করে আর দিনে সাওম পালন করে, তবে সে জুমু‘আর সালাত ও জামা‘আতে উপস্থিত হয় না। তিনি বললেন, লোকটি জাহান্নামী। অত:এব, এ উম্মাতের জন্য শরী‘আতসম্মত নির্জনবাস হলো মসজিদে ই‘তিকাফ পালন করা, বিশেষ করে রমযান মাসে, আরও নির্দিষ্ট করে রমযানের শেষ দশ দিন, যেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করতেন। ই‘তিকাফকারী আল্লাহর ইবাদত, আনুগত্য ও যিকিরে নিজেকে মসজিদে আবদ্ধ করে রাখে, দুনিয়ার সমস্ত ঝামেলামুক্ত হয়ে অন্তরকে একমাত্র রবের দিকে ঝুঁকিয়ে দেয় এবং তাঁর নৈকট্য লাভের প্রচেষ্টা করে। অত:এব, আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ ব্যতীত তার কোন কাজ থাকে না।

ই‘তিকাফের হাকীকী অর্থ হলো সৃষ্টির সাথে সব ধরণের সম্পর্ক ছিন্ন করে স্রষ্টার সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়া। তার রবের পরিচিতি, তাঁর ভালোবাসা ও তাঁর মমত্ববোধ যত বেশি শক্তিশালী হবে ব্যক্তি তত বেশি দুনিয়ার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে তাঁর প্রতি সম্পূর্ণ সম্পর্কযুক্ত হবে। কোন একলোক গৃহে সম্পূর্ণ একাকী থেকে তার রবের জন্য নিজেকে মুক্ত করল। তাকে একজন জিজ্ঞেস করল, তুমি কি একাকীত্ব অনুভব করো না? সে বলল, কীভাবে আমি একাকীত্ব অনুভব করব অথচ তিনি তো বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাকে স্মরণ করে আমি তার সাথে মজলিশে বসার সাথী।

হে মানুষ! যে নিজের জীবনকে নি:শেষ করে দিয়েছ, উঠ। তোমার জীবনে যা কিছু ছুটে গেছে সেগুলো লাইলাতুল কদরে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করো। কেননা একটি লাইলাতুল কদরই তোমার জীবনে ছুটে যাওয়া দিনগুলোর জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,“নিশ্চয় আমরা এটি (কুরআন) নাযিল করেছি ‘লাইলাতুল কদরে।’তোমাকে কিসে জানাবে ‘লাইলাতুল কদর’ কী?‘লাইলাতুল কদর’ হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।”[সূরাআল-কাদর, আয়াত: ১-৩]“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার পূর্বের মানুষের হায়াত দেখানো হলো অথবা আল্লাহ যতটুকু চেয়েছেন ততটুকু দেখানো হয়েছে। এতে তিনি তার উম্মতের হায়াত নিতান্তই কম মনে করলেন। যেহেতু অন্যান্য উম্মাতের দীর্ঘ হায়াতের কারণে তাদের বেশি আমল তার উম্মাতের কম হায়াতের কারণে অল্প আমল তাদের সমকক্ষ হতে পারবে না। অত:পর আল্লাহ তাকে লাইলাতুল কদর দান করেছেন যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।”[9]

মুজাহিদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনী ইসরাঈলের একলোকের কথা উল্লেখ করেন যিনি আল্লাহর পথে এক হাজার মাস অস্ত্র পরিহিত ছিল (অর্থাৎ হাজার মাস জিহাদ করেছেন)। এতে মুসলিমগণ আশ্চর্যন্বিত হলেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন,“নিশ্চয় আমরা এটি (কুরআন) নাযিল করেছি ‘লাইলাতুল কদরে।’তোমাকে কিসে জানাবে ‘লাইলাতুল কদর’ কী?‘লাইলাতুল কদর’ হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।”[সূরাআল-কাদর, আয়াত: ১-৩] অর্থাৎ বর্ম পরিহিত সে ব্যক্তি এক হাজার মাসের জিহাদের চেয়েও লাইলাতুল কদর উত্তম।”[10] নাখা‘ঈ রহ. বলেন, কদরের রাতে আমল করা অন্য সময়ের এক হাজার মাস আমল করা অপেক্ষা উত্তম। সহীহাইনে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,“যে ব্যক্তি লাইলাতুল ক্বাদরেঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদাত করে, তাঁর পিছনের সমস্ত গুনাহ মাপ করাহবে।”[11]

মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে, “যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরেঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদাত করবে, অত:পর সে রাত লাভ করার তাওফিকপ্রাপ্ত হবে, তার পিছনের ও পরের সমস্ত গুনাহ মাপ করাহবে।”[12]“এ মাসেএকটি রাত রয়েছে যা এক হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। যে ব্যক্তি সে রাতের কল্যাণ থেকেবঞ্চিত রয়ে গেল সে প্রকৃত বঞ্চিত রয়ে গেল।”[13] জুওয়াইবার রহ. বলেন, আমি দহহাক রহ.কে জিজ্ঞসে করলাম, হায়েয ও নিফাসবতী, মুসাফির ও ঘুমন্ত ব্যক্তির ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন? তারা কি লাইলাতুল কদরের মর্যাদা পাবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। যাদের আমলই আল্লাহ কবুল করেন তাদেরকেই লাইলাতুল কদরের মর্যাদা দান করবেন। সুতরাং কবুল হওয়াই এখানে মূল বিষয়, বেশি পরিমাণ ইবাদত মূখ্য উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হলো অন্তরের সৎকাজ ও এর পবিত্রতা। এখানে শারীরিক বেশি আমল উদ্দেশ্য নয়। কেননা কতিপয় রাত জাগরণকারী সালাত আদায়কারীর কষ্ট আর রাত জাগা ব্যতীত কিছুই প্রাপ্ত হয় না, কত সালাতে দণ্ডায়মান লোক সাওয়াব থেকে বঞ্চিত অথচ ঘুমন্ত ব্যক্তি আল্লাহর দয়াপ্রাপ্ত হয়। এ ঘুমন্ত ব্যক্তি যদিও ঘুমাচ্ছে কিন্তু তার অন্তর আল্লাহর যিকিরে জাগ্রত থাকে, আর সালাতে দণ্ডায়মান সে ব্যক্তি যদিও সালাত আদায় করছে কিন্তু তার অন্তর পাপী। বান্দা কল্যাণকর কাজের প্রচেষ্টা করতে, সৎকাজে কঠোর পরিশ্রম, অসৎ ও অন্যায় কাজ কাজ থেকে বিরত থাকতে আদিষ্ট। প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার কাজের ধরণ অনুযায়ী তার কাজ সহজ করা হয়। সৌভাগ্যবানদেরকে সৌভাগ্যবানদের আমল করতে সহজ করে দেওয়া হয় আর দুর্ভাগাকে দুর্ভাগাদের কাজ করতে সহজ করে দেওয়া হয়। সুতরাং এ মাসে আমলের মাধ্যমে গনীমত গ্রহণে দ্রুত এগিয়ে আসো। তোমার জীবনে যা হারিয়ে গেছে তা হয়ত ফিরে পাবে।

 

রেফারেন্সঃ 

[1]ইতহাফুল মাহরা, ইবন হাজার আসকালানী, ১৫/৪১৪।

[2]ফাদায়েলু রমযান, ইবন আবীদ দুনিয়া, পৃ. ৪৮।

[3]তিরমিযী, হাদীস নং ৭৯৫, ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন; আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

[4]মাশীখাতু ইবন বুখারী, জামালুদ্দীন ইবনুয যাহিরী আল-হানাফী, ১/৫৭২, তিনি হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

[5]মুয়াত্তা মালিক, ২/১৬২, হাদীস নং ৩৮৯; জামে‘উল উসূল, ৬/৬৮, হাদীস নং ৪১৭৯, মুহাক্কিক আব্দুল কাদির আরনাঊত হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।

[6]সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯৬৩।

[7]গোসল সম্পর্কিত হাদীস একেবারেই দ‘ঈফ। তাই এ সম্পর্কে বিস্তারিত লেখার প্রয়োজন বোধ করছি না। (অনুবাদক)

[8]সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০২৬, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৭২।

[9]মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং ১১৪৫, মুহাক্কিক আইমান শা‘বান সালিহ বলেন, ইমাম মালিক আহলে ইলমের সিকাহদের থেকে এ হাদীস শুনেছেন। এ হাদীসের মুরসাল শাওয়াহেদ আছে।দেখুন, জামে‘উল উসূল, ৯/২৪১। আলবানী রহ. হাদীসটিকে দ‘ঈফ মু‘দাল বলেছেন।

[10]আস-সুনান আল-কুবরা, বাইহাকী, হাদীস নং ৮৫২২, তিনি হাদীসটিকে মুরসাল বলেছেন; তাখরীজ আহাদীস আল-কাশশাফ, ৪/২৫৩, মুহাক্কিক হাদীসটিকে মুরসাল বলেছেন।

[11]সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০১।

[12]মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২২৭১৩, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে হাসান বলেছেন; তবে দুটি ইবারত ব্যতীত। সে দুটি ইবারত হলো (أَوْ فِي آخِرِ لَيْلَةٍ) এবং (وَمَا تَأَخَّرَ)।

[13]নাসায়ী, হাদীস নং ২১০৬, আলবানী রহ. বলেছেন, হাদীসটি সহীহ। মুসনাদে আহমদ, ৭১৪৮, শু‘আইব আরনাঊত বলেছেন, হাদীসটি সহীহ।

 

লেখকঃ 

সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,

শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি।

লেখকের প্রকাশিত লেখা –লাইলাতুল কদর ও আমাদের করণীয়

আরও পড়ুন-

রমজানের শেষ দশকে যেসব আমল করবেন

রমজানের শেষ ১০ দিন নবীজি (সা.) যেসব ইবাদত করতেন

আরও পড়ুন