Ads

সাহাবীদের জীবন কথা…”মুসয়াব ইবনে উমাইর রা.”

সাজেদা হোমায়রাঃ

রাসূল (সা.) এর অন্যতম প্রিয় সাহাবী মুসয়াব ইবনে উমাইর রা.। রাসূল সা. তাঁর প্রসংগ উঠলে বলতেন, “মক্কায় মুসয়াবের চেয়ে সুদর্শন এবং উৎকৃষ্ট পোশাকধারী আর কেউ ছিলো না।”

বাবা মার পরম আদরে ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিত হওয়া সুদর্শন এক যুবক মুসয়াব। তাঁর মা অনেক সম্পদশালী ছিলেন। তখনকার সময়ে মক্কার যতো রকমের চমৎকার পোশাক ছিলো সবই তিনি ব্যবহার করতেন। মক্কার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট এবং দামী পারফিউম ব্যবহার করতেন তিনি। মুসয়াব কোনো রাস্তা দিয়ে গেলেই সেই রাস্তা ঘ্রাণে আমোদিত হয়ে যেতো।

মুসয়াবের তীক্ষ্ণ মেধা, জাঁকজমকপূর্ণ জীবন, আউট লুক, স্মার্টনেস, ব্যক্তিত্ব, হৃদয়গ্রাহী ভয়েস…. সব কিছুই মক্কাবাসীরর মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিলো।

মক্কার অলিতে গলিতে, কুরাইশদের আড্ডায় তখন একই আলোচনা ‘মুহাম্মদ ও তাঁর নতুন দীন ইসলাম’। এসব আলোচনা শুনে মুসয়াবের খুব আগ্রহ হয়।
তিনি জানতে পারলেন, রাসূল সা. ও তাঁর প্রতি বিশ্বাসীরা আল আকরামের বাড়িতে সমবেত হন। সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে মুসয়াব একদিন হাজির হলেন আকরামের বাড়ীতে। রাসূল সা. সেই দিনগুলোতে তাঁর সাথীদের সাথে মিলিত হতেন, তাদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন, তাদের সাথে নামাজ আদায় করতেন। মুসয়াব সেখানে বসতে না বসতেই কুরআনের আয়াত নাযিল হলো। রাসূল সা. এর মুখ থেকে সে আয়াত বের হয়ে সকলের হৃদয়ে প্রবেশ করতে লাগলো। আর তখনই সেই বরকতময় সন্ধ্যায় মুসয়াবও হয়ে গেলেন বিশ্বাসী অন্তরের অধিকারী একজন মুসলিম। রাসূল সা. তাঁর একটি হাত বাড়িয়ে দিলেন মুসয়াবের বুকের উপর…..দারুণ এক প্রশান্তিতে বিভোর হয়ে পড়েন মুসয়াব।

ইসলাম গ্রহণের কিছুদিন পরই মুসয়াবের মা তা জেনে ফেলেন। মুসয়াবের মুসলিম হওয়া তাঁর মা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। বকাঝকা, মারপিট কিছুতেই তাঁকে ইসলাম থেকে ফেরানো যায়নি। শেষ পর্যন্ত মা তাকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখলেন। একদিন তিনি মায়ের চোখের আড়াল হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁর মা তাঁকে ইসলাম থেকে ফেরাতে ব্যর্থ হয়ে সবকিছু দেওয়া বন্ধ করে দিলো।

কুরাইশদের সেই চরম আদুরে ও বিলাসী যুবক মুসয়াব এখন মোটা শতচ্ছিন্ন তালিযুক্ত পোশাক পরেন। একদিন খাবার জুটে তো অন্যদিন জুটে না।

একদিন মুসলিমদের একটি দল রাসূলের পাশে বসে আছেন। এমন সময় পাশ দিয়ে তারা মুসয়াবকে যেতে দেখলেন। তাঁকে দেখেই বৈঠকে উপস্হিত সকলের চোখে পানি চলে আসলো। কারণ মুসয়াবের গায়ে তখন শত তালি দেয়া একটি জামা, যাতে মারাত্মক দারিদ্রের ছাপ। তাদের সকলের মনে তখন ইসলাম পূর্ব মুসয়াবের ছবি ভেসে উঠলো। এ দৃশ্য দেখে রাসূল সা. বললেন, “মক্কায় মুসয়াবের মতো বাবা মার এতো আদরের কোনো যুবক ছিলো না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসায় সে সবকিছু ত্যাগ করেছে।”

মুসয়াব ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম দূত (Ambassador)। মদীনায় মুসলিমদের দ্বীনের শিক্ষা ও ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য রাসূল সা. তাঁকে দূত হিসেবে মদীনায় পাঠান। মুসয়াবের প্রখর বুদ্ধিমত্তা, উদারতা, সুন্দর বক্তৃতা মদীনায় দ্রুত ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছিলো। মদীনায় সর্বপ্রথম তিনিই জুময়ার নামায কায়েম করেন।
প্রচণ্ড মেধাবী এই সাহাবী তাঁর বেঁচে থাকা অবস্থায় যতোটুকু কুরআন নাযিল হয়েছিলো, তিনি তা মুখস্হ করেছিলেন।

উহুদ যুদ্ধের ময়দান। রাসূল সা. মুসয়াবকে ডেকে ইসলামের পতাকাটি তাঁর হাতে দিয়েছিলেন।
উহুদ যুদ্ধে মুসয়াব অত্যন্ত আমানতদারীতার সাথে এক হাতে পতাকা উঁচু করে ধরেন এবং অন্য হাতে তরবারি চালান। হঠাৎ এক কাফের তাঁর দিকে এগিয়ে এসে তরবারির এক আঘাতে ডান হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। মুসয়াব বাম হাতে পতাকা তুলে ধরেন। তরবারির অন্য আঘাতে তাঁর বাম হাতটিও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দুই বাহু দিয়ে মুসয়াব পতাকা ধরেন। তারপর তাঁকে বর্শা নিক্ষেপ করা হয়, পতাকা সহ তিনি মাটিতে ঢলে পড়েন।

উহুদ যুদ্ধে শহীদ হয়ে যান মুসয়াব রা.।

যুদ্ধ শেষে মুসয়াবের লাশটি খুঁজে পাওয়া গেল। রক্ত ও ধুলোবালিতে একাকার।

তাঁকে কাফন দেয়ার জন্য পাওয়া গেল শুধু এক টুকরো চাদর। তা দিয়ে মাথা ঢাকলে পা আর পা ঢাকলে মাথা ঢাকছিলো না। পরে রাসূল সা. বললেন চাদর দিয়ে মাথার দিক দিয়ে যতটুকু ঢাকা যায় ঢেকে দিতে আর বাকী পায়ের দিকে ঘাস দিয়ে দিতে। রাসূল সা. মুসয়াবের লাশের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেললেন এবং কাফনের চাদরটির দিকে তাকিয়ে বললেন,” আমি তোমাকে মক্কায় দেখেছি। সেখানে তোমার চেয়ে কোমল চাদর এবং সুন্দর যুলফী আর কারো ছিলো না। আর আজ তুমি এখানে এই চাদরে ধুলিমলিন অবস্থায় পড়ে আছো।”

সাহাবীদের জীবনের গল্প…  আমাদের পথচলার অনুপ্রেরণা….

লেখকঃ সাহিত্যিক।

আরও পড়ুন