।। মুতমাইন্নাহ মুনিরা ।।
প্রত্যেকটা মুমিন হৃদয়েই পবিত্র হজ্জের বাসনা থাকে। কল্প পাখায় ভর করে প্রতিটি মুমিন হৃদয় ছুটে চলে মক্কার অলিতে গলিতে,কাবা প্রাঙ্গনে কিংবা ছুটে বেড়ায় সাফা মারওয়ার পথ ধরে।লাব্বাইকের মিছিলে নিজেকে শরিক করতে চায় প্রতিটি মুমিন মন।কল্পনায় ভাসে আরাফার সুবিশাল প্রাঙ্গন কিংবা মিনায় অবস্থিত হাজারো তাবুর সারি। মহান আল্লাহ যাকে ইচ্ছা কবুল করেন।স্বপ্ন আর কল্পনাগুলোকে বাস্তবে রূপ দেন।আলহামদুলিল্লাহ মহান আল্লাহ তা’য়ালা তার এই গুনাহগার বান্দিকেও কবুল করেছিলেন সেই লাব্বাইক ধ্বনির মিছিলে।
২০১৬ সালে আমি এবং আমার হাসবেন্ড হজ্জ করি।নবদম্পত্তিই ছিলাম বলা চলে তখন। সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশের মত না আসলে।আলিম পরিক্ষা দিয়ে হাসবেন্ড এর ইউনিভার্সিটির ফ্যামিলি ভিসায় চলে আসি রিয়াদে।রমাদান শুরু হবার বাকি ছিল কয়েকটা দিন মাত্র।জীবনের প্রথম অন্যরকম উৎসব মুখর একটা রমাদান কাটাই সৌদিআরবের রাজধানী রিয়াদে। এরপর জিলহজ্জ কাছাকাছি এলে আমরা হজ্জের প্রস্তুতি নেই। রিয়াদ থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে সফর শুরু হয় আমাদের।পিচঢালা রাস্তার দুপাশের মরুভূমি,পাহাড়,মরুভূমিতে বেড়ে উঠা ছোট ছোট গাছ আর মাঝেমধ্যে উটের পাল দেখাতে দেখাতে বাস আমাদের নিয়ে চলছিল সেই পবিত্র নগরীর দিকে।
রাতের বেলায় চাঁদ আর তারাদের স্নিগ্ধ আলোয় দূর দূরান্তের মরুভূমির পাহাড় গুলোকে মনে হচ্ছিল বড় বড় দানবের মত। তারার দিকে তাকিয়ে মন চলে গিয়েছিল চোদ্দশত বছর পিছনে।পিচঢালা এই পথগুলো তো তখন ছিল না।এই উত্তপ্ত মরুভূমির বালুরাশি ভেদ করে কিভাবে পথ চলতেন প্রানপ্রিয় নবীজি, সাহাবায়ে কেরাম এবং তখনকার মানুষেরা? কিভাবে পথ নির্ণয় করতেন? এমন অনেক চিন্তা করতে করতে পৌছে গিয়েছিলাম মিকাত- কারনুল মানাযিলে। সেখান থেকে ইহরাম বেধে, ফজর সালাত পড়ে তালবিয়া পাঠ করতে করতে আবার রওয়ানা হলাম মক্কার দিকে।
পরদিন ভোরে মক্কায় পৌছে ওমরাহ করলাম। হজ্জের আগের পুরো সময়টা দুজন মসজিদুল হারামেই কাটিয়েছিলাম বেশিরভাগ সময়।হোটেলে খুব কম সময়ই যেতাম।ভোর রাতেই বেরিয়ে পরতাম।কাবার চত্ত্বরে তাহাজ্জুদ,ফজর পড়ে পুরো হারাম এরিয়া ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম।
মাঝেমধ্যে কাবার পাশেই মধ্যরাতে নামাজ পড়ে, তিলাওয়াত করতে করতে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম দুজন।ঘুম ভাঙলে অজু করে এসে কিয়ামুল লাইলে দাড়াতাম।প্রায়দিনই সকালের নাস্তা দারুত তাওহীদের পাশের বিশাল শপিং মলে অবস্থিত সৌদি আরবের বিখ্যাত আল বাইকে গিয়ে করতাম।
এরপর হয়তবা হোটেলে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার যোহরের নামাজের উদ্দ্যেশ্যে বেরিয়ে পড়তাম।একেবারে এশার পর আবার ফিরতাম হোটেলে।হারামের একেবারে পাশেই মিসফালাহ তে হোটেল হবার কারনে খুব সহজ হতো হারামে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে।আশপাশের বাঙ্গালি হোটেলগুলোতে মাশাআল্লাহ ভালো দেশি খাবারের ব্যবস্থা আছে।
হজ্জের সফরে থাকা অবস্থায়ই আমার আলিম পরিক্ষার রেজাল্ট বের হলো।মনে পড়ে, রেজাল্টের আগের দিন কাবা চত্ত্বরে তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর দরবারে খুব চেয়েছিলাম ভালো একটা রেজাল্ট। সুবহান আল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আমার আল্লাহ হজ্জের একটি দোয়াও অপূর্ণ রাখেনি তার এই ছোট বান্দির জন্য।
আরও পড়ুন- সুখের সন্ধানে
আনুষ্ঠানিক হজ্জের দুদিন আগে মিনার পাশে একটা হোটেলে উঠি মরহুম চাচা শশুরের ট্রাভেলসের হাজীদের সাথে। খুব সম্ভবত দশ তলার উপরে একটা রুমে ছিলাম।রুমটা অনেক বড়, আর ছয়জনের বেড ছিল রুমে।আমার সাথে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে দাদুর বয়সী একজনকে পেয়েছিলাম। আপন নাতনীর মতই ভালোবেসেছেন আমাকে। আর দুজন আন্টি ছিলেন যাদের মেয়ে ছিল না।আমাকে এতোটা আদর,ভালোবাসা দিয়েছেন যে,অন্যান্য হাজীরা ভাবত এ দুজনের একজন হয়ত আমার আম্মু। দুজন ই মা মা বলে ডাকতেন আমাকে। আংকেল দুজন ডাকতেন আম্মাজান বলে। কাফেলায় সর্বকনিষ্ট হওয়ায় সব হাজীদেরই অনেক অনেক ভালোবাসা পেয়েছিলাম আলহামদুলিল্লাহ।
৭ ই জ্বিলহজ্জ রাতেই আমরা মিনায় চলে যাই। হোটেল থেকে হেটে তালবিয়াহ পাঠ করতে করতে আমরা মিনায় পৌছাই। ৮ই জ্বিলহজ্জ সারাদিন আমরা মিনায় অবস্থিত আমাদের নির্দিষ্ট তাবুতে অবস্থান করি।
৯ই জ্বিলহজ্জ ফজরের পর আরাফায় যাই এবং সেখানে অবস্থান করি।আরাফায় আমাদের তাবু ছিল মসজিদে নামিরা থেকে মোটামুটি দূরেই।তাই তাবুতেই আমরা জামাতে নামাজ আদায় করি।এখনো সেই দিনটি চোখ বন্ধ করলেই স্পষ্ট দেখতে পাই।
হাজীদের কান্নার শব্দ এখনো শুনতে পাই…..। মনে পড়ে,আমরা দুজন তাবু থেকে বের হয়ে অদূরে এক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে, আকাশের পানে দুহাত তুলে অঝোরে কাঁদছিলাম আর মনের সব চাওয়া পাওয়া, সুখ দুঃখ,না বলা যত কথা….. সব…..সব পেশ করছিলাম রব্বে কারীমের দরবারে।
আকুতি মিনতি করে মাফ চাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল আমি আমার রবের সামনে খুব খুব বড় এক অপরাধী দাঁড়িয়ে আছি,আর ভয়ে থরথর করে কাঁপছি…..। হাজীরাই কেবল আরাফায় কাটানো সেই মূহুর্ত গুলো অনুধাবণ করতে পারবেন।
তাবুতে অবস্থানকালীন সময়ে প্রচন্ড ক্লান্তিতে আমি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম।পুরো কাফেলার সবার যত্ন আর আন্তরিকতা ভুলবার নয়। আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে ভালো রাখুন। মজার ব্যাপার হচ্ছে অনেকেই ভাবতেন আমি আমার আম্মু আব্বুর সাথে এসেছি। কিন্তু যখন শুনতেন আমি তাদের পছন্দের হুজুরের বউ তখন অবাক হয়ে যেতেন। হাসবেন্ড যেহেতু হাজীদের মুয়াল্লিমও ছিলেন তাই সবাই উনাকে হুজুর বলে ডাকতো আর বেশ পছন্দ করতো।
আরাফার ময়দানে যেদিকেই তাকাতাম, শুধু নিম গাছ দেখতে পেতাম। শুনেছি সর্বপ্রথম আরাফার ময়দানের জন্য নিম গাছ উপহার দিয়েছিলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। সেই গাছগুলো হয়ত এখনও মরুভূমির প্রচন্ড গরমে হাজীদের একটু শান্তির ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে।
৯ই জ্বিলহজ্জ সন্ধ্যায় আমরা মুজদালিফায় পৌছে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করি। অতঃপর জামারাতে নিক্ষেপের জন্য পাথর সংগ্রহ করে রাখি। মুজদালিফার পুরো প্রাঙ্গন জুড়ে ছোট ছোট পাথর কণা।সেখান থেকেই খালি পানির বোতলে গুনে গুনে পাথর সংগ্রহ করছিলেন হাজীরা। ১০ই জ্বিলহজ্জ আমরা মুজদালিফা থেকে হেটে মিনা হয়ে জামারাতে এসে কংকর নিক্ষেপ করি। এরপর একে একে হজ্জের কার্যাবলি শেষ করি।
হজ্জ শেষে আমরা মক্কা থেকে জেদ্দায় বেড়াতে যাই হাসবেন্ড এর বড় বোনের বাসায়।সেখানে সবার সাথে সমুদ্রপাড়ের স্নিগ্ধ মুহুর্তগুলোও ভুলার নয়।সবশেষে মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে জীবনের অন্যতম সুখময় মুহুর্তগুলোর স্মৃতি বুকে ধারণ করে প্রশান্ত নফস নিয়ে রিয়াদে ফিরে আসি আলহামদুলিল্লাহ। মহান আল্লাহ আমাদের হজ্জ্ব ও যাবতীয় নেক আমলগুলো কবুল করে নিন।
লেখকঃ মুতমাইন্নাহ মুনিরা, শিক্ষার্থী, কিং সউদ বিশ্ববিদ্যালয়, রিয়াদ, সৌদিআরব।
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ,পরিবার ও আত্মউন্নয়ন মূলক অসাধারণ লেখা ও আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিন।
এবং প্রিয় লেখক ! আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে- [email protected] ও [email protected]
প্রিয় লেখক ও পাঠক আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।