।। ড. মোহাঃ ইয়ামিন হোসেন ।।
দুপুরের ছোট্ট ঘুম বা সিয়েস্তা এবং পাওয়ার ন্যাপ একটি বৈশ্বিক সংস্কৃতি । ইউরোপের অনেক দেশে, বিশেষ করে যেখানে গরম আবহাওয়া বিরাজমান, সিয়েস্তা বা ভাত-ঘুম একটি প্রচলিত এবং গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতি। গ্রীস ও স্পেনের মতো দেশগুলোতে দুপুরের খাবারের পর এক ঘণ্টার ঘুম বা সিয়েস্তা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। এই সময়ে শহরগুলো প্রায় ঝিমিয়ে পড়ে, এবং কাজকর্ম কিছু সময়ের জন্য বন্ধ থাকে।
The art of Fitness and Life এর প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান হায়েস ইল এর লেখা আর্টিকেল “The Secret to Google’s and Facebook’s Success Is This 20-Minute Perk (and Employees Love It)” এ উঠে এসেছে যে গুগল এবং ফেসবুকের সাফল্যের পিছনে দুপুরে খাবার পরে এর কর্মীদের ২০ মিনিটের ছোট্ট ঘুম বেশ কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে ।
একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আমেরিকার প্রায় ২৯ শতাংশ কর্মী রিপোর্ট করেছেন যে দুপুরে কাজ করার সময় ঘুমিয়ে পড়েন বা ঘুম ঘুম ভাবের মধ্যে থাকেন । Sleep.org-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে জানা যায় যে দুপুরে একটা ছোট্ট ঘুমের অভাবেই আমেরিকায় নাকি কমে যাওয়া উৎপাদনশীলতার জন্য ৬৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়।
এরই প্রেক্ষিতে আমেরিকায় কিছু কোম্পানি দুপুরে খাবার পর তাদের কর্মীদের জন্য ২০ মিনিটের ঘুমের ব্যবস্থা রাখার সংস্কৃতি চালু করছে । এইসব কোম্পানির মধ্যে গুগল এবং ফেসবুক অন্যতম ।
আরও পড়ুন-
বিজ্ঞানের আলোকে দুপুরের ছোট্ট ঘুমের উপকারিতা
শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা
১. শরীরের পুনরুজ্জীবন: সিয়েস্তা শরীরকে পুনরুজ্জীবিত করে, যা দীর্ঘ কর্মদিবসে সতেজতা ও উদ্দীপনা ফিরিয়ে আনে।
২. মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি: এটি মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে এবং মস্তিষ্ককে নতুন উদ্যমে কাজ করতে সহায়তা করে।
৩. স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি: সিয়েস্তা স্মৃতিশক্তি এবং সৃজনশীলতা বাড়াতে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
কর্মক্ষেত্রে উদ্দীপনা বৃদ্ধি
১. কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি: সিয়েস্তার পরে কর্মচারীরা কাজের প্রতি বেশি মনোযোগী এবং উদ্যমী হয়, যা তাদের কর্মদক্ষতা বাড়ায়।
২৷ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি: কম সময়ের ঘুম বা পাওয়ার ন্যাপ কর্মীদের কাজের গতি ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে।
৩৷ স্বাস্থ্যজনিত সুবিধা: সিয়েস্তা কর্মক্ষেত্রে কর্মচারীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে, যা তাদের কাজের প্রতি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশে সিয়েস্তা বা দুপুরের ঘুম
বাংলাদেশে সিয়েস্তা সংস্কৃতি তেমন প্রচলিত নয়। তবে গরম আবহাওয়া এবং দীর্ঘ কর্মদিবসের কারণে এটি খুবই উপকারী হতে পারে। বাংলাদেশে সিয়েস্তা চালু করার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
১. কর্মঘণ্টা পুনর্বিন্যাস: দুপুরের খাবারের পর এক ঘণ্টার বিরতি নির্ধারণ করা যেতে পারে।
২. প্রচারণা ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম: সিয়েস্তার উপকারিতা সম্পর্কে কর্মীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
৩৷ কর্মস্থলে বিশ্রামের স্থান: অফিসে বিশ্রামের স্থান নির্ধারণ করা, যেখানে কর্মচারীরা স্বল্প সময়ের জন্য বিশ্রাম নিতে পারে।
আরও পড়ুন-
ইসলাম ও সিয়েস্তা (দুপুরের ছোট্ট ঘুম)
ইসলামে দুপুরের খাবারের পর বিশ্রাম নেওয়ার ব্যাপারে অনেক হাদিস রয়েছে। হাদিসে বলা হয়েছে, নবী মুহাম্মদ (সা.) দুপুরের খাবারের পর বিশ্রাম নিতেন। কুরআনে সরাসরি সিয়েস্তার উল্লেখ না থাকলেও, বিশ্রাম এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
হাদিসের আলোকে দুপুরের ছোট্ট ঘুম
১. রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “তোমাদের উপর একটি অধিকার রয়েছে এবং তোমাদের আত্মার উপর একটি অধিকার রয়েছে।” (সহীহ বুখারী)
২. অন্য হাদিসে এসেছে: “তোমাদের শরীরেরও তোমাদের উপর অধিকার রয়েছে।” (সহীহ মুসলিম)
সিয়েস্তা ইসলামিক ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী ঐতিহ্যে সিয়েস্তা বা দুপুরের খাবারের পর বিশ্রাম নেওয়ার প্রচলন সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। নবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর জীবনধারায় সিয়েস্তার গুরুত্ব প্রদান করেছেন । যা আজও মুসলিম সমাজে প্রচলিত।
নবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর জীবনের অনেক সময় দুপুরের খাবারের পর বিশ্রাম নিতেন। একটি হাদিসে বলা হয়েছে,
“আনাস ইবনে মালিক (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুপুরের খাবারের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম গ্রহণ করেন, কেননা তা রাতে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে সাহায্য করে।’” (তিরমিযি)
আল্লাহর রাসূলের (সা.) জীবনের আর একটি ঘটনা থেকেও দুপুরে বিশ্রাম নেয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে জানা যায়,
“একবার নবী মুহাম্মদ (সা.) এক যাত্রার সময় দুপুরের খাবারের পর তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে বিশ্রামের জন্য একটি জায়গায় থামলেন। সঙ্গীরা তাঁকে বললেন যে তারা দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে চায় এবং বিশ্রামের সময় নেই। কিন্তু নবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁদের বললেন যে বিশ্রাম নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এটি তাদের পরবর্তী যাত্রায় শক্তি যোগাবে। তিনি নিজেও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন এবং তাঁর সঙ্গীরাও বিশ্রাম নিলেন।”
এই বিশ্রামের ফলে, নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর সঙ্গীরা পরবর্তী যাত্রায় আরও বেশি উদ্যমী ও সতেজ ছিলেন, যা তাদের যাত্রাকে আরও সফল ও আরামদায়ক করে তুলেছিল। এই ঘটনাটি শুধু শারীরিক বিশ্রামের গুরুত্বই নয়, বরং মানসিক শক্তিরও প্রমাণ বহন করে।
আরও পড়ুন-
ইসলামী ঐতিহ্য এবং স্বাস্থ্যগত উপকারিতা
ইসলামী ঐতিহ্যে সিয়েস্তা শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যই নয়, মানসিক স্বাস্থ্য এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। নবী মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনে সিয়েস্তার উদাহরণ থেকে বোঝা যায় যে এটি কেবল একটি ব্যক্তিগত অভ্যাস নয়, বরং একটি সামাজিক ও ধর্মীয় দায়িত্বও বটে। বিশ্রাম নিয়ে মানুষ যেমন শারীরিক শক্তি ফিরে পায়, তেমনি মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পায় এবং পরবর্তী কাজের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যম পায়।
সিয়েস্তা ইসলামী ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবী মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনের উদাহরণ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে সিয়েস্তা শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যের জন্যই নয়, বরং সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্রামের মাধ্যমে মানুষ তার দৈনন্দিন কাজগুলো আরও দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করতে পারে এবং মানসিক ও শারীরিক শক্তি বজায় রাখতে পারে।
উপসংহার বলা যায় যে, সিয়েস্তা বা পাওয়ার ন্যাপ গরম আবহাওয়ার দেশে একটি প্রাচীন ও কার্যকর সংস্কৃতি। এটি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় এবং কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি করতে অত্যন্ত সহায়ক। বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি প্রবর্তনের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে উদ্দীপনা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। ইসলামে বিশ্রামের গুরুত্ব রয়েছে, যা সিয়েস্তার উপকারিতাকে সমর্থন করে।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক এবং অধ্যাপক, ফিশারীজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে- [email protected] ও [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে । আসুন ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।
ফেসবুকে লেখক মোঃ ইয়ামিন হোসেন