Ads

সাহিত্য-জীবনের সুখ

।। সালমা সাহলি।।

কথায় বলে ‘ত্রিভুবন’। স্বর্গ-মর্ত-পাতালময়, অর্থাৎ সব কিছুকে জড়িয়ে থাকা। যেমনটা বলা যায় সাহিত্যের ক্ষেত্রে। আকাশ, সমুদ্র, মাটিজুড়ে; অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ ঘিরে; আলো, ছায়া, আঁধারে জীবনময় সাহিত্যের আবাস।

কেউ যদি প্রশ্ন করেন, সাহিত্য কি বা কাকে বলে? তাহলে প্রথমে বুঝা প্রয়োজন “সাহিত্য” শব্দের অর্থ কি। সাহিত্য শব্দটির অর্থ হলো- সহিত, মিলন, যোগ বা সংসর্গ। ভালোভাবে বুঝার জন্য সাহিত্য শব্দটিকে দু’টি বা তিনটি শব্দে ভেঙ্গে দেখতে পারি। দু’টি শব্দে, সাহিত্য= সহিত(যোগ)+হিত(কল্যাণ) এবং তিন শব্দে, সাহিত্য= সাহি(আনন্দদায়ক)+সহিত+হিত শব্দ সমূহ পাওয়া যাবে। শব্দগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোনো কিছুতে অন্য কিছুর সংযুক্তি বুঝায়, যা হলো মিলন বা সম্মিলন, এবং সেটা কল্যাণের উদ্দেশ্যে। সাহিত্যের সূচনাই হয়েছিলো মানূষের কল্যাণের উদ্দেশ্যে। আজ থেকে শত হাজার বছর আগেও মানুষ সাহিত্য চর্চা করেছে। যখন কাগজে লেখা পড়া ছিলো কল্পনাতীত তখনও হয়েছে সাহিত্য চর্চা।  বই আকারে সাহিত্য যখন মানুষের দোরগোড়ায় আসেনি তখন মানুষ গিয়েছে সাহিত্যের কাছে। দিন ক্ষণ ঠিক করে আসর বসিয়ে উপস্থাপন করেছে যে যার রচনা। ব্যক্ত করেছে তাদের চিন্তা, স্বপ্ন ও আশা। শুনিয়েছে নিরাশার কাহিনী। গেয়েছে স্রষ্টার জন্যে স্তুতি।  আর কান তা পেতে শুনেছে শ্রোতা ও দর্শকরা। সাহিত্যের আছে এমন সব গৌরব গাঁথা অতীত, যা এখনও আমাদের বিমোহিত করে। কালক্রমে বদলেছে সমাজ, মানুষের রুচি, শিক্ষার ধরন, বদলেছে মানুষের জীবন ব্যবস্থাও। ভাষায় যোগ হয়েছে নতুন কিছু, বিলুপ্তও হয়েছে অনেক শব্দ। যদিও মানব জীবনের মৌলিক বোধ বিষয়গুলো থেকে গেছে একই, যা অপরিবর্তনীয়। মানুষের সুখানুভূতি, দুঃখবোধ, চাওয়া পাওয়া, জন্ম মৃত্যুসহ অনেক কিছুকে ঘিরেই আজও মানুষ বাঁচে, যা কিছু আজও মিশে আছে জীবনের অস্তিত্বে, যা বলা চলে চিরন্তন । সাহিত্য আসলে এই অস্তিত্বেরই আরেক রূপরেখা। আমি জানি না সাহিত্যকে কে কি ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন বা করেন।

আমার মতে, সাহিত্য হলো- হিতাদ্দেশ্যেশৈল্পিক লেখনীর মাধ্যমে জীবনের আনন্দ ও কষ্টের অনুভূতি, পার্থিব বা আধ্যাত্মিক মনন চেতনায় সৌন্দর্য যোগে বার্তা উপস্থাপন। যা কলাণ্যের উদ্দেশ্যে জীবনের আলো- অন্ধকার, ন্যায়-অন্যায় বা সারল্য ও কাঠিন্যের স্বরূপকে মানব সমাজে সংসর্গ ঘটায়।  আর এই সংসর্গের কাজটি যিনি করেন, তিনিই হলেন সাহিত্যিক।

মঙ্গল উদ্দেশ্যে একজন সাহিত্যিক তার মনে ছুঁয়ে যাওয়া বিষয়টি সম্পর্কে আপন ভাব আবেগের কারুকার্যে ভাবনা বোধকে প্রকাশ করেন। সাহিত্যিক হতে উল্লেখ করার মতো বাঁধাধরা কোনো নিয়ম নেই। তেমনিভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠিরও প্রয়োজন হয় না । তবু নির্দিষ্ট কিছু গুণ তো থাকা চাই। যে গুণগুলো তাকে সাহিত্যিক হিসেবে করবে সুযোগ্য, মানুষ হিসেবে মর্যাদাশীল, জ্ঞানী হিসেবে উন্নত।

নৈতিক বোধে অলিখিত দাবী কিংবা সভ্য পাঠকের আকাঙ্ক্ষা যা-ই বলি না কেন,  তিনি হবেন স্বচ্ছ্ব চিন্তাশক্তি সম্পন্ন একজন ভাব-আবেগী জ্ঞানী মানুষ। যার মাঝে বাস করবে আরেকজন সৃজনশীল সৎ মানুষ। যার কাছে নাম যশ কিংবা অর্থার্জনের আগে স্থান পায় নৈতিকতা এবং কল্যাণকামীতা, তিনিই হলেন সত্যিকারের হিতকর সাহিত্যিক।

আরও পড়ুন-

ইউরোপ-আমেরিকায় বাংলাদেশী নারীর হিজাব বিপ্লব

সাহিত্য সম্পর্কিত সামগ্রিক যে কোনো বিষয় বুঝাতে বলা হয় সাহিত্যজগত।  সাহিত্যের সাথে আরেকটি শব্দ এসে যায় তা হলো শিল্প। শিল্পের সাথে সাহিত্য যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাব্যিক কথায় সুর দিলে তা হয়ে যায় গান। অভিনয়ে গল্প নেয় নাট্যরূপ। চিত্রকরের পটের ছবিটার মাঝেও রঙের পরতে পরতে ঢাকা থাকে সাহিত্যময় কোনো একটি গল্প। শাখা প্রশাখার সংযোগে সাহিত্য একটা বিশাল জগতই বটে! এ জগতটা এতোই বড় যে এক জীবনে এর সব  দিক দিগন্তে দক্ষতার সাথে বিচরণ করা বেশ কঠিন। আর যারা এ কাজটি করতে পারেন, তারা নিঃসন্দেহে উচ্চ যোগ্যতার গুণীজন। একজন লেখক সাহিত্যিক রূপে আসলে চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো সুখ-দুঃখানুভূতির যাপিত জীবনের প্রতিনিধিত্ব করেন। যিনি নিজের মানের মাধুরী মিশিয়ে অন্যের কাছে তুলে ধরেন চার পাশে তার দেখা, শোনা এবং বুঝাকে। সেই সাথে তার লেখনী চিত্রে ভেসে উঠে তার শিক্ষা, রুচি, সততা বা নৈতিকতা।

সাহিত্য হলো সেই মাধ্যম যা বহন করে জ্ঞান, বোধশক্তি, সচেতনতা, আনন্দ বা বিনোদনের মতো কল্যাণকর বিষয় গুলি। মানুষের জীবনে অপরিহার্য একটি দিক হলো খাদ্য। সাহিত্যকে সেই খাদ্যের সাথে তুলনা করা যায়। একজন মানুষ যেভাবে পুষ্টিসমৃদ্ধ  খাবার গ্রহন করে সুস্বাস্থের অধিকারী হন এবং অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করে নিজের ক্ষতি করে, তেমনি সুশিক্ষনীয় বা রুচিশীল সাহিত্য মানুষকে জ্ঞানে, সচেতনতায়, উন্নত বোধশক্তিতে সমৃদ্ধ করে। আনন্দিত সুখী পরিবেষে মানুষ লাভ করে সুস্থ বিনোদন। সাহিত্যের প্রতিটি লেখা হোক তা কবিতা, গল্প, উপন্যাস বা প্রবন্ধ, তাতে থাকে নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু যা লেখক, সাহিত্যিকগণ বার্তা হিসেবে প্রেরণ করেন এবং পাঠকরা তা গ্রহণ করেন (লেখকের ভাব আবেগ সহকারে)। পাঠক প্রভাবিত হন লেখকের চিন্তা চেতনায়, সমৃদ্ধ করেন নিজেকে সে ভাব ধারার জ্ঞানে। আমরা এদিকে নিজেদের ভাগ্যবান বলতে পারি। কারণ, আমাদের আছে এমন সব গুণী লেখক যারা আমাদের সমাজকে জ্ঞানে করেছেন শৌর্যশালী, সুস্থ বিনোদনে করেছেন সমৃদ্ধ। তাদের মাঝে অনেকে সময় মতো হয়তো যথার্থ মূল্যায়ন পাননি। পদবী, ক্ষমতা আর সহযোগিতার অভাবে কদর হয়নি তাদের যোগ্যতার, তাদের নৈতিক চেতনার। অনেকে হয়তো পূর্ণ যোগ্যতা থাকার পরেও প্রমাণ করতে পারেননি নিজেকে। তবে প্রচার প্রসার না থাকলেও তাদের অনেকে অবশ্যই সাহসী, সম্মানীত এবং উঁচু মানের সাহিত্যিক। কোটি পাঠক হয়তো তাদের নেই এবং যারা আছে তারা ঠিক জানে এবং বুঝে ওঁরা কতোটা উপকারী ও উঁচু মানের সাহিত্যিক। আবার এমন অনেক লেখকও আছেন, যারা আধুনিকতা, মুক্তমনা, সংস্কারমুক্ত, প্রগতি, চেতনার ছদ্মবেশে অশ্লীলতা আর উগ্রতার প্রসারণ করে চলেছেন। হতে পারে তাদের লক্ষ-কোটি পাঠক, তাদের বই বাজারে এলেই শেষ হয়ে যায়, প্রকাশক বই বের করে পাঠক চাহিদা মেটাতে পারেন না। প্রচার প্রসার, আর্থিক সচ্ছলতা, পাঠক সৃষ্টির ক্ষমতায় তারা যোগ্যবান। সফল যোগ্যবান এবং ভাগ্যবান লেখক। কিন্তু নৈতিকতায়, সততায় এতোটা সুযোগ্য কি? আদর্শ বোধশক্তি সম্পন্ন উপকারী জ্ঞান সন্ধানী সচেতন পাঠকরা সেই অখ্যাত সাহিত্যিকদেরই কদর করেছেন, করেন এবং করবেন।

লেখকঃ  গল্পকার ও কলাম লেখক, লস এঞ্জেলেস, ইউএসএ

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-

[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১) ।

মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে।  আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।

আরও পড়ুন