Ads

একাত্তরের যুদ্ধশিশুরা কোথায়?

এইচ বি রিতা

আজকের নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস জানে না—বক্তব্যটি খুব সাধারণ। অনেক সময় আমাদের অভিযুক্ত করা হয় এই বলে যে, আমরা সন্তানদের সঙ্গে বাংলাদেশের জন্ম-পূর্ব ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করি না। সত্যি বলতে, আজকের প্রজন্মের সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখি, তাঁরা আমাদের থেকে আরও বেশি জানে এবং গবেষণামূলক এমন সব তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে যে, নিজেই বোকা বনে যাই। জবাব দিতে  পারি না।

প্রতি বছর ডিসেম্বর এলেই মনটাতে অন্যরকম শিহরণ জাগে। মিডিয়ার বদৌলতে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে আপ্লুত হই। যুদ্ধ দেখিনি, তবু মনে হয় যেন আমিই সেই যোদ্ধা। যা হোক, প্রতিবারের মতো এবারও সেই একাত্তরের ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনা করছিলাম ছেলের সঙ্গে। লক্ষ্য করলাম, বড়জনের এসব শোনার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু ছোটটা আলোচনার একপর্যায়ে প্রশ্ন করে বসল, ‘হোয়াট অ্যাবাউট দোজ ওয়ার চিলড্রেন মাম? হয়্যার আর দে নাউ?’ একটু বিব্রত হলাম। যুদ্ধশিশুদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে বর্ণনা করতে গেলে ছেলে হয়তো হতাশ হয়ে পড়বে। এ দেশে জন্মানো ও বেড়ে ওঠা বাচ্চারা একটু বেশিই মানবিক চেতনায় আবেগী হয়। বললাম, ‘লেটস্ ফোকাস ‌অন সেভেন্টি ওয়ান নাউ!’ এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু মনে প্রশ্নটি থেকেই গেল—সেই যুদ্ধশিশুরা কোথায়?

স্বাধীন বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের ইতিহাসে যতগুলো বর্বর ঘটনা ঘটেছিল, তার মধ্যে অন্যতম ভয়াবহ ঘটনা ছিল—ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া শিশুরা। আমাদের যুদ্ধশিশুরা।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধকালে বাংলাদেশে আনুমানিক ২ থেকে চার লাখ নারী শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক গর্ভাবস্থা ইত্যাদি নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। আট বছর বয়সের শিশুটি থেকে বৃদ্ধ নারীদের কাউকেই ছাড়েনি তারা। এর পরিণামে অনিচ্ছার গর্ভ ধারণ করতে হয় সেসব নারীকে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে অভিহিত এই বিশাল অপরাধের পরিণতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও হতবাক করেছিল।

দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীন হলো না নির্যাতিত এই নারীরা। তাঁরা তখন গর্ভে পাকিস্তানি সেনাদের নিপীড়নের চিহ্ন নিয়ে মহা সংকটে। বাংলাদেশ সরকার তাঁদের শনাক্তসহ নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার লক্ষ্যে কর্মসূচি গ্রহণ করে। ১৯৭২ সালে বীরাঙ্গনাদের জন্য সরকার গর্ভপাত ও যুদ্ধশিশুদের দত্তক দেওয়ার আইন প্রণয়ন করে। সেই অনুযায়ী অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া হলো। বিভিন্ন তথ্যসূত্র অনুযায়ী, এই কাজে অস্ট্রেলিয়ার শল্য চিকিৎসক ডা. জিওফ্রে ডেভিস বাংলাদেশে আসেন। গর্ভপাত করান। দেশ থেকে ফিরে তিনি বলেছিলেন, ১ লাখ ৭০ হাজার গর্ভপাত করিয়েছেন তিনি। তাঁর হিসাবমতে, ২ লাখ নারী অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন। বাকি ত্রিশ হাজারের মধ্যে কিছু নারী আত্মহত্যা করেছিলেন। কিছু সাহসী নারী সেই অনাকাঙ্ক্ষিত নাড়িছেঁড়া ধনটিকে নিজেই লালন করার দুঃসাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

এই গর্ভপাতের বাইরে থাকা নারীরা সমাজের চোখে পুরোপুরি অস্পৃশ্য হয়ে ওঠেন। অনেককেই স্বামীর হাতে খুন হতে হয়েছে; অনেকে আত্মহত্যা করেছেন। অনেকেই নিজেকে বাঁচাতে নিজেরাই আধা-পাকিস্তানি শিশুদের হত্যা করেছেন। কেউ কেউ আর ঘরেই ফিরতে পারেননি।

ছেলের প্রশ্নে আজ বিচলিত হই। ভাবি, সত্যিই তো! যুদ্ধশিশুরা আজ কোথায়? কী হয়েছে তাঁদের? কী হবে তাঁদের? নতুন প্রজন্মকে আমরা যুদ্ধের গল্প শোনাই ঠিকই। কিন্তু সে গল্পে বাদ পড়ে যায় নারী নির্যাতনের কাহিনিগুলো, বাদ পড়ে যায় যুদ্ধশিশুদের আর্তনাদগুলো।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সম্মান জানাতে আশ্রয়হীন বীরাঙ্গনাদের পিতার পরিচয়ের জায়গায় নিজের নাম বসিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বীরাঙ্গনাদের গর্ভের যুদ্ধশিশুটির নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারেনি বাংলাদেশ। তাদের নিরাপদ আশ্রয় দিতে এগিয়ে এসেছিল কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশ। কানাডার দত্তক-বিষয়ক সংগঠন ‘ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন’ ও ‘কুয়ান-ইন ফাউন্ডেশন’ দত্তক গ্রহণের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেওয়া শুরু হয়। দত্তকের বেলায় মাদার তেরেসা ও তাঁর মিশনারিজ অব চ্যারিটির সহকর্মীদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ছিল অকল্পনীয় ও প্রশংসনীয়।

সেই ৪৯ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত যুদ্ধশিশুরা আজ কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নাড়ির টানে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তাঁরা নিজ জন্মদাত্রী মাকে খোঁজেন। খুঁজে খুঁজে হয়রান হন। মাকে আর পাওয়া হয় না। কেমন অনুভূতি হয় তাঁদের? জন্মের বৃত্তান্ত খুঁজে খুঁজে খুব কষ্ট কি হয় না? মাকে খুঁজে না পাওয়ায় রাগ, ক্ষোভ, হতাশা কি তাঁদের কাবু করে না? হ্যাঁ, করে। তাঁদেরও ব্যথায় বুক ফাটে। আমরা শুধু তাঁদের সে ব্যথা উপলব্ধির প্রয়োজন মনে করি না।

আজ যেসব যুদ্ধশিশু আমাদের সমাজে রয়েছে, তাঁরাও নানাভাবে অবহেলিত, নির্যাতিত। সমাজ তাদের এখনো গ্রহণ করেনি; দেয়নি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। তাঁরা এখনো সমাজের ভয়, দ্বন্দ্ব ও আক্রমণের শিকার। তাঁরা মাথা উঁচু করে বলতে পারেন না—‘আমরা গর্বিত বীরাঙ্গনা মায়ের সন্তান বলে।’

বিজয়ের মাসে আমরা লাল-সবুজের পতাকা হাতে উল্লাস করি। এই দিনে বাংলার যুদ্ধশিশুরা কি মুখ ঢেকে রাখেন লজ্জায়? কে জানে? কারণ, বহু বছর পর বীরাঙ্গনাদের জন্য কিছু সুবিধা ও সম্মানের আয়োজন করা হলেও যুদ্ধশিশুরা রয়ে গেছেন ইতিহাসের আঁধারে। যুদ্ধশিশুদের নিয়ে আমাদের কোনো শোক নেই, নেই কোনো উদ্‌যাপন বা আয়োজন। সত্যি বলতে তাঁদের নিয়ে তেমন কোনো সঠিক তথ্য বা পরিসংখ্যানও নেই।

অথচ যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা যে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন আমাদের নারীরা এবং তার ফলে যেসব যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়েছিল, তাঁদের পারিবারিক, সামাজিক নিরাপত্তা ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ হতে পারত আমাদের ইতিহাসের এক বড় তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়।

লেখকঃ শিক্ষক, সাংবাদিক, কলামিষ্ট, সাহিত্যিক

আরও পড়ুন