আশরাফ আল দীন
করোনাকালীন বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে নিম্নমধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে আমি নিজের অভিপ্রায় বর্ণনা করেছিলাম যে, এবার আমি কুরবানী করবো না। আমি বরং আমার সম্ভাব্য খরচের টাকাটা দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিতরণ করে দেবো। এতে অনেকেই উদ্দীপিত হয়েছেন, কিন্তু কেউ কেউ আমার বক্তব্যকে যেসব ইসলাম বিরোধীরা কুরবানীর বিপক্ষে ‘পশু হত্যার অপবাদ দিয়ে’ অবস্থান নেয় তাদের বক্তব্যের সাথে শামিল করে ফেলেছেন! ব্যাপারটা সেরকম নয়। ইসলামের বিপক্ষে যারা কথা বলে, কুরবানী যারা চিরতরে বন্ধ করে দিতে চায় আমি অত্যন্ত কঠোরভাবে তাদের বিপক্ষে। আমি শুধু এবারকার অবস্থা বিবেচনা করে কথাগুলো বলেছিলাম। আমার কথার বিপরীতে কেউ কেউ আবেগাক্রান্ত হয়ে বলছেন যে, কুরবানীর মতো এবাদতকে রক্ষা করার জন্য যে যেকোন মূল্যেই এবার কুরবানী করতে হবে! এ ধরনের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি আমার কাম্য নয়।
আমি বলেছি, কুরবানীর মতো একটি নফল ইবাদত (যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে এটাকে ‘ওয়াজিব’ বলা হয়, কিন্তু এটা ফরজ নয়) ইচ্ছে করলে আমরা এ বছর বাদ দিতে পারি। বিশ্বের গ্রান্ড মুফতিরা ফতোয়া দিয়েছেন যে, “সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কেউ কুরবানী না করলে গুনাহ হবে না।” সেজন্যই আমি এ কথাগুলো বলেছিলাম।
তারপরও যদি কেউ মনে করেন কুরবানী দিতেই হবে, আপনি দিন। এতে আপনার অনেক সওয়াব হবে সন্দেহ নেই, কিন্তু অনুরোধ করছি, কুরবানীর পশুর পেছনে যেখানে অল্প টাকা খরচ করলেই চলে সেখানে আপনি লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করবেন না, প্লিজ। যদি মনে করেন, “মানুষ এতে কি বলবে?”, অথবা “সমাজে কিভাবে মুখ দেখাবো যে ছোট একটা পশু কোরবানি দিলাম!” তাহলে স্পষ্ট কথা জেনে রাখুনঃ আপনার কুরবানী আল্লাহর উদ্দেশ্যে হচ্ছে না। এতে আপনি বিন্দুমাত্র সওয়াব পাবেন না, কারণ আপনি মানুষকে দেখাতে চান এবং তাদের প্রশংসা চান, আল্লাহর সন্তুষ্টি আপনার উদ্দেশ্য নয়।
কুরবানীদাতা হিসেবে, আপনার যথেষ্ট অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা আছে বলেই আপনার উচিত হবে এখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে মানুষকে সাহায্য করা। এবারের প্রেক্ষিতে অন্ততঃ, ছোট একটি পশু দিয়ে আপনার পরিবারের কুরবানী দিন। এখন আমরা জেনেছি যে, নামে নামে কুরবানীর প্রয়োজন নেই। আল্লাহ রাসুলের দঃ সুন্নত অনুসরণ করে সমগ্র পরিবারের পক্ষ থেকে একটি পশু কুরবানী করুন। ছোট একটি পশু যত কম দামে করা যায়! বাকি অর্থ আল্লাহর ওয়াস্তে বিতরণ করে অভাবী মানুষকে সাহায্য করুন।
মানুষের এখন কাজ নেই, চাকরি নেই এবং অনেক চাকরিজীবী গত চার-পাঁচ মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। আগামী মাসগুলোতে বেতন পাবেন সেই সম্ভাবনা অনেকের নেই। অনেককে ছাঁটাই করা হয়েছে, এই দুর্যোগের মধ্যেই! তারা এখন কীভাবে পরিবার চালাবেন নিজেরাই জানেন না। তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। সুতরাং আপনি বিবেচনা করুন কিভাবে সাহায্য করবেন। আমি বলছি না, কুরবানীর বদলে দান-খয়রাত করতে অথবা কুরবানীর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতকে বন্ধ করে দিয়ে দান-খয়রাত করার প্রথা চালু করতে। ইসলাম বিরোধীরা এ ধরনের কথা বলে। আমরা তা বলছিনা। শুধুমাত্র এই বছরের জন্য আপনাকে সংযমী হতে বলছি।
আবার বলছি, যারা কুরবানী দেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তারাও কম পয়সায় একটি পশু কুরবানী দিয়ে, মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসুন। এটা ইসলামের দাবি। মানুষের প্রাণ বাঁচানো প্রয়োজন। মানুষের কষ্টকর অবস্থাকে আমরা খোদাভীরু মুসলমানদের এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তাহলে কাজটা সঠিক হবে না।
আমাদের মধ্যে যারা কুরবানী দেয়ার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তাদের, আলহামদুলিল্লাহ, যথেষ্ট সামর্থ আছে এবং এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, আমাদের কেউই উপোস করে থাকার, না খেয়ে রাত কাটানোর ও দিন কাটানোর কষ্ট যে কি তা হয়তো জীবনে একবারও অনুভব করিনি। বর্তমান দুর্যোগপূর্ণ সময়ে অনেক ভদ্র পরিবারকেও আধাপেট খেয়ে অথবা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। তাদের জন্য সাহায্য নিতান্তই প্রয়োজন। সরকারের পক্ষে এদের দেখাশোনা করা সম্ভব নয়। আমাদেরকেই জনে-জনে এগিয়ে আসতে হবে মানুষকে সাহায্য করার জন্য।
তাই, আসুন ‘কুরবানীর মতো এবাদত বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে’ অথবা ‘কুরবানীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে’ এই ধরনের ধোঁয়াশাপূর্ণ কথাবার্তা না বলে যারা কুরবানী দিচ্ছেন তারাও ছোট একটা পশু সমগ্র পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী দিয়ে সীমিত সম্পদের মধ্যে মানুষকে দানের অর্থের ব্যবস্থা করে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করি। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দিন বিষয়গুলোকে বিতর্কমুক্ত রেখে সহজ ভাবে বুঝার এবং অভাবী মানুষের দুঃখ অনুভব করার।
মিরপুর ঢাকা ০৯/০৭/২০২০
লেখকঃ সাহিত্যিক, কলামিস্ট এবং উপদেষ্টা, পলিসি রিসার্স সেন্টার