Ads

প্রতারণার জালে বেষ্টিত নাগরিক জীবন

এস এম মুকুল

রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম মূলত আমাদের কি শিক্ষা দিলো?  সে তার বহুরূপী কর্মতৎপরতা দিয়ে প্রমাণ করেছে- সে একজন সুদক্ষ মেধাবি। তার বিদ্যাবুদ্ধিও কাছে বাকি সব ফেল। যদি তা-ই না হবে, তাহলে এত বছর ধরেও সে জালিয়াতি, আর প্রতারণার মাধ্যমে এতসব অপকর্ম করেও পার পেয়ে যায় কিভাবে? চাতুরিপনা আর চমক যোগ্যতায় তার কাছে বিদগ্ধ রাজনীতিবিদ, পুরখাওয়া আমলা কিংবা তুখোর সাংবাদিকও যেন কিছুই না। সে প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছে যে, একজন সাহেদকে নিয়ন্ত্রণ করতে রাজনীতিবিদ, আমলা, আইন শৃঙ্খলাবাহিনী চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে অথবা সবাই তার সকল বিষয়ে অবহিত ছিলো। রহস্যজনক কারণে সবার নীরবতার সুবাদে সাহেদেও এমন ব্যাপকতর উত্থান। অবশ্য শেষ চালে ধরা খেলেও এইা যাত্রায় সে পার পেয়ে যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি ।

বাংলাদেশে সাহেদ নতুন কিছু নয়। পাপিয়া, পাপলু, সম্রাট, জিকে শামীম, আর খালেদদেও প্রতারণার কথা জাতি এখনো হয়তো ভুলে যায়নি। প্রতারণাই যেন এ দেশটির পুজিবাদেও মোক্ষম হাতিয়াওে পরিণত হয়েছে। প্রতারণার জালে বেষ্টিত আমাদেরও এই নাগরিক জীবন। চলতে-ফিরতে, উঠতে-বসতে আমরা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছি।

ইসলামে প্রতারণা বা ধোকা দেওয়া হারাম। প্রতারণা করলে শুধু গোনাহ হয় তা কিন্তু নয়, প্রতারক ব্যক্তিকে উম্মত হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন না বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকও প্রতারণার প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে।  ফেসবুককে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে অনেক একশ্রেণির প্রতারক চক্র। তারা নানান কৌশলে  ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বোকা বানিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, ফেসবুক স্ক্যাম বা প্রতারণা অনেকে বেড়ে গেছে। করোনা পরিস্থিতিতে মাস্ক, পিপিই, প্লাভসসহ অন্যসব হাইজিন পণ্যের চাহিদা বেশি থাকায় এসব পণ্যেও ক্ষেত্রে প্রতারণা বেশি হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ। বাগানের টাটকা আম, পদ্মার ইলিশ, ঘানিভাঙ্গা সরিষার তৈল এমনসব আকর্ষনীয় অরিজিনের কথা বলে ঠকানো হচ্ছে ক্রেতা সাধারণকে। অফারের নামে মেয়দোত্তীর্ণ পণ্য, কোনো ক্ষেত্রে দাম বাড়িয়ে বিশেষ ছাড়ের অফার দিতে প্রতারণা চলছে ক্রেতাদেরও সাথে। মোড়কিত পণ্যেও ওজনে কম দিয়ে, মানসম্মত জিনিস না দিয়ে প্রতারণা করা হচ্ছে। আপনার কাছ থেকে প্রতিটি পণ্যেও জন্য ভ্যাট আদায় কওে সরকারের কাছে তদাচিত ভ্যাট পরিশোধ না করেও প্রতারণা করা হচ্ছে। চলছে শিক্ষার নামে প্রতারণা। স্বাস্থ্যসেবার নামে প্রতারণা। প্রতারণার ক্ষেত্র আর রকমের যেন শেষ নেই। এইসব প্রতারণার ফাঁদে নাগরিক জীবন এখন আর অতিষ্ট নয়- বরং অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। করোনার সাথে যেমন আমরা মানিয়ে নিয়ে চলতে বাধ্য হচ্ছি, একইভাবে হাজারো প্রতারণার ফাঁদে  পড়া এই নাগরিক জীবন চলতেও আমরা বাধ্য হচ্ছি।

চাকরি  দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে  বেকার যুবকদের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। বিদেশ পাঠানোর নামে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।  দেশব্যাপী সাধারণ মানুষ ডিজিটাল প্রতারণার ভয়ঙ্কর ফাঁদে পড়ে সর্বশান্ত হচ্ছেন। ইন্টারনেট অশ্লীল লিংক ছড়িয়ে ব্যবহারকারীকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।  ফেসবুক বা ই-মেইল আইডি হ্যাক করে অর্থ দাবি করা হচ্ছে।  মোবাইলে লটারি জেতার কথা বলে বিকাশের মাধ্যমে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। এভাবে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা হাজারো ফাঁদ  পেতে অতিষ্ট করে তুলছে নাগরিক জীবন। দাম্পত্য জীবনে প্রিয় সঙ্গীর সঙ্গে প্রারণার আশ্রয় নিচ্ছে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্কগুলো রক্ষা পাচ্ছে না প্রতারণার ফাঁদ থেকে।

কথা হচ্ছে, জালিয়াতি, স্ক্যাম কিংবা প্রতারণা এই কোনটাই আমাদের কাছে নতুন কোন শব্দ নয়। রিয়েল এস্টেট সেক্টরে এইসব শব্দের সম্মুখীন হতে হচ্ছে অনেক গ্রাহককে। একটি প্লট কতজনের কাছে বিক্রি হচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই। অথবা যেখানে প্লট বুকিং নিচ্ছে সেখানে তাদের জমিই নেই। অথবা যে পরিমাণ প্লট বুকিং হচ্ছে সে পরিমাণ জমি নেই সেখানে। বাংলাদেশের রিয়েল এস্টেট সেক্টর এখন বিশাল এক মুনাফা খাত। অভিযোগ আছে, সাধারণ গ্রাহকেরা এই রিয়েল এস্টেট স্ক্যামারদের ফাঁদে পড়ে জীবনের শেষ সম্বল হারাচ্ছে। অনেকে ফ্ল্যাট বা প্লটের সকল কিস্তি পরিশোধ করার পরও যথা সময়ে তাদের প্লট বা ফ্ল্যাট বুঝে পাচ্ছেন না। এভাবে একজন মানুষের  সারাজীবনের সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়ছে। দেখা যাচ্ছে যে, ল্যান্ড বা এপার্টমেন্ট ব্যবসায়ীদের লোভনীয় অফার দেখে মানুষ কিছু না ভেবেই সাধারণ মানুষ এধরণের ফাঁদে পড়ে যায়।  প্রকৃত অর্থে এই রিয়েল এস্টেট বিজনেসের রিয়েলিটি নিয়েও প্রশ্ন আছে।

দেশে অনলাইনে বিভিন্ন অফার ও সুবিধা দিয়ে পণ্য বিক্রির কথা বলেও আগাম টাকা নিয়েও মালামাল পরিশোধ করা হচ্ছে না এমন অভিযোগ আছে। আবার অনলাইনে যে ধরণের পণ্য বা যে মানের পণ্য দেখানো হচ্ছে ঠিক সেই মানের পণ্য গ্রাহকরা বুঝে পাচ্ছেন না বলেও অনেক অভিযোগ আছে।  এভাবে প্রতারণা করা হচ্ছে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের সাথে।

ডা. সাবরিনা, চেয়ারম্যান জেকেজি হেলথ কেয়ার। একজন চিকিৎসকের এমন প্রতারণার কথা ভাবতে পারেন। অথচ এটা নতুন কিছু নয়। সাবরিনা চিকিৎসক হয়ে প্রতারণা করেছেন। আবার ভুয়া চিকিৎসকও জনগণের সরলতার সাথে প্রতারণা করছেন। করানোর মহামারীর এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে সমগ্র বাংলাদেশে চলছে গুজব, হয়রানি ও প্রতারণার নতুন সংস্কৃতি। করোনার বিস্তার ও চিকিৎসা নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক থাকায় পরিপ্রেক্ষিতে কিছু শিক্ষিত-অশিক্ষিত সুবিধাভোগী মানুষ ইতিমধ্যে গুজব ছড়িয়ে মানুষের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে। এভাবে সমসাময়িক বিশ্বের সবখানেই আর্থিক প্রারণাসহ বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতি নিয়ে সাম্প্রতিক কালে গবেষকদের মধ্যে বেশ আগ্রহ জাগিয়েছে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের বিষয়টি।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়েই উঠে এসেছে নানা খাতে বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতির তথ্য। সাম্প্রতিক কালে মহামারীর মধ্যেও স্বাস্থ্য খাতের নানা জালিয়াতি-দুর্নীতি সারাদেশেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের প্রতারণা-লুটপাট থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত নামি ওষুধবিক্রেতা চেইন শপের লেবেল জালিয়াতির মাধ্যমে অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। নির্মাণকাজে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহারের মতো জালিয়াতির খবর দুঃখজনক হলেও বিনোদনের খোড়াক হয়েছে।

অতিশয় দুঃখজনক হলেও সত্যি- নভেল করোনাভাইরাসের চলমান সংক্রমণ পরিস্থিতিতে এসব জালিয়াতি ও প্রতারণার মাত্রা যেন নতুন রূপ পেয়েছে বাংলাদেশে।  জেকেজি হেলথকেয়ার ও রিজেন্ট হাসপাতাল নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ কেবল দেশে নয়, বিদেশেও আমাদের প্রতি অনাস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। প্রাতারণার মাধ্যমে মুনাফা বা পুজি বর্ধনের প্রবণতাকে বাংলাদেশে ব্যাপকতর রূপ নিচ্ছে। এর প্রধান কারণ, দেশে অপরাধের তাৎক্ষনিক বা দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি হয় না। কোনো সেক্টরেই যথাযথ মনিটরিং নেই। রাষ্ট্র যন্ত্রের সর্বস্তরে প্রতারকদের অবস্থান নেওয়াও সুযোগও একটি বড় কারণ। তা না হলে কী করে রিজেন্টের সাহেদের এত বড় উত্থান হয়। গবেষকদের ভাষায়, জালিয়াতি শুধু অর্থনৈতিক নয়, একই সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। এটি যতটা অর্থনৈতিক বিষয়, ততটাই সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিষয়। তাহলে প্রশ্ন এসে যায় এইসব প্রতারণা, জাল-জালিয়াতির জন্য দায়ী কে? বাংলাদেশে প্রতারণার মাধ্যমে মুনাফার প্রবণতার পেছনে আসলে আমাদের সিস্টেমই দায়ী। কারণ এখানে প্রতারণা ও কারসাজির মাধ্যমে দুর্নীতি করা হয়ে থাকে। এইতো কিছুদিন আগে, মহামারী শুরুর আগে দেশের গণমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি চর্চিত বিষয়গুলোর অন্যতম ছিল আর্থিক খাতের নানা জালিয়াতি-দুর্নীতি। একথা এখন সবাই জানে, ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে একের পর এক আর্থিক জালিয়াতি ও কেলেঙ্কারির ঘটনা। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে ব্যবসায়িক ব্যর্থতা নয়, আত্মসাতের উদ্দেশ্য থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমেই ঘটানো হয়েছে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতের এসব বড় বড় কেলেঙ্কারি। ক্রিসেন্ট গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ খেলাপের পরিমাণ সোয়া ৪ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। গ্রুপটির বিরুদ্ধে চামড়ার ভুয়া রফতানি বিল তৈরি করে সরকারের কাছ থেকে নগদ সহায়তা নেয়ার পাশাপাশি রফতানির অর্থ ফেরত না আনার অভিযোগও রয়েছে। তারও আগে হলমার্ক  গ্রুপের আলোচিত সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার ধাক্কা এখনো সামলাতে পারেনি রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। এসবের বিচার না হওয়া আর বিচারের নামে ধীরগতির প্রহসনের কারণে জনগণের ভোগান্তির আর শেষ হবে না। আর একারণেই প্রতারণার জালে বেষ্টিত এই নাগরিক জীবন কেবল প্রতারিতই হবে ক্ষণে ক্ষণে, জনে জনে।

লেখকঃ  সমাজ বিশ্লেষক ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন