।। ড. মো. নূরুল আমিন ।।
জনপ্রিয় ওয়ায়েজ, উঠতি বাগ্মী, যুব আলেমদের অহংকার বলে অনেকের কাছে স্বীকৃত হেফাজত নেতা আল্লামা মামুনুল হকের কিছু বক্তব্য আমাকে বিমোহিত করেছে। সম্প্রতি মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর সাথে ঐক্য প্রতিষ্ঠার কথা বলতে গিয়ে তিনি খুব মূল্যবান কয়েকটি কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা যারা এক কালেমায় বিশ্বাস করি, আল্লাহর কুরআন ও তার রাসুল (সা.)কে আখেরী নবী মানি এবং তার আদর্শ অনুসরণ করি, আমরা কোন্ দল করি তা মুখ্য নয় বরং ইসলাম বৈরী শক্তির মোকাবিলা এবং আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে একই পতাকার নিচে সমবেত হওয়া উচিত। ঐক্য প্রতিষ্ঠার অতীত কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি বলেছেন যে, ইখতিলাফ ইসলামে একটি স্বীকৃত বিষয়। উপমহাদেশসহ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক দেশেই জামায়াত, ইখওয়ান, সালাফী, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত, বেরেলভী এমনকী শিয়া মতাবলম্বীদের নিয়েও মুসলিম জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দ্বীনের খেদমত করেছেন, এখনও আমরা তা করতে কোন বাধা নেই। তিনি দলমত নির্বিশেষে সকল আলেম সমাজকে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। আল্লামা মামুনুল হক বয়সে কম হলেও ইতোমধ্যে তার চাল চলন, বক্তৃতা বিবৃতি, জ্ঞানান্বেষণ তর্কবিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রচুর প্রতিভা ও পরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছেন। তার পিতা শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকও সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন হক্কানী আলেম ছিলেন। একজন আলেম হিসেবে সরকারের অনুগত হয়ে না থাকায় তাকে খুনের আসামী বানিয়ে তৎকালীন সরকার এই নিরপরাধ আলেমকে চরমভাবে অপমান করেছিল। আল্লামা মামুনুল হককেও আওয়ামী লীগ সরকার তাকে ব্যাভিচারী বানিয়ে জেলখানার অন্ধ কুঠুরিতে প্রেরণ করে চরম নির্যাতনের শিকার বানিয়েছিল। তিনি তার পিতার কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন। জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামী দলের সাথে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার অবস্থান ও মতামত শ্রদ্ধার যোগ্য।
তবে এ সংক্রান্ত তার বক্তব্যের শেষাংশ কিছু বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে বলে মনে হয়। তিনি এখানে পরিষ্কার করে বলেছেন যে, জামায়াতের সাথে ঐক্যের ব্যাপারে আমরা অনুকূল মত প্রকাশ করলেও দু’টি বিষয়ে জামায়াতকে তার অবস্থান পরিষ্কার করা অপরিহার্য বলে আমি মনে করি। এর একটি হচ্ছে জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর কিছু আকিদা বিশ^াস এবং বইপত্রে নবী রাসুল (সা.)দের নিষ্পাপ নিরাপরাধ হওয়া এবং সাহাবায়ে কেরামদের ভুল ভ্রান্তির ঊর্ধ্বে না থাকা সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক অপরাধ ও মন্তব্য। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ১৯৭১ সালে জামায়াত কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা সংক্রান্ত। এ দু’টি বিষয় জামায়াত যদি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারে এবং ক্ষমা চায় তা হলে আমাদের আর কোনও আপত্তি নেই।
আমি শেষের প্রশ্নটি আগে আনছি। আমার জানা মতে আল্লামা মামুনুল হক সাহেবের জন্ম ১৯৭১ সালে। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ অথবা তার পূর্ববর্তী পাকিস্তানী রাজনীতি সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না, পলাতক আওয়ামী লীগ নেতারা দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে একটি হিংস্র সেনাবাহিনীর মুখে ঠেলে দিয়ে নয় মাস পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় দেশ স্বাধীন করে ক্ষমতায় বসে তাদের মুখে বা তাদের দ্বারা লিখিত সত্য-মিথ্যা ইতিহাস পড়ে যা শুনেছেন তাই বিশ্বাস করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী ২৪ বছরের তরুণ একজন সাংবাদিক হিসেবে ঐ সময়ও তার আগে পরে স্বাধীনতা সংগ্রামের আদ্যপান্ত দেখার আমার সুযোগ হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে আল্লামা মামুনুল হক সাহেবের প্রতি আমার কিছু নসিহত আছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ঊনিশ শতকের ষাট ও সত্তরের দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে সমস্ত ইসলামী দল সক্রিয় ছিল তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ছাড়াও বেশ কিছু মুসলিম জাতীয়তাবাদী দল সক্রিয় ছিল। এদের মধ্যে মুসলিম লীগ (কনভেনশন), মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), মুসলিম লীগ (কাইয়ুম), জাতীয় দল (অলি আহাদ), পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি), কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি) প্রভৃতি ছিল প্রধান। এই দলগুলোর মধ্যে মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলাম পার্টি ক্ষমতায় ছিল। মুসলিম লীগ বিভক্ত হয়ে যাবার পর আইয়ুব খানের নেতৃত্বে কনভেনশান লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকে। অন্যান্য দলগুলো ক্ষমতার তেমন স্বাদ পায়নি। এই দলগুলোর মধ্যে হাজারো বিভেদ বিভক্তি থাকলেও পাকিস্তানের অখ-তার বিষয়ে তাদের সকলের চিন্তাধারা একই ধরনের ছিল। তারা কেউই ভারতীয় রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি। একই অবস্থানে ছিল চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিও। তারা পাকিস্তানে ভারতীয় হস্তক্ষেপকে ভারতীয় আগ্রাসন বলে গণ্য করতেন।
আরও পড়ুন-
অনেকেই জানেন যে, মওলানা ভাসানী এবং অলি আহাদ মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে তাদের বন্দীদশায় থাকতে হয়েছিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে শুধু ইসলামী দল ও মুসলিম জাতীয়তাবাদী দলগুলোই যে অংশগ্রহণ করেননি তা নয় বরং সকল আলেম-ওলামা এবং ইসলামী ব্যক্তিত্বই স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন। এখানে একটি বিস্ময়কর বিষয় ছিল এই যে, যে সমস্ত আলেম রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না, এমনকী ইসলামে রাজনীতি হারাম বলে ঘোষণা করতেন সে ধরনের আলেম, পীর-মাশায়েখও পাকিস্তানের অখ-তার পক্ষে ছিলেন। চরমোনাইর পীর, শর্ষিনার পীর থেকে শুরু করে ফুলতলী পীর মাওলানা আবদুল লতিফ ফুলপুরী (সিলেট), মাওলানা সৈয়দ মোস্তফা আল মাদানী, মাওলানা মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর, মাওলানা মুফতি দীন মোহাম্মদ খান, মাওলানা আনিসুর রহমান, মাওলানা আশ্রাফ আলী, মাওলানা আমিনুল হক (রেডিও/টিভি), মাওলানা মাসুম, মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমী, মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী, মাওলানা আবদুল মান্নান (জমিয়াতুল মোদ্দাররেছীন), মাওলানা সিদ্দিক আহমদ, মাওলানা ইউনুস, আল্লামা মামুনুল হকের পিতা শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হকসহ শত শত আলেম পাকস্তিান ভেঙে ভারতীয় সহায়তায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে ছিলেন। এই আলেম-ওলামাদের মতো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী ছিলেন। এই ধর্মের ধর্মগুরু ও বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের নেতা বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো পাকিস্তানকে ৫ লাখ বৌদ্ধের প্রিয় মাতৃভূমি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজা ও বৌদ্ধ নেতা রাজা ত্রিদিভ রায় পাকিস্তানের মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত হওয়াকে পাকিস্তান ভাঙার তুলনায় অধিকতর প্রাধান্য দিয়েছিলেন। জামায়াতও ভারতীয় আধিপাত্যবাদের আশঙ্কায় অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী ছিল এবং তাদের আশঙ্কা যে সত্য ছিল বাংলাদেশের গত ৫৪ বছরের ইতিহাস ও ভারতীয় আধিপত্যবাদ তার প্রমাণ। কাজেই এ ব্যাপারে মামুনুল হক সাহেবকে ব্যাখ্যা দেয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
এখন মাওলানা মওদূদীর সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত বলে কথিত মামুনুল হক সাহেবের কতিপয় আপত্তি প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা জরুরি বলে মনে করি। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশে ইসলামী অনুশাসনের ভিত্তিতে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী একটি দল এবং দাওয়াতি কার্যক্রম ও শিক্ষা-প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানুষকে ইসলামের চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন করে এই কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাদের সম্পৃক্ত করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। এর জন্য তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে একমাত্র পন্থা বলে মনে করে। গণতন্ত্র রাজনীতির একটি অপরিহার্য অংশ। এই উপমহাদেশে ইসলামকে একটি জীবন ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য সংঘবদ্ধভাবে কাজ করার উদ্দেশে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত হয়। মাওলানা মওদূদী স্বয়ং একজন আলেমে দ্বীন, লেখক ও সাংবাদিক ছিলেন। তার রচিত তাফহিমুল কুরআনসহ অসংখ্য গ্রন্থ দেশে-বিদেশে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের অনুপ্রেরণার উৎস। দলটি ইসলামী সাহিত্যের একটি বিশাল ভাণ্ডারও তৈরি করেছে যা জ্ঞানপিপাসু সকল শ্রেণির মানুষের তৃষ্ণা মিটাতে সহায়তা করছে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর জামায়াত আলাদাভাবে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানে এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে কাজ শুরু করে। দলটির অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য এবং নানা ঘাত প্রতিঘাত ও বিরোধিতার মুখেও বাংলাদেশে জামায়াত তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সমর্থ হয়। আগেই বলেছি দুর্ভাগ্যবশত: আমাদের ধর্মীয় নেতা তথা আলেম উলামাদের একটি অংশ মাওলানা মওদূদীর সাহিত্যের বরাত দিয়ে তার ও জামায়াতের বিরুদ্ধে নানা অপবাদ দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে আসছেন। এই অপবাদগুলোর জবাবও বিভিন্ন সময়ে জামায়াত নেতৃবৃন্দের তরফ থেকে দেয়া হয়েছে। অনেকগুলো অভিযোগ ও জবাব পুস্তকাকারেও পাওয়া যায়। কিন্তু একই অভিযোগের চর্বিত চর্বণ বার বারই পরিলক্ষিত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে সামাজিক মাধ্যমে এর বিস্তৃতি দেখা যায়। এ ব্যাপারে আমাদের কয়েকজন সম্মানিত পীর ও ওলামা মাশায়েখদের কিছু অনুসারীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। জামায়াত এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। তবে এসব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া উপমহাদেশের একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা সম্পর্কে আমরা অনেকেই অবহিত নই। এটি হচ্ছে কুমিল্লা জেলার বরুড়া থানার একটি মামলা। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসার মত বরুড়াতে একটি বিশাল মাদরাসা আছে। এই মাদরাসায় প্রতিবেলা দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার লোকের জন্য রান্না বান্না হয়। মাদরাসাটি প্রাচীন ও সুবিশাল এলাকা নিয়ে অনেকগুলো বহুতল ভবনে সুসজ্জিত। এর শিক্ষকরাও বহুগুণে গুণান্বিত আলেমে দ্বীন।
আরও পড়ুন-
২০০৩ সালে আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম বরুড়া, কুমিল্লা নামক প্রতিষ্ঠানটি আফতাব স্মরণিকা নামে একটি পুস্তক প্রকাশ করে এবং এতে ‘মওদূদী সাহেবের মতবাদ ও ইসমাতুল আম্বিয়া’ শিরোনামে প্রকাশিত দু’টি প্রবন্ধে মাওলানা মওদূদী সাহেবের নামে কিছু আপত্তিকর মন্তব্য উল্লেখ করা হয়। স্মরণিকার ৭০ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়, “মিষ্টার মওদূদী সাহেব বলেন, নবীগণ মাসুম নন, প্রত্যেক নবীই গুনাহ করেছেন (তাফহীমাত, ২য় খন্ড পৃষ্ঠা ৪৩)। স্মরণিকার ৩৫ পৃষ্ঠায় মাওলানা মওদূদী প্রণীত তাজদীদ ও এহইয়ায়ে দ্বীন পুস্তকের ২২ নং পৃষ্ঠার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, তিনি লিখেছেন “হযরত আবুবকর (রা.) খেলাফতের দায়িত্বের অযোগ্য ছিলেন।” এই পৃষ্ঠায় তরজমান রবিউস সানির সংখ্যার ৩৫৭ পৃষ্ঠার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় যে, তিনি বলেছেন, “নবী করিম (সা.) এর ওফাতের সময় ব্যক্তি সম্মানের কুমনোবৃত্তি হযরত ওমর (রা.)কে পরাভূত করেছিল।” আফতাব স্মরণিকার ৩৫ পৃষ্ঠায় আরো বলা হয়েছিল যে, মওদূদী সাহেব তার খেলাফত ও মুলুকিয়াত গ্রন্থের ১২২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “হযরত ওসমানের মধ্যে স্বজনপ্রীতির বদভ্যাস বিদ্যমান ছিল।” স্মরণিকার ৩৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, তাফহিমাত গ্রন্থের ৩১৮ পৃষ্ঠায় মাওলানা মওদূদী মুহাদ্দিসানে কিরাম হাদিস ভুল বলে মন্তব্য করেছেন। এর ৭১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে মাওলানা মওদূদী “হযরত আদম (আ.) মানবিক দুর্বলতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন” বলে মন্তব্য করেছেন। আবার স্মরণিকার ৭০ ও ৭১ পৃষ্ঠায় ‘কোন কোন নবী ও রাসুল দ্বীনের চাহিদার উপর স্থির থাকতে পারেননি’, এবং ‘হযরত নূহ (আ.) এর মধ্যে জাহেলিয়াতের জজবা স্থান পেয়েছিল।’ আবার ‘হযরত দাউদ (আ.) এক বিবাহিতা যুবতীর উপর তালাকের দরখাস্ত করেছিলেন’ প্রভৃতি মন্তব্যও মাওলানা মওদূদীর নামে ছাপা হয়। জামায়াতের তরফ থেকে উপরোক্ত বিষয়ে কোনও প্রতিবাদ করা হয়েছিল কিনা আমি জানি না। তবে বরুড়ার একজন সত্যাশ্রয়ী আলেমে দ্বীন, যিনি জামায়াতের সহযোগী বা সদস্য কিছুই ছিলেন না তিনি এর কঠোর প্রতিবাদ করেন এবং এই অপবাদ ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার কারণে ৮ জনকে আসামী করে কুমিল্লা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা করেন।
মামলা নং-২১৯/০৪। আদালতে বাদী মাওলানা আবদুর রহমান আফতাব স্মরণিকায় মাওলানা মওদূদীর নামে প্রকাশিত তথ্য মিথ্যা বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আখ্যায়িত করে আসামীদের শাস্তি প্রদানের আবেদন করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় তদন্তপূর্বক বিশেষজ্ঞ মতামতসহ রিপোর্ট প্রদানের জন্য অভিযোগ নামাটি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিকট প্রেরণ করেন। ফাউন্ডেশন বাইতুল মুকাররমের ভারপ্রাপ্ত খতিব মুফতি মুহাম্মদ নূরুদ্দীন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফতি মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ, ইসলামী বিশ্বকোষের প্রকাশনা কর্মকর্তা মাওলানা মুহাম্মদ মুসা, মুহাদ্দিস মুফতি ওয়ালিয়ুর রহমান খান, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরস এর সদস্য মাওলানা মুফাজ্জল হোসাইন খান, মুফাসসির মাওলানা আবু সালেহ পাটোয়ারী ও জাতীয় মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি মহিবুল্লাহ বাকী নদভীর সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ টীম গঠন করেন এবং স্মরণিকায় উল্লেখিত অভিযোগ ও মন্তব্যগুলো মাওলানা মওদূদীর পুস্তক সমূহের সাথে মিলিয়ে তার সত্যতার বিষয়ে রিপোর্ট প্রদানের অনুরোধ করেন। রিপোর্টি প্রণয়ন করতে অনেক সময় লেগে যায়। অবশেষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক জনাব সিরাজুল ইসলাম ৯/৬/২০০৮ তারিখে ৭৯৯ নং স্মারকে কুমিল্লার অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জেলা প্রশাসক, কুমিল্লার নিকট সংশ্লিষ্ট সাতজন বিশেষজ্ঞের স্বাক্ষর সম্বলিত তথ্য যাচাই প্রতিবেদন পেশ করেন। প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, স্মরণিকায় মাওলানা মওদূদীর নামে উল্লেখিত প্রত্যেকটি অভিযোগই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। নবী-রাসূল (সা.), খোলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরামের বিরুদ্ধে মাওলানা মওদূদীর কোনো মন্তব্য বা মতামত তার কোনো গ্রন্থে নেই। এই রিপোর্টের পর বিবাদীগণ বিপাকে পড়ে যান এবং আপোস মিমাংসার জন্য বাদী মাওলানা আবদুর রহমান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে ধর্না দেন। তারা আপোষ মিমাংসার জন্য আদালতে আবেদন করেন এবং বিবাদী মাওলানা বশিরুল্লাহ, মো. ইয়াকুব, আনোয়ার হোসাইন, মো. মোয়াজ্জেম হোসাইন, মো. নোমান, সালমান, আলী আশরাফ প্রমুখ আরজীর ২ নং অনুচ্ছেদে ‘আফতাব স্মরণিকার বিতর্কিত উক্তিসমূহ “ভুলবশতঃ লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং এর জন্য বিবাদীগণ মর্মাহত এবং অনুতপ্ত” এই মর্মে স্বীকারোক্তি দেন। আদালত বাদীর সায় অনুযায়ী আপোষনামা গ্রহণ করেন। এই সংক্রান্ত বিস্তারিত দলিল আমি পড়ার সুযোগ পেয়েছি। এই মামলা, ইসলামী ফাউন্ডেশন গঠিত ওলামাদের বিশেষজ্ঞ কমিটি কর্তৃক মাওলানা মওদূদীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো মিথ্যা আখ্যায়িত করে দেয়া রিপোর্ট ও অভিযোগকারীদের ভুল স্বীকার করে মর্মাহত ও অনুতপ্ত হয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি প্রদানের ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অবস্থায় এ ধরনের অভিযোগ থেকে বিরত থাকার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট মহলকে অনুরোধ করছি।
এই মামলা সংক্রান্ত যাবতীয় দলিলপত্র আমি সংরক্ষণ করেছি। আল্লামা মামুনুল হক যদি সেগুলো দেখতে চান তাহলে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। আমি অবশ্য একথা বলতে চাই না যে, আমাদের কিছু কিছু আলেম আছেন যারা সত্যকে জেনে শুনেও তার বিরোধিতা করেন এবং নিরপরাধ ব্যক্তিদের অপরাধী সাজিয়ে নিজেরা বাহবা কুড়াতে চান। তাদের মধ্যে লজ্জাশীলতা আছে বলে আমি মনে করি না।
লেখকঃ প্রাবন্ধিক , গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক , দৈনিক সংগ্রাম
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-
[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১) ।
মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে। আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।