Ads

ইউরোপ-আমেরিকায় বাংলাদেশী নারীর হিজাব বিপ্লব

সালমা সাহলি

ইউরোপ-আমেরিকার হিজাব পরিধানকারী নারী ও কিশোরীরা তাদের সমাজের পরিবারগুলোর চারিত্রিক অবক্ষয়, অবাধ মেলামেশা ও স্বেচ্ছাচারিতার ভয়াবহ পরিণাম থেকে সতর্ক হয়ে অন্যদেরও সতর্ক করছেন। আহ্বান করছেন হিজাবে ও শালীনতায় পবিত্র সফল জীবনের প্রচেষ্টার পথে। মুসলিমদের কাছে হিজাব মর্যাদার প্রতীক। আমেরিকার প্রধান মূলনীতিগুলোর একটি হলো ধর্মীয় স্বাধীনতা। এরপরও ইউরোপ-আমেরিকায় হিজাব পরাটা একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। আর এই চ্যালেঞ্জ থেকে আপনার আমার শেখার আছে অনেক কিছু-

বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত বিষয়ের অন্যতম হিজাব বা পর্দা। পর্দা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি ফরজ বিধান। পোশাক-পরিচ্ছদ লজ্জা নিবারণের উপকরণ হলেও মানবজীবনের অন্যান্য দিকেও এর ভূমিকা পরিব্যাপ্ত। সাজসজ্জা বা সৌন্দর্যবর্ধন থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এর গুরুত্ব ব্যাপক। তবে সব গুরুত্বের প্রধান হলো পর্দা বা হিজাব।

ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বেশকিছু দেশে পর্দা বা হিজাবকে সাধারণত নারীর প্রতি নিপীড়ন ও বৈষম্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। আমাদের সমাজব্যবস্থা থেকে ইউরোপ-আমেরিকার সমাজব্যবস্থা ভিন্নতর। অবাধ স্বাধীনতা, স্বেচ্ছাচারী পরিবেশ, বাবা-মায়ের অবহেলা এবং ভঙ্গুর পারিবারিক অবকাঠামোর মধ্য দিয়ে পারিবারিক ও ধর্মীয় আদর্শহীন হয়ে বড় হয় তারা। এমন পরিবেশে সংখ্যালঘু মুসলিমদের পর্দা বা হিজাব তাদের কাছে নারীদের অবমাননা, নিপীড়ন বা মুসলিম পুরুষদের চাপিয়ে দেওয়া এক অযৌক্তিক নীতি। তাদের কাছে হিজাব খুবই খারাপ একটি পোশাক। এ কারণে অনেক সময় হিজাব পালনকারীকে নানারকম বৈষম্যের শিকার হতে হয়। এসব দেশে সাধারণত হিজাব পরে কর্মস্থলে যাওয়া যায় না। হিজাব পরলে চাকরি হারানোর আশঙ্কা থাকে। এমনকি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পরে যাওয়ার বিধান নেই।

বেশির ভাগ অমুসলিম দেশেই হিজাব পালনকারীদের ভিন্ন চোখে দেখা হয়। গত বছর মিজৌরির এক অধিবাসী যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়ার পরেও চাকরি পাননি হিজাবের কারণে। টেক্সাসে একজন হিজাবি মহিলার হিজাব ধরে টান দিয়েছিল একজন। ম্যকডোনালসে ঢুকতে দেওয়া হয়নি এক হিজাব পরিধানকারী স্টুডেন্টকে। সেন্টামনিকায় একবার আমাকেই একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এ রকম অসংখ্য বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হয় হিজাব পালনকারীদের। আমেরিকা, ইউরোপ এবং বিশ্বের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন অধিদপ্তরসহ অনেক জায়গায় হিজাব নিষিদ্ধ। আবার কোনো স্কুল-কলেজে হিজাব নিষিদ্ধ না হলেও হিজাব পালনকারীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়।

অপমান-অপদস্থ হতে হয় শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ স্টুডেন্টদের কাছে; সম্মুখীন হতে হয় নানা প্রশ্নের। তবে কিছু কিছু লোকের প্রশ্নের কারণ থাকে কৌতূহল বা হিজাব সম্পর্কে সঠিকটা জানার ইচ্ছা। ফ্রান্সসহ আরও কয়েকটি দেশে নিকাব বা হিজাব পরিধানকারীদের জরিমানা দিতে হয়। এসব বিভিন্ন কারণে অনেক পর্দাশীল নারী অস্বস্তিতে ভোগেন। কেউ কেউ ভয় পেয়ে ছেড়ে দেন হিজাব পরা।

ইসলামে পর্দার বিধান, দিকনির্দেশনা, এর গুরুত্ব এবং উপকারিতা সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখে না হিজাববিরোধীরা। হিজাব হলো সেই বিধি ও চেতনা যার মাধ্যমে ঘর থেকে বাইরে, প্রতিষ্ঠান-সমাবেশসহ সমাজ, রাষ্ট্র ও বহির্বিশ্বের সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মাঝে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা, পরপুরুষের সামনে সৌন্দর্য প্রদর্শন ও অবৈধ সংস্পর্শ, এক কথায় সব ধরনের অশ্লীলতা ও অপবিত্রতা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ করা হয় যা পবিত্রতা ও শুদ্ধ চিত্তের মাধুর্য টিকিয়ে রেখে সম্মুখপানে এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে নিরাপদ সোপান।

দুঃখজনক হলেও সত্য, কিছু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের জনপ্রতিনিধি বা ক্ষমতাশীলদের কেউ কেউ পর্দার বিরুদ্ধে কথা বলছেন। তারা কুপ্রথা, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, প্রগতির বাধা, নারীবৈষম্য ইত্যাদি কথা বলে হিজাব তথা আবরু-শালীনতার বিলুপ্তি চাইছে, ঠিক এমন সময়ই নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক বোন নাজমা খান বিশ্বব্যাপী ডাক দিয়েছেন হিজাব বিপ্লবের। হিজাব যে নারীর প্রতি নিপীড়ন নয় এবং বৈষম্যের প্রতীক নয়, তা বোঝাতে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন তিনি।

এ জন্য অমুসলিম বোনদেরও হিজাব পালনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বাস্তবেই এটা কোনো নিপীড়ন কি না, তা পরখ করার আহ্বান জানিয়ে ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হিজাব দিবসের ডাক দেন। বিশ্বময় মুসলিম নারীর সঙ্গে সঙ্গে অনেক অমুসলিম নারীও তাতে সাড়া দিয়েছেন। কারণ তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। হিজাব শুধু মুসলিম নারীদের ধর্মীয় বিধিবিধান নয়, বরং নারী জাতির সম্মান, লজ্জা ও সম্ভ্রম সংরক্ষণের সবচেয়ে বড় উপায়। পর্দা নারীকে অশ্লীল, কদর্য ও কুদৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে রাখে। যারা বেপর্দা ও নগ্ন স্বাধীনতার তিক্ততার আস্বাদ গ্রহণ করেছেন এবং যারা অশ্লীলতা ও অবাধ মেলামেশার আগুনে দগ্ধ হয়েছেন, তারা এর স্বীকৃতি দেন। তারা অনেকেই মনে করেন, মুসলিম বিধিবিধানসমৃদ্ধ সমাজব্যবস্থা একটি পূর্ণাঙ্গ ও নিরাপদ সমাজব্যবস্থা। এ উপযুক্ত সমাজের রীতিনীতি একান্তভাবে গ্রহণ করা উচিত। কেননা এই যুক্তিসংগত প্রথা যুবক-যুবতীকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করে।

অনেকে মনে করেন, হিজাব নারীর উন্নতি বা উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পথে বড় বাধা। হিজাবধারী মেয়েরা কোনো সফলতা পায় না এবং সফলতার জগতে তাদের কোনো ভূমিকাও নেই। এই কথাটি যে হিজাববিরোধীদের মনগড়া একটা মিথ্যা, সেটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে হিজাববিরোধী মন্তব্যকারীর চেয়ে হিজাব পরিধানকারীর যোগ্যতা বেশি ও বড় প্রমাণিত হয়েছে বারবার। ইউরোপ-আমেরিকাসহ সারা বিশ্বের অমুসলিম দেশগুলোয় (কখনও কখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশেও) হিজাব পালনকারী নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা এসেছে। সহযোগিতাবিহীন একাকী পথে তবু তারা হেঁটেছেন, লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। কারণ তারা হিজাবের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করেছেন এবং তাদের সেই উপলব্ধির ভিতটা মজবুত।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপদেষ্টা ছিলেন ড. ডালিয়া মুজাহিদ। হিজাব পরিধানকারী ডালিয়াকে প্রথম সাংবাদিকরা দেখে বিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিলেন আপনার বেশভূষার মাঝে আপনার উচ্চশিক্ষা এবং প্রজ্ঞার গভীরতা প্রকাশ পাচ্ছে না। তিনি বুঝেছিলেন, সাংবাদিকরা হিজাবকে অনগ্রসরতা ও সেকেলে ধ্যানধারণার প্রতীক মনে করছে। তিনি বললেন, আদিম যুগে মানুষ ছিল প্রায় নগ্ন। শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পোশাক-পরিচ্ছদেও উন্নতির শিখরে আরোহণ করে। আমি যে পোশাক পরিধান করেছি, সেটা শিক্ষা ও চিন্তাশীলতায় উন্নতি ও সভ্যতার পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ। নগ্নতা বা অর্ধনগ্নতা যদি উন্নত শিক্ষা ও সভ্যতার চিহ্ন হতো, তাহলে বনের পশুরা হতো সবচেয়ে সুসভ্য ও সুশিক্ষিত।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্যের রান্নাবিষয়ক প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান বিজয়ী নাদিয়া হোসাইন হিজাবি সেলিব্রেটি। অলিম্পিকে অংশ নেওয়া প্রথম হিজাবি খেলোয়াড় ইবতিহাজ মুহাম্মদকেও অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ডিবেটে ট্রফি অর্জনকারী ১৫ বছরের ফাতিমা নুরের বিজয় খুব সহজ ছিল না। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ১৩ বছরের কিশোরী সাবাহাত নাবিহা ৮ বছর বয়স থেকেই হিজাব পরছে। স্টেট সায়েন্স ফেয়ারে প্রথম স্থান এবং ইউসিএলএ ব্রেইন রিসার্স ফাউন্ডেশন থেকে ফার্স্ট প্লেস অ্যাওয়ার্ড অধিকারী সাবাহাতকে প্রায়ই বিভিন্ন মন্তব্য এবং প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।

ইউরোপ-আমেরিকার এসব হিজাব পরিধানকারী নারী ও কিশোরী তাদের সমাজের পরিবারগুলোর চারিত্রিক অবক্ষয়, অবাধ মেলামেশা ও স্বেচ্ছাচারিতার ভয়াবহ পরিণাম থেকে সতর্ক হয়ে অন্যদেরও সতর্ক করছেন। আহ্বান করছেন হিজাবে ও শালীনতায় পবিত্র সফল জীবনের প্রচেষ্টার পথে। মুসলিমদের কাছে হিজাব মর্যাদার প্রতীক। আমেরিকার প্রধান মূলনীতিগুলোর একটি হলো ধর্মীয় স্বাধীনতা। এরপরও ইউরোপ-আমেরিকায় হিজাব পরাটা একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। আর এই চ্যালেঞ্জ থেকে আপনার আমার শেখার আছে অনেক কিছু। উপলব্ধির খুঁটিটা শক্ত হলেই নিরাপদ হবে মাথার ওপরের ছাদটা। হিজাব অর্থাৎ ইসলামের অনুশাসনের উপকারিতা সম্পর্কে উপলব্ধি বা জ্ঞান না থাকা কারও অক্ষমতা হতে পারে; কিন্তু বিভ্রান্তি ছড়ানো তার দুর্বৃত্তপনা।

লেখক : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী গবেষক

আরও পড়ুন