।। আসাদ পারভেজ ।।
আমরা সমাজ ও রাষ্ট্র সংস্কারের কথা নিজেরা অকপটে বলি এবং অপরকে বলতে শুনি। কিন্তু আমাদের সমাজ আজও আদিকালের নিকটবর্তী নয় কি? এই আমরা সমতা, নায্যতা আর অধিকারের জন্য সংগ্রাম করি। অথচ আমরা কি পরিবর্তন এনেছি নিজ অস্তিত্বে। মানবজাতির দুঃখটা এখানেই!
দুনিয়াজুড়ে মানবের মৌলিক অধিকার (খাদ্য, বাসস্থান, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা) রক্ষা করা অত্যাবশ্যকীয়। এটি যেমন করে রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের প্রাপ্যতা, তেমনি মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগ ‘মৌলিক অধিকার’ মোতাবেক বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক বাংলাদেশী স্বতঃসিদ্ধভাবে কতিপয় মৌলিক অধিকারের মালিক।
সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবে না। করলে, তা স্বতঃসিদ্ধভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে, মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী পূর্বেকার সকল আইন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ। মৌলিক অধিকার শারীরিক ও মানসিক সীমানা সংকোচনকারী কৃত্রিম বাধা অতিক্রম করে মুক্তি, স্বাধীকার ও ন্যায়বিচারের পরিবেশ নিশ্চিত করে নাগরিকদের জীবন মর্যাদাপূর্ণ করে। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সর্বোত্তম রক্ষাকবচ। সংবিধানের চতুর্থ পরিচ্ছেদের ১০২ অনুচ্ছেদ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার এখতিয়ার দিয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে প্রত্যেক বাংলাদেশীর মৌলিক অধিকার ১৮টি । সেগুলো হচ্ছে- সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান; ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য করা যাবে না; নারী পুরুষের সমঅধিকার; সরকারী নিয়োগ-লাভে সুযোগের সমতা; আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার; জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার; গ্রেপ্তার ও আটকে রক্ষাকবচ; জবরদস্তিমূলক শ্রম নিষিদ্ধ; বিচার ও দন্ড সম্পর্কে রক্ষণ; চলাফেরার স্বাধীনতা; সমাবেশের স্বাধীনতা; সংগঠনের স্বাধীনতা; চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতা; পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা; ধর্মীয় স্বাধীনতা; সম্পত্তির অধিকার; গৃহ ও যোগাযোগের অধিকার ; মৌলিক অধিকারবঞ্চিত হলে উচ্চ আদালতে রিট করার অধিকার।
অথচ এ দেশে আওয়ামী শাসনের গত ১৬ বছর যাবৎ সাংবিধানিক কোনো অধিকারই রক্ষা করা হয়নি। দেশের অধিকাংশ মানুষ সর্বদিকে চরমভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন। দেশের অর্থনীতির চাকা অচল হয়েছে। দৃশ্যমান উন্নয়ন করতে গিয়ে বৈদেশিক দেনায় দেউলিয়ার দোরগোড়ায় রাষ্ট্র। শিক্ষাঙ্গনের লেজুড়বৃত্তি আগামী প্রজন্মকে অন্ধকারে নিয়েছে। একদিকে নারী ও শিশু ধর্ষণ বেড়েছে, অপরদিকে যৌনাচারের আখড়াগুলোকে অবাধে বিচরণের সুযোগ করে দিয়েছিল কতিপয় আওয়ামী লীগের দোসররা। আমলাতন্ত্রে চরমপ্রকারের পঁচন ধরেছিল। দেশটা পুলিশিরাষ্ট্রে সম্পূর্ণরূপে পরিণত হয়। দুর্নীতি একেবারে সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নির্বাচিত যে জনপ্রতিনিধির প্রয়োজন তা সবাই ভুলতে বসেছেন। ভোটের রাজ্যে আকাল পড়েছিল। দিনের ভোট রাতে হয়েছে! এগুলোর হিসেব চাইলেই অকাতরে গুম হয়েছে মানুষ। ৩ হাজারের অধিক মানুষের খোঁজ পাওয়া যায়নি। আয়নাঘরের মত রহস্যময় দানবের আবির্ভাব হয়েছে। ক্যানিনোকাণ্ডের অভিযুক্তরা রাজনৈতিক পুনর্বাসন উদ্বেগজনক পরিস্থিতির বার্তা দিয়েছিল। পররাষ্ট্র নীতির নতি স্বীকারে জাতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আওয়ামী শাসন ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের গহ্বরে প্রবেশ করেছে, যা রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ। ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে আলেম সমাজকে নাজেহালে ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল। তাদের চোখ দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির স্রোত আরশের মালিক নিশ্চয়ই দেখছেন। সময় আওয়ামী দোসরদের হিংস্র করে তুলেছিল। সময়ই এদের লাগামহীন অপরাধের হিসেব নিয়েছে।
খালেদা জিয়া তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী; তিনি বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পৃথিবীর বহমান পথচলার অংশীদারিত্বের মতোই এ দেশের মা ও মাটি হয়ে চিরকাল থাকবে তাঁর নাম। অথচ ২টি মিথ্যা মামলা দিয়ে ২০১৮ সালের ০৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। গুরুতর অসুস্থতার পরও তাঁকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে দেওয়া হয়নি। সাংবিধানিক কিংবা মানবিক কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেনি হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার।
আরও পড়ুন-
বাংলাদেশের আম-জনতা স্বপ্ন বুনেছিল বেগম জিয়ার চিকিৎসা ও সুস্থতা নিয়ে। সুস্থতা দেওয়ার মালিক মহান রাব্বুল আলামিন। জনতার প্রথম স্বপ্ন পূরণে বেগম জিয়া চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাবেন, ইনশাঅল্লাহ।
অপরদিকে জুলুমের জালিম পালিয়েছেন ন্যাক্কারজনকভাবে। যারা ফ্যাসিস্ট, তারা চূড়ান্ত পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্তকে সেরা মনে করে। এমন ঘাড়ত্যারা স্বৈরশাসকদের বিদায়টা বড়োই করুণ ও নির্মম হয়। ইতিহাস এমনটাই স্বাক্ষী দেয়।
বিশ্ব জাহানের সর্বময় ক্ষমতা, সম্মান ও কর্তৃত্বের একচ্ছত্র অধিকারী একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালা। তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা-সম্মান দান করেন আবার যার থেকে ইচ্ছা এসব কেড়ে নেন। পৃথিবীর মাঝে ক্ষমতা ও সম্মান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত এক বিশেষ অনুগ্রহ। অনুগ্রহ পেয়ে কখনো অহংকার করতে হয় না। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সৃষ্টিজীবের ওপর সদয় থাকতে হয়। অন্যথায় আল্লাহ তায়ালা তা কেড়ে নেন।
পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে বর্ণিত হয়েছে :
قُلِ اللّٰهُمَّ مٰلِكَ الۡمُلۡكِ تُؤۡتِی الۡمُلۡكَ مَنۡ تَشَآءُ وَ تَنۡزِعُ الۡمُلۡكَ مِمَّنۡ تَشَآءُ ۫ وَ تُعِزُّ مَنۡ تَشَآءُ وَ تُذِلُّ مَنۡ تَشَآءُ ؕ بِیَدِكَ الۡخَیۡرُ ؕ اِنَّكَ عَلٰی كُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ (বল, ‘হে আল্লাহ, রাজত্বের মালিক, আপনি যাকে চান রাজত্ব দান করেন, আর যার থেকে চান রাজত্ব কেড়ে নেন এবং আপনি যাকে চান সম্মান দান করেন। আর যাকে চান অপমানিত করেন, আপনার হাতেই কল্যাণ। নিশ্চয় আপনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান’। সূরা আল ইমরান, আয়াত : ২৬
মহান স্রষ্টা পৃথিবীকে নানা বৈচিত্রময় করে বানিয়েছেন। মানবসমাজের ভারসাম্য রক্ষায় মহান আল্লাহ মানবজাতিকে নানা শ্রেণি ও গোষ্ঠীতে বিন্যস্ত করেছেন। তিনি কাউকে জ্ঞানী আর কাউকে মূর্খ, কাউকে ধনী আর কাউকে দরিদ্র, কাউকে শাসক আর কাউকে জনতা বানিয়েছেন। পার্থিব জীবনে আল্লাহ যাঁদের সম্মানিত করেছেন তিনি তাঁদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং তিনি অপরপক্ষের প্রতি সুবিচার করেছেন। এভাবেই তিনি শ্রেণিবদ্ধ মানবসমাজের ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। অথচ এরপরও আমরা নানা কাজে নিজেদেরকে অহমিকা আর দাম্ভিকতার শেষ স্তরে নিয়ে যাই। যেইখান থেকে জনতার দুঃখ-কষ্ট অনুধাবন করা যায় না। ফলে ফ্যাসিস্ট শাসকে পরিণত হয় হাসিনার মতো বহু শাসক। এদের পূর্বপুরুষদের দাম্ভিকতাকে ধ্বংস করেছেন মহান রবই। এব্যাপারে কুরআনে এসেছে এভাবে,
১) ‘যেদিন আমি তোমাদের প্রবলভাবে পাকড়াও করব, সেদিন নিশ্চয় আমি তোমাদের শাস্তি দেবই।’ সুরা : দুখান, আয়াত : ১৬
২) অন্যত্র মহান মালিক আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘লুত তাদের সতর্ক করেছিল আমার কঠোর পাকড়াও সম্পর্কে; কিন্তু তারা সতর্কবাণী সম্পর্কে বিতণ্ডা শুরু করল।’ সুরা : কামার, আয়াত : ৩৬
৩) ‘আর আল্লাহ যাকে পাকড়াও করেন, অত্যন্ত কঠোরভাবে পাকড়াও করেন, কঠোর শাস্তি দান করেন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালকের পাকড়াও অত্যন্ত কঠিন।’ সুরা : বুরুজ, আয়াত : ১২
লেখকঃ গবেষক ও রাষ্ট্রচিন্তক
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-
[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১) ।
মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে। আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।