Ads

নারী বিষয়ক কমিশনের ইসলাম-বিরোধী সুপারিশ ও একটি বিশ্লেষণ

।। শিমুন লিজা ।।

সম্প্রতি প্রকাশিত জাতীয় নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। এসব সুপারিশ শুধুমাত্র ইসলামি শরিয়াহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, বরং ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সাংবিধানিক অধিকারের বিরুদ্ধেও অবস্থান করছে। এই প্রবন্ধে আমরা প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করে দেখবো কেন এগুলো বাতিল করা উচিত এবং ইসলামি সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের করণীয় কী হতে পারে।

১. মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাতিলের প্রস্তাব (পৃষ্ঠা ২৫)

নারী কমিশনের প্রথম বিতর্কিত সুপারিশটি হলো মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে নারী-পুরুষকে সমান সম্পত্তি প্রদানের আহ্বান। অথচ, ইসলামে উত্তরাধিকার বণ্টন একেবারেই মানব-নির্ধারিত নয়; এটি সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত একটি বিধান (সূরা নিসা: ১১-১২, ১৭৬)। এখানে পরিবর্তনের অর্থ হবে আল্লাহর বিধানে হস্তক্ষেপ করা, যা ইসলামি বিশ্বাসের অপমান, অনেক বড় অপরাধ।

ইসলাম নারীকে শুধু সম্পত্তির অধিকারই দেয়নি, বরং তার জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আর্থিক দায়িত্ব পুরুষের উপর অর্পণ করেছে। একজন নারী তার বাবার ঘরে, স্বামীর ঘরে কিংবা ভাইয়ের ঘরে—কোনো অবস্থাতেই আর্থিক দায়ভার বহন করে না। ফলে উত্তরাধিকারে পুরুষের অধিক অংশ কোনো বৈষম্য নয়, বরং এটি দায়িত্বের পরিপ্রেক্ষিতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ন্যায়বিচার।

২. অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন (পৃষ্ঠা ৯)

নারী কমিশনের দ্বিতীয় সুপারিশ হলো সকল ধর্মের জন্য একক পারিবারিক আইন চালু করা। এর অর্থ হচ্ছে—মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান সবার পারিবারিক আইনকে বাতিল করে একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আইন চাপিয়ে দেওয়া। বাস্তবতা হলো, এটি নিছক ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মত্যাগকে উৎসাহিত করার কৌশল।

ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি ইউসুফ মারকান্দে বলেছিলেন: “Secularism doesn’t mean irreligiousness. It means equal respect to all religions.”

অর্থাৎ, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়—বরং প্রতিটি ধর্মের নিজস্ব আইন ও সংস্কৃতিকে সম্মান করা। অভিন্ন পারিবারিক আইন চাপিয়ে দেওয়া হলে তা সংবিধানের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করবে।

আরও পড়ুন-

নারী অধিকার সংস্কার ও প্রতিনিধিত্বের সংকট

৩. CEDAW বাস্তবায়নের সুপারিশ (পৃষ্ঠা ৯)

কমিশনের প্রস্তাবনায় জাতিসংঘের CEDAW (Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women) বাস্তবায়নের আহ্বান রয়েছে। যদিও এই সনদ নারীর অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে কিছু ভালো দিক রাখে, তবে এর অনেক ধারা ইসলামি পারিবারিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

অনেক মুসলিম রাষ্ট্র এই সনদে সই করলেও ইসলামি বিধানগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারাগুলোর ক্ষেত্রে “Islamic reservation” দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সেই সংরক্ষণ নীতিকে বাতিল করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

৪. নারী-পুরুষকে পরিবারে অভিন্নভাবে দেখার আহ্বান (পৃষ্ঠা ৯)

কমিশনের মতে, পারিবারিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষকে অভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে হবে। এটি মূলত পশ্চিমা ‘জেন্ডার সমতা’ ধারণার প্রতিফলন। ইসলাম অবশ্যই নারী-পুরুষের মাঝে সম্মান ও মর্যাদায় সমতা দিয়েছে, কিন্তু তাদের দায়িত্ব ও ভূমিকার মধ্যে স্বতন্ত্রতা রেখেছে।

সূরা নিসা ৩৪-এ বলা হয়েছে, “পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল, কারণ আল্লাহ একের উপর অপরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং তারা নারীদের উপর ব্যয় করে।”

অতএব, ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য করে না—কিন্তু তাদের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য ও দায়িত্ব অনুযায়ী ভিন্নতা স্বীকার করে। এটাই ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি।

ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষায় আমাদের অবস্থান:

এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে তা শুধু মুসলিমদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও জীবনধারার উপর আঘাত নয়, বরং জাতীয় ঐক্য ও সামাজিক স্থিতির জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই এই সুপারিশগুলো অবিলম্বে বাতিল করতে হবে এবং নারী কমিশনকে পুনর্গঠন করতে হবে, যেখানে সকল ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব থাকবে।

আরও পড়ুন-

যৌনকর্মী কি শ্রমিকের মর্যাদা পাওয়ার আদৌ যোগ্য?

আমাদের করণীয় হতে পারে—

১.শান্তিপূর্ণভাবে যুক্তিনির্ভর প্রতিবাদ।

২.গণস্বাক্ষর অভিযান।

৩.আলেম, লেখক ও সমাজবিজ্ঞানীদের সম্মিলিত বিবৃতি

৪.ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার।

আমরা উত্তেজনায় নয়, যুক্তিতে বিশ্বাস করি। ইসলামের পক্ষে অবস্থান মানেই সামাজিক ভারসাম্যের পক্ষে অবস্থান।

লেখক পরিচিতিঃ শিমুন লিজা একজন কলমসৈনিক, যিনি সমাজ, নারীর অবস্থান এবং ইসলামিক মূল্যবোধ নিয়ে লেখালেখি করতে ভালোবাসেন। মানবিক ও বাস্তব অভিজ্ঞতার মিশেলে তিনি পাঠকের মনে জায়গা করে নিতে আগ্রহী।

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-

[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১)

মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে।  আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।

আরও পড়ুন