।। মাসুমা তাসনিম ।।
ভারতবর্ষে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা তথা ফসলি সন ১৫৫৬ সালের ১৪ এপ্রিল প্রবর্তন করেন। তখন এ দেশে হিজরি সাল প্রচলিত ছিল। হিজরি বছরটি ঠিক রেখেই নতুন বর্ষপঞ্জি চালু হয়। তাই শুরুতে ১ সাল না হয়ে, হয়েছে ৯৬৩ সাল।
বাংলা দিনপঞ্জি চলে সৌর হিসেবে, হিজরি ও খ্রিস্টীয় সালের চলে চাঁদের হিসাবে এবং ঘড়ির হিসাবে। এ কারণে হিজরি সালে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে, আর ইংরেজি দিন শুরু হয় মধ্যরাতে, বাংলা সনের দিন শুরু হয় ভোরে, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে।
পহেলা বৈশাখের ব্যাপারে তিনটা ধাপের সাথে আমরা পরিচিত
১) চৈত্রের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা আদায় করার পর কৃষকের মধ্যে আনন্দ বয়ে যেত, তাঁরা খুশি মনে যে কোন কাজের উদ্যোগ নিতে পারতেন , হালকা বোধ করতেন। অন্যদিকে, জমিদাররা খাজনা আদায় করে খুশিতে মিষ্টি বিতরণ করতেন।
২) ব্যবসায়ীরা ১লা বৈশাখে হালখাতা করতেন। এখানে ব্যবসার হালনাগাদ হতো। ক্রেতারা এক বছরের দেনা- পাওনা পরিশোধ করতেন। নতুন ও পুরাতন ক্রেতাদের বিক্রেতারা সামর্থ্যানুযায়ী আপ্যায়ন করাতেন। নতুন উদ্যমে ব্যাবসা শুরু হতো।
৩) ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা বর্ষবরণের নামে আনন্দ শোভাযাত্রা বের করেন। এই গ্রুপের অন্যতম প্রধান ছিল কলকাতার শিক্ষার্থী তরুণ ঘোষ। ধীরে ধীরে আনন্দ শোভাযাত্রা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় পরিনত হয়। এই যাত্রায় থাকে বিভিন্ন প্রাণীর মুখোশ ও প্রতিমা। যেই মুখোশগুলো হিন্দুদের বিভিন্ন দেবতাদের বাহন। যেমন পেঁচা মঙ্গলের প্রতীক,দেবতা লক্ষ্মীর বাহন। এ বাহনে করে দেবতা লক্ষ্মী কল্যাণ নিয়ে আসে। ইঁদুর গণেশের বাহন। এভাবে প্রত্যেকটা প্রাণী কোনো না কোনো দেবতাদের বাহন।
এই তিনটা ধাপকে সামনে রেখে আমাদের করণীয় হতে পারে
১)নতুন বছরকে দোয়া পাঠের মাধ্যমে স্বাগত জানাতে পারি।
আল্লাহ সবার চেয়ে বড়। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের উপরে চাঁদকে উদিত করুন শান্তি ও ঈমানের সাথে, নিরাপত্তা ও ইসলামের সাথে এবং আমাদেরকে ঐ সকল কাজের ক্ষমতা দানের সাথে, যা আপনি ভালবাসেন ও যাতে আপনি খুশী হন। (হে চন্দ্র!) আমার ও তোমার প্রভু আল্লাহ। (তিরমিযী)
২) পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে পরিবার ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে পারি।
আরও পড়ুন-
৩) দেশীয় ও সামাজিক সংস্কৃতি যেটুকু সরাসরি গুণাহের নয়, সুস্থ ও সুন্দর সেইটুকুর আনন্দে শরিক হওয়া যায়। পারিবারিকভাবে সেখানে অংশগ্রহণ করা যায়, এতে করে পরিবারকে সময় দেয়া হয় এবং সম্পর্কে নতুনত্ব আসে।
৪) ইসলামের যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানের পেছনে থাকে ত্যাগ এবং ভোগ। ওই দিনেও আমরা এই চেতনার নবায়ন করতে পারি। যেমন, বৈশাখ আসা মানে অনেক পরিবারের উপর দিয়ে ক্ষয়ক্ষতির ঝড়ঝাপটা যাওয়া। তাদের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করতে পারি। এত করে আমাদের মানবিক মূল্যবোধ শাণিত হয়।
৫) আমার কোন কাজ যেন অন্য ধর্মের সংস্কৃতির হুবহু অনুকরণ না হয় সেই খেয়াল করা। শিরক না হয় সে বিষয়ে সচেতন থাকা।
৬) নারী-পুরুষের অবাধ ও অশ্লীল মেলামেশা বর্জন করা। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
৭) এক্ষেত্রে না বললেই নয়, পহেলা বৈশাখ পালন হারাম এটা বলা উচিত না। পহেলা বৈশাখের ধরন যেটুকু ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক, যেটুকু শিরক সেটুকু বর্জন করার কথা বলতে পারি।
৮) কল্যাণ দানের মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। তিনি সব সময় সর্বস্থায় কল্যাণ দিতে পারেন। সবসময় তাঁর কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করা যায়,দিন-সময়ের ফ্রেমে তিনি বন্দি নন।
খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যার চমৎকার করে বলেছেন, ১লা বৈশাখ উদযাপন যার ঈমানে বাধা দেয় সে করবে না, তবে পরিবারকে বিকল্প পন্থায় বিনোদন দিতে হবে। যে করছে তাকে কাফের বলা যাবে না,মুশরিক বলা যাবে না, বরং তার কর্মের সমালোচনা করা যায়। এটা বড় গুনাহ হয়েছে এটা বলা যায়। তিনি সুন্দর ভাবে বলেছেন, দেশীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানের ভালটুকুতে অংশ নেয়া যায়, যেটা ক্ষতিকর নয় সে সামাজিক আনন্দ দোষের নয়।
এবার বৈশাখের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’।
আসুন সবাই জাতিগতভাবে ঐক্যে অবস্থান করি। দীর্ঘ বছরের নানান ষড়যন্ত্রের ফসল একদিনে উপড়িয়ে ফেলা যাবে না। সেগুলো ধীরে ধীরে বুঝিয়ে ও পদক্ষেপ গ্রহণ করে দূর করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে সার্বিক অকল্যাণ থেকে হেফাজত করুন। নতুন বছর হোক সবার জন্য কল্যাণকর। আমীন।
তথ্যসূত্র:
১) বিডি নিউজ,২০১৪
২) খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের লেকচার।
৩) শায়খ আহমাদুল্লাহ লেকচার।
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল- [email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১) ।