সুইটি শিলা
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের মহীসোপান দাবির বিষয়ে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত আপত্তি জানিয়েছে।আমাদের অন্য আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমার পর্যবেক্ষণ দিয়েছে।
গত ১৬ এপ্রিল জাতিসংঘের “কমিশন অব দ্য লিমিটস অব দ্য কন্টিনেন্টাল শেলফ” এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে ভারতের আপত্তির বিষয়টি।ভারতের আপত্তি হলো যে বেজলাইন বা উপকূল রেখার উপর নির্ভর করে বাংলাদেশ নিজের মহীসোপান সীমানা নির্ধারণ করেছে, তার মাধ্যমে ভারতের মহীসোপানের একাংশ দাবী করা হয়েছে। তার উপর আবার বঙ্গোপসাগরের ‘গ্রে এরিয়া বা অস্পষ্ট এলাকা’ নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোন তথ্য দেয়া হয়নি। ভারত জাতিসংঘের মহীসোপান বিষয়ক এই সংস্থাকে অনুরোধ করেছে, যাতে বাংলাদেশের কোন দাবি বিবেচনা না করা হয়।
উল্লেখ্য বাংলাদেশ আইনসঙ্গতভাবেই মহীসোপানের যতখানি সীমানা নিজের বলে মনে করে, সেই সীমানায় নিজেদের অংশ দাবি করছে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী অন্য দুই প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমার। অথচ মজার ব্যাপারটা হলো বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ এই দুই দেশের সাথে যে অনেক আগেই মিটে গেছে তা আমাদের সবারই জানা।
বাংলাদেশ ও মায়ানমারের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি হয় ২০১২ সালে এবং ভারতের সাথে বিরোধ নিষ্পত্তি হয় ২০১৪ সালে। এই দুই দেশের সাথেই বাংলাদেশ জয়লাভ করে। প্রতিবেশি দুই দেশের সাথে সমুদ্রসীমা বিজয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরের ১,১৮,৮১৩ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলে।
সমুদ্র তীর থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৮ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলায় অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের উপর। অথচ এখন ভারত আপত্তি করছে এই মহীসোপান নিয়ে?
যে মহীসোপান নিয়ে এত কথা হচ্ছে,সেই মহীসোপান জিনিসটা আসলে কি? কাকে বলে?
মহীসোপান কী?
মহীসোপানের ইংরেজি অর্থ হলো কন্টিনেন্টাল শেলফ, বাংলায় যাকে আমরা বলছি মহীসোপান। মহীসোপান হলো সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর যে ভূখন্ড সমুদ্রের দিকে পানির নিচে ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। তাকে ভূগোলের ভাষায় মহীসোপান বলে। মহীসোপানকে উপকূলীয় অঞ্চলের বর্ধিত অংশ হিসেবে ধরা হয়।
১৯৫৮ সালের কনভেনশন অনুযায়ী, সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর স্থলভাগের বেজলাইন থেকে লম্বালম্বিভাবে সমুদ্রের ২০০ মাইল পর্যন্ত এলাকার মালিকানা সম্পূর্ণ ওই দেশের। একে বলা হয় এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক অঞ্চল (ইইজেড) বা একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল, যেখানে সমুদ্রের পানি ও তলদেশের ওপর ওই দেশের একছত্র অধিকার থাকে। সেখানকার সমুদ্রে অন্য কোন দেশ মাছ ধরতে পারে না।
এরপর থেকে দেড়শ মাইল পর্যন্ত সীমার সমুদ্র তলদেশের খনিজ সম্পদের মালিক হবে ওই দেশ, তবে পানিতে থাকা মাছ ধরতে পারে অন্য দেশও। এই পুরো সাড়ে তিনশো মাইলকে ওই দেশের মহীসোপান বলা হয়।
দেশের আকার ভেদে এই মহীসোপানের দৈর্ঘ্য কমবেশি হতে পারে। যেমন অস্ট্রেলিয়ার মহীসোপানের আয়তন অনেক বেশি। বাংলাদেশ নিজের ভূখণ্ড থেকে লম্বাভাবে সাড়ে তিনশো মাইল এলাকার মহীসোপান নিজের বলে জাতিসংঘে দাবি করেছে।
মহীসোপান কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
মহীসোপান মূলত একটি দেশের সীমানারই অংশ। ভূখণ্ডের মতো সাগরের এই মহীসোপান নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, নিজস্ব মহীসোপান এলাকায় ঐ দেশ একচেটিয়াভাবে মৎস্য আহরণ করতে পারে এবং সমুদ্রের তলদেশে থাকা সকল দেশের খনিজ সম্পদের মালিকও ঐ দেশ। সেই সঙ্গে মহীসোপানের যে বর্ধিত অংশটি থাকে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেমন, আরো দেড়শ মাইল সেটিও ঐ দেশের একটি বর্ধিত অংশ।
মহীসোপান সব দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। মহীসোপান এলাকায় থাকা খনিজ সম্পদসহ নানা প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদ সে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গোপসাগর পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ যার তীরে অবস্থিত ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড এই প্রত্যেকটি দেশের জন্যই বঙ্গোপসাগরের মহীসোপান এলাকার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম।
সমুদ্রের এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে একটি দেশের অর্থনীতিকে খুব বেশি ত্বরান্বিত করা যায়। এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন সমুদ্র সম্পদ নির্ভর বলা চলে। সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে টেকসই উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই ধারার একটি নামও রয়েছে যা ব্লু ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতি নামে পরিচিত। তাই মহীসোপান অঞ্চল প্রতিটি সমুদ্র তীরবর্তী দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ-ভারত মহীসোপান ইস্যু
শুরুতেই বাংলাদেশর মহীসোপান ইস্যু নিয়ে ভারতের আপত্তির কথা তুলে ধরেছি। ২০১১ সালে জাতিসংঘে মহীসোপানের নিজেদের প্রাপ্য দাবি করে আবেদন করে বাংলাদেশ। যদিও ২০২০ সালে ওই দাবির বিষয়ে আবারো সংশোধনী দেয় আবার। পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব এ্যাডমিরাল(অব) মো. খুরশীদ আলম বলেন,
” মহীসোপান সব দেশেরই একটা অধিকার। সব দেশ ২০০ মাইল পর্যন্ত ইইজেড পাবে আর সাড়ে তিনশো মাইল পর্যন্ত মহীসোপান পাবে।”
বাংলাদেশ মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ বিষয়ক মামলায় জয়লাভ করে। সেই রায়ে মহীসোপানের সীমানা আলাদাভাবে নির্ধারণ করার কারনে ২০২০ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ সিএলসিএস এ সংশোধনী জমা দেয়। এ্যাডমিরাল খুরশীদ আলম এর মতে, ভারত যে বিষয়ে আপত্তি তুলছে তাতে মহীসোপানের সাথে কোন সম্পর্ক নাই।
বিরোধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত
বাংলাদেশ ও ভারতের মহীসোপান সংক্রান্ত বিরোধের ব্যাপারে সুপারিশ দেবে জাতিসংঘের মহীসোপান নির্ধারণসংক্রান্ত কমিশন (সিএলসিএস)। দুই দেশের বক্তব্য বিচার বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি তাদের সুপারিশ জানাবে। সেই সুপারিশের ব্যাপারেও আবার আপত্তি জানানো যাবে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেহেতু আদালত সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছে, তার বাইরে বাংলাদেশের যাওয়ার সুযোগ নেই।অ্যাডমিরাল খুরশীদ আলম বলছেন,
কোন দেশ মানতে রাজি না হলে তারা পুনর্বিবেচনার পর আবার সিএলসিএসে যেতে পারে। কিন্তু চূড়ান্ত যে সুপারিশ তারা দেবে, সেটা সব দেশকে মানতে হয়, সেটাই নিয়ম।
এখানে আদালতের মতো কোন শুনানি হয় না। তবে সিএলসিএসের যে কমিটি রয়েছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট দেশ তথ্য-প্রমাণসহ একটি প্রেজেন্টেশন দিতে পারে।
লেখাটি লিখতে গিয়ে আমাকে বিবিসি বাংলা, প্রথম আলো, ও নয়া দিগন্তসহ আরো কিছু উৎস্যের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। বিভিন্ন তথ্যমতে বাংলাদেশের মহীসোপান নিয়ে ভারতের আপত্তির বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে এবং যা স্পষ্টভাবে জাতিসংঘের মহীসোপান বিষয়ক সংস্থায় প্রকাশও করা হয়েছে। এর পরবর্তী অবস্থা জানতে হলে আমাদের অবশ্যই এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে হবে এবং সিএলসিএস এর সুপারিশ এর অপেক্ষায় থাকতে হবে।
লেখকঃ কলাম লেখক