।। শারমিন আকতার ।।
“তোমরাই হলে সর্বোত্তম উম্মত, মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দান করবে ও অসৎ কাজে বাধা দিবে এবং আল্লাহর প্রতি ইমান আনবে।“ [সূরা আল ইমরান -১১০]
মুসলিমদের কাজই হচ্ছে মানব জতির কল্যাণে কাজ করা । আর মানবজাতির কল্যাণ দ্রুততম সময়ে সবচেয়ে বেশি করা যায় আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে । আর সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরে নানা ধরণের রাজনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীন জমিনে প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয় ।
বাংলাদেশে কোনও কোনও ইসলামী দল সত্যিকার অর্থে বহু বছর ধরে খুব নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছে । তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ভোটের লড়াইয়ে সেভাবে ভাল অবস্থান তৈরি করতে পারেছে না । বিশেষ করে নির্বাচন হলে ৫০% বা তার বেশী ভোট পাবার অবস্থান এখনও তৈরি হয়নি বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত । কিছু কিছু ইসলামী দলের নৈতিক অবস্থান অনেক উচ্চ মাপে থাকলেও ৯০ শতাংশ মুসলিম দেশেও কেন সেই দেশের অধিকাংশ মুসলিমের সমর্থন পাবে না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে ? সেটা কি সেই দলের ব্যর্থতা? নাকি সে দেশের মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক ও নৈতিক অবস্থান ইসলামী দলগুলোর নৈতিক অবস্থানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না থাকা?
সুলেখিকা শামসুন্নাহার নিজামী “ দ্বীন প্রতিষ্ঠায় মহিলাদের দায়িত্ব” নামক তার বইয়ের ভূমিকা তে উল্লেখ করেন,
“শতকরা ৮৭ জন মুসলমানের আবাসভূমি এ বাংলাদেশ । হযরত শাহ জালাল রঃ, হযরত শাহ মখদুমের স্মৃতি বিজড়িত এ বাংলাদেশ । কিন্তু এ ভু খণ্ডকে কোনক্রমেই ইসলামী রাষ্ট্র বলা চলে না । বড়জোর এতটুকু বলা যায় যে, এটা এমন একটি ভূখণ্ড যেখানে বিপুল সংখ্যক মুসলমান বাস করে যাদের জীবন দর্শন বিভিন্ন । কেউ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী কেউবা বিশ্বাস করে অন্য কোন মতবাদ বা মতাদর্শ । অথচ ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠানে এরা মুসলমান । বিয়ে-শাদী, দাফন-কাফন ইত্যাদি ক্ষেত্রে মোল্লা-মৌলভী ছাড়া চলে না । অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে হলেও ইসলামকে অস্বীকার করার কোনও পথ বা উপায় তাদের নেই । তাইতো আমরা দেখতে পাই যে লোকটি সারা জীবন আল্লাহর একটি নির্দেশ মানলো না তার মৃত্যুর পরেও কুরানখানির ধুম পড়ে যায় । আবার ব্যক্তিগত জীবনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়কারীকেও অনেক সময় দেখা যায় জীবন দর্শন হিসেবে সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠার জন্য ময়দানে তৎপর । অর্থাৎ অন্য ধর্মের মতো ইসলামকেও জীবনের ব্যক্তিগত গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে । জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রবেশের অনুমতি নেই তার । অথচ ইসলাম বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠাযোগ্য একটি প্রগতিশীল পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ।”
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যেখানে অধিকাংশ বাংলাদেশী মুসলিমের অবস্থা এমন; যে তারা শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ইসলামটুকুকে পালন করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে, যারা জীবন বিধান বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না, তাদেরকে সাথে নিয়ে বা তাদের সমর্থন পেয়ে কীভাবে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা এই দেশে বাস্তবায়ন করা এই মুহূর্তে সম্ভব?
এক হাদিসে নবি (সাঃ) বলেনঃ “তোমরা যেমন হবে, তোমাদের বাদশাহ তথা শাসনকর্তাও তেমনি চাপিয়ে দেয়া হবে।” [মিশকাত]
তাইতো বারবার বাংলাদেশী মানুষের ঘাড়ে চেপে বসে দুর্নীতিবাজ সরকার, যারা নির্যাতনের করাত হাতে দেশকে শাসন এবং উন্নয়নের মূলা ঝুলিয়ে দেশকে বারবার শোষণ করতে থাকে ।
তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে তাহলে কি ইসলামী দলগুলো বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমে কাজ করবে না ? বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ইসলামী দলগুলোর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ থাকবে না? যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “তারা কি তবে জাহিলিয়্যাতের বিধান চায়? আর নিশ্চিত বিশ্বাসী কওমের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে কে অধিক উত্তম?”[সূরা মায়েদা, ০৫:৫০]
সূরা নিসায় আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ কর- যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি কল্যাণকর এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।”[সূরা নিসা, ০৪:৫৯]।
অতএব দ্বীন কায়েমে অবশ্যই কাজ করবে; তবে দ্রুততম সময়ে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম যেহেতু সম্ভব হচ্ছে না তাই অধিকাংশ সাধারণ জনগণের সাইকোলজি বুঝে সে অনুসারে তাদের সামনে সরাসরি ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বয়ান বা রূপরেখা না দিয়ে একটু কৌশলে আস্তে আস্তে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে জনমত গঠন হওয়ার আগ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা বা নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিতমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থার বয়ান সামনে রাখা যেতে পারে ।
বাংলাদেশী মুসলিমদের নৈতিক অবস্থান যেখানে শতভাগ ইসলামী নয়, তাদের শাসক তাহলে কিভাবে শতভাগ কোনও ইসলামী দলের পক্ষ থেকে আসা সম্ভব ? এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সাধারণ মুসলিম বাংলাদেশে শতভাগ ইসলামী দলের নেতৃত্ব আসুক চায় কি?
আরও পড়ুন-
অটোম্যানদের পতনের পরে কামাল আতা তুর্ক পাশা তুরস্কের রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে নেবার পর তুরস্ককে আধুনিক রাষ্ট্র করার নামে তুরস্কের মুসলিমদের ইসলামী মূল্যবোধ ধ্বংস করার কাজে নেমে পড়েছিলেন । সামাজিক অবস্থা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিক তুরস্কের মুসলিমদের নৈতিক অবস্থান বাংলাদেশী মুসলিমদের চেয়ে খারাপ হবার পরও রেজেপ তাইয়িপ এরদোয়ান একে পার্টি (Adalet ve Kalkınma Partisi,) ইংরেজিতে Justice and Development party কীভাবে ইসলামী নাম ধারণ না করেও ইসলামের সুমহান আদর্শে আস্তে আস্তে তুরস্কের মুসলিমদের জীবনকে প্রভাবিত করেছে এবং তুরস্কের মাটিতে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে তা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে ।
আবার মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুডের সরাসরি কোন রাজনৈতিক অংশ গ্রহণ ছিল না । এই দলটি অধিকাংশ সময়ই নিষিদ্ধ থাকতো । সেই নিষিদ্ধ অবস্থান থেকেও রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে মিশরীয়দের মনে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে । ২০০০ ও ২০০৫ সালে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃস্থানীয় নেতা মুহাম্মাদ মুরসি ইসা আল-আইয়াতের নেতৃত্বে ২০১১ সালে মুসলিম ব্রাদারহুড ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (এফজেপি) নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে । হোসনি মুবারাকের শাসনামলে মুসলিম ব্রাদারহুড মিশরের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নিষিদ্ধ থাকলেও সাধারণ ভোটারদের কথা মাথায় রেখেও তাদের গ্রহণযোগ্য নতুন দল ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি (এফজেপি) কেন গঠিত হয়েছিল মিশরে? এবং দল গঠনের মাত্র এক বছর পরেই ২০১২ সালেই সে দল বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে নেয় । মাত্র এক বছরে একটি নতুন দল কি নিজের জন সমর্থন অর্জন করেছে নতুনভাবে? না বরং মুসলিম ব্রাদারহুডের কর্মী ও সমর্থকরাই এই দলকে বিজয়ী করতে ভূমিকা রেখেছে । অবশ্য পরবর্তীতে সিসিসহ নানা ধর্ম নিরপেক্ষ দলের ষড়যন্ত্রের মধ্যে সেই দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকতে পারেনি বেশি দিন এবং পরবর্তীতে মুরসি শাহাদাত বরন করেন । যাই হোক কোন কৌশলের কারণে মাত্র ১ বছরেই রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিল; তা থেকে আমাদের দেশে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমে বদ্ধ পরিকর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ইসলামী দলের পাঠ গ্রহণ হয়তো সময়ের দাবী ।
একইভাবে বসনিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা এবং সেই দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট আলিয়া ইজেতবেগভিচ যেমন ইসলামী নামে দল গঠন না করে গণতান্ত্রিক চর্চার দল হিসেবে নামকরণ করেছিলেন “Party of Democratic Action (SDA)” ; গণতন্ত্র তো ইসলামেরই আরেক রাজনৈতিক রূপ । ইসলামী নাম না দিয়েও তার দলের মাধ্যমে ইসলামের সুমহান আদর্শে বিশ্বাসী বসনিয়াক মুসলিমদের সার্বিয়ার হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন রাজনৈতিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে । এবং তার সেই দল Party of Democratic Action (SDA) গঠনের মাত্র দুই বছরের মধ্যেই তা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে এবং বসনিয়ার মুসলিমদের ইসলামী মূল্যবোধ এবং তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভূমিকা রাখে ।
সুদূর প্রসারী আদর্শিক দাওয়াত দিয়ে মানুষকে সংশোধনের পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সাধারণ মুসলিমের চিন্তা-চেতনা, তাদের ইসলামী মূল্যবোধ লালনের ধারা মাথায় রেখে তাদের প্রত্যাশা মাফিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নমূলক এমন একটা দল গঠন এই মুহূর্তে খুব বেশী প্রয়োজন । পূর্বে আমরা দেখেছি সাধারণ যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে তারাই এই দেশের মানুষকে সেভাবে মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা উপহার দিতে পারে নাই । বরং ক্ষমতায় আসার আগে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার নানা বয়ান দিলেও ক্ষমতার আসার পর দেশকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে। তাদের দলের অধিকাংশ নেতা ও প্রভাবশালী লোকেরা ঘুষ, সিন্ডিকেট সংস্কৃতি, খুন, রাহাজানিতে ওস্তাদ, তাই সাধারণ জনগণ তাদের উপর আস্থা রাখতে পারছে না । আবার এই আমজনতার অধিকাংশ যেহেতু জীবনে শতভাগ ইসলাম বাস্তবায়ন করে চলে না বা পারে না, তাই তারা শতভাগ ইসলামী দলও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যাক এমনটা কখনও চায় না ।
তাই এই মুহূর্তে জনগণের চাহিদা মাফিক এমন একটা রাজনৈতিক দল গঠন খুব বেশী জরুরী যা মুরসি ও আলিয়ার দলের মতো দ্রুততম সময়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে । তুরস্কের এরদোয়ানের একে পার্টি তথা জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, মিশরের মুরসির ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি এবং বসনিয়ার মুসলিম নেতা আলিয়ার Party of Democratic Action (SDA) এর মতো দল খুব দ্রুত গঠন জরুরী । বাংলাদেশে এমন একটা রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি না থাকলে ক্ষমতা আবার কুক্ষিগত হতে পারে দুর্নীতিবাজ সরকারের হাতে ।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহত্তম ও গ্রহণযোগ্য ইসলামী দল ও তার ছাত্র সংগঠনের চৌকস নেতৃবৃন্দদের সমন্বয়ে এরদোয়ান, মুরসি বা আলিয়ার মতো দূরদর্শী চিন্তাধারমূলক একটি রাজনৈতিক দল যদি খুব দ্রুত গঠন করা যায় তাহলে সেই দলের পক্ষে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় উন্নয়নের প্রতিজ্ঞা নিয়ে জনগণের বিপুল ভোটে জয়লাভ করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায় ।
আমার এমন প্রস্তাবনার ভিত্তিতে হয়তো ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর মানুষেরা আমাকে ভুল বুঝতে পারেন । তারা হয়তো বলতে পারেন । ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করা আল্লাহর আদেশ । সেখানে ইসলামের বিপরীতে পাণ্ডিত্য মার্কা নীতিবাক্য শোনাতে আসছে ! আসলে আমি নীতিবাক্য শোনাতে আসিনি বরং আমি পরিস্থিতি বুঝে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছি মাত্র ।
কমিউনিস্ট শাসিত যুগোস্লাভিয়ার অধীনে থাকা বসনিয়ায় কীভাবে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হল আজ তা একটু ইতিহাস থেকে জানার চেষ্টা করি । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বসনিয়াকে কমিউনিস্ট শাসিত যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে একীভূত করা হলে মুসলিমদের দুঃসময় শুরু হয়ে যায়। কমিউনিস্ট শাসকরা মুসলিমদের সব ধরনের ধর্মীয় স্বাধীনতা কেড়ে নেয় এবং অধিকাংশ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ করে। যখন ১৯৯০-এর দশকে সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয় তখন মুসলিমরা আরো বিপন্ন হয়ে ওঠে ।
আরও পড়ুন-
বসনিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম হলেও সব ধর্মাবলম্বীরা স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করে থাকে সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রেখে । ইসলামের সুমহান আদর্শের আলোকে পরিচালিত যুগোস্লাভিয়ার অধীনে বসনিয়ার কিছু স্বপ্নবাজ মুসলিম তরুণ কর্তৃক গঠিত ‘ইয়াং মুসলিম’ এর ছায়াতলে বেড়ে উঠা সাহসী আলিয়া ইজেতভেগভিচ ইসলামের আলোকে বসনিয়ার মুসলিমদের স্বাধীনতা, স্বকীয়তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য উঠে পড়ে লাগেন । লিখতে থাকেন Islam Between East and West, Islamic Declaration, My Escape to Freedom নামে বিভিন্ন বই, যেগুলো বসনিয়ার মুসলিমদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সহায়তা দিয়েছে । ইসলামী রাজনীতির নতুন ও যুগোপযুগী বয়ান মুসলিম বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করেছে ।
১৯৯২ সালের ৩ মার্চ বসনিয়া স্বাধীনতা লাভের মাত্র দুই বছর আগে আলিয়া ইজেতভেগভিচ সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে ১৯৯০ সালে ২০ মার্চ কমিউনিস্ট যুগোস্লাভিয়ায় এমন একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন যা আলিয়ার সুদূর প্রসারী কারশমাটিক রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করে এবং আল্লাহর প্রত্যক্ষ সহায়তায় বসনিয়ার মুসলিমদের ভাগ্যের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে । এই সম্মেলনে তিনি একটি ঘোষণাপত্র পাঠ করেন । সেই ঘোষণাপত্রে দলের ১৬টি মূলনীতি ও দাবী ঘোষণা করা হয় । মূলনীতি ও দাবী সমূহ হচ্ছে,
১) দলটি মুসলিম সংস্কৃতি ধারণকারী সকলের এবং অন্যান্য যারা দলের মূলনীতিকে সমর্থন করেন, তাদেরে সকলের জন্য ।
২) গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধারণ করে, ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দলটি কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে ।
৩) দলের অন্যতম মৌলিক অঙ্গীকার হবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুরক্ষা ।
৪) একদলীয় শাসনের পতন ঘটিয়ে জনগণের নির্বাচিত সরকার কর্তৃক দেশ শাসন ।
৫) সকল পক্ষের জন্য আইনের শাসন সুনিশ্চিতকরণ ।
৬) যুগোস্লাভিয়ায় বসবাসরত সকল জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের সমঅধিকার নিশ্চিতকরণ।
৭) বসনিয়ার মুসলিমসহ অন্যান্য অঞ্চলের মুসলিমদের ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ । মুসলিম, সার্ব, ক্রোয়াটসহ সকলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিতকরণ ।
৮) কসোভো ও আলবেনিয়ার মুসলিমদের জন্য সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক সমাধানের পথ সুগম করা ।
৯) যুগোস্লাভিয়ার মুসলিমদের শিক্ষা সংক্রান্ত সংকট দূরীকরণে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করা । পূর্বতন সিলেবাস অধ্যায়নের ফলে উদ্ভূত জাতীয়তাবাদী ও কট্ররপন্থী মানসিকতা দূরীকরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সিলেবাসে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিমার্জন ।
১০) প্রতিটি ধর্মের ধর্মীয় চর্চার পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা । গণমাধ্যমসমূহে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের অবাধ প্রবেশাধিকার, বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে সরকারী ছুটি নিশ্চিতকরণ ( মুসলিম দুই ঈদ, অর্থোডক্স ও ক্যাথলিকদের ক্রিসমাস), সেনাবাহিনী, হাসপাতাল ও কারাগারে ধর্মীয় বিধিনিষেধ অনুসারে খবার বরাদ্দকরণ ।
১১) অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৮৯ সালে গৃহীত সংস্কার প্রস্তাব সমর্থন করার পাশাপাশি কৃষিখাতের উন্নয়নসহ বাণিজ্যিক কোম্পানিসমূহকে বেসরকারি খাতের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
১২) নারী শিশু ও বয়স্কদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ । যেমন পরিবারের সদস্যদের সংখ্যানুপাতে নারীদের কর্মদিবস বা কর্মঘণ্টা কমানো ইত্যাদি ।
১৩) পরিবারসমূহে নৈতিক মূল্যবোধ সংরক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান । পারিবারিক ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটায় এরকম সকল ধরণের অসঙ্গতি যেমন, অ্যালকোহল, পর্নোগ্রাফি মাদকাসক্তি ইত্যাদি দূরীকরণ । এ সমস্ত সামাজিক ব্যাধি নির্মূলে মাদকদ্রব্যে করবৃদ্ধি, বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধকরণ ও কতিপয় সুনির্দিষ্ট স্থান ও সময়ে নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি ।
১৪) অপরাধ আইনের পরিমার্জন করে যুগোস্লাভিয়া প্রণীত ১১৪, ১৩৩ ও ১৫৭ ধারাসমূহ বাতিল করে সকল নাগরিকের সমান রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিতকরণ ।
১৫) পরিবেশ সুরক্ষায় এর সকল নেতা- কর্মী প্রত্যেকে পরিবেশকর্মীর ভূমিকা পালন করবে ।
১৬) ঘোষিত উপরিউক্ত মূলনীতিসমূহ সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে । অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তি সমূহের সাথে সমন্বয় করেই ঘোষিত মূলনীতি বাস্তবায়ন করা হবে । আমরা স্মাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ঘৃণা এবং প্রতিশোধের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক পন্থায় বিশ্বাস করি ।
[সূত্রঃ- বইঃ আলিয়া ইজেতবেগভিচ ও বসনিয়া, লেখকঃ নুরুল হুদা হাবীব ]
আরও পড়ুন-
বসনিয়ার মুসলিম নেতা আলিয়া ইজেতবেগভিচের রাজনৈতিক দল Party of Democratic Action (SDA) উপরের যে মূলনীতিগুলো নিয়ে মুসলিম ও অমুসলিমদের সামনে হাজির হয়েছে তার কোনওটা কি ইসলামের পরিপন্থী? না; বরং প্রতিটি মূলনীতি ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকেই আহ্বান করছে । কিন্তু তিনি সেগুলো উপস্থাপনের সময় ইসলাম শব্দ ব্যবহার না করে গণতন্ত্রিক মূল্যবোধ,গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুরক্ষা, শিক্ষা সংক্রান্ত সংকট দূরীকরণ, আইনের শাসন সুনিশ্চিতকরণ, মানুষদের সমঅধিকার নিশ্চিতকরণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পারবারিক নৈতিক মূল্যবোধ গঠন ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেছেন । তিনি বসনিয়ার জনগণের মানসিকতা অনুসারে শব্দ চয়ন এবং নিজের দলের দাওয়াতি কার্যক্রম করেছিলেন বলেই দল গঠনের মাত্র দুই বছরেই রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করতে সক্ষম হয় তার দল ।
বসনিয়া-হার্জেগোভিনার ইউনিভার্সিটি অব সারায়েভো এবং যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ডান্ডি থেকে পড়াশোনা করা গবেষক নুরুল হুদা হাবীব তার “আলিয়া ইজেতবেগভিচ ও বসনিয়া” বইয়ে উল্লেখ করেন, “আলিয়া ইজেতভেগভিচের গঠিত রাজনৈতিক দল কোন ইসলামী দল ছিল না । দলের ১৬ দফা মূলনীতি ও কর্মসূচীর কোথাও সেটা উল্লেখ করা নাই । এটি ছিল একটি গণতান্ত্রিক, উদারপন্থী মুসলিম জাতীয়তাবাদী দল । প্রশ্ন উঠতে পারে আলিয়া এতো বড় মাপের ইসলামী চিন্তক হয়েও কেন ইসলামী দল তৈরি করলেন না ? …… কট্রর কমিউনিস্ট শাসনের জাঁতাকলে ধর্মহীন পরিবেশে বেড়ে উঠা মানুষগুলোর জন্য ধর্মীয় পরিচিতি পাকাপোক্তকরণ, ধর্মীয় মূল্যবোধ ধারণ ও ধর্মীয় সংস্কৃতির চর্চায় ছিল মুখ্য আবেদন । … আলিয়া চেয়েছিলেন এ অঞ্চলের মুসলিমদের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের ধারণ-লালন এবং মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশ ।”
তিনি আরও বলেন,
“আলিয়া ইজেতবেগভিচ মুসলিম বিশ্বের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ । একদিকে গভীর চিন্তাবিদ, অপরদিকে রাষ্ট্রপ্রধান । মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের মধ্যে এ ধরণের দৃষ্টান্ত বিরল ।… বর্তমানে পশ্চিমা নয়া উপনিবেশবাদ, জাতীয়তাবাদ ও সেকুলারিজম মুসলিম বিশ্বের প্রায় সকল দিক ও বিভাগে প্রভাব বিস্তার করে ফেলছে …।
গবেষক নুরুল হুদা হাবীব বলেন,
“আলিয়াকে আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও সফল মুসলিম রাজনীতিবিদ বললে বোধ করি অত্যুক্তি হবে না । একটি বৃহৎ অঞ্চলে প্রথমে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, পরবর্তী সময়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বাধিকার ও আত্মপরিচয় সুরক্ষায় তিনি তার পুরোটা জীবন যেভাবে উৎসর্গ করে গেছেন, খিলাফতপরবর্তী মুসলিম বিশ্বে সেটি প্রায় বিরল । …[ বইঃ আলিয়া ইজেতবেগভিচ ও বসনিয়া]
গবেষক নুরুল হুদা হাবীব আরও বলেন,
“আলিয়ার চিন্তার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, তিনি ইসলামের মৌলিক মূলনীতি অক্ষুণ্ণ রেখে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার যুগোপযোগী সমাধান খুঁজতে চেয়েছেন । স্বয়ং কোরআন মুসলিমদের জন্য এ সুযোগ রেখেছে বলে তিনি মনে করতেন । তিনি তার “The Islamic Declaration” গ্রন্থে বলেছেন, “ইসলামে কিছু মৌলিক বিষয় রয়েছে যেগুলো অপরিবর্তনীয় । তবে রাজনীতি, অর্থনীতি বা সমাজনীতির জন্য এরকম অকাট্য কোনো বিধান নেই- যেটা সকল সময়ের জন্য একযোগে দিয়ে দেয়া হয়েছে । ইসলামের কোনো উৎসে এ জাতীয় কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না । এ কারণে ভবিষ্যতে মুসলিমদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতির জন্য গৃহীত পদক্ষেপ অতিতের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হবে না । প্রতিটি যুগে মুসলিমদের কাজ হল ইসলামের অপরিবর্তনীয় বিধানসমূহ পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে বাস্তবায়নের জন্য নতুন নতুন পথের সন্ধান করা । আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে অবশ্যই এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে । ” [ বইঃ আলিয়া ইজেতবেগভিচ ও বসনিয়া, পৃষ্ঠাঃ ১৯৩-১৯৪]
বাংলাদেশী জনপ্রিয় মুফতি কাজী ইব্রাহীমও তার এক বক্তব্যে বলেন “ রাজনীতি হচ্ছে ইজতিহাদের বিষয় … এক মুজতাহিদ আর এক মুজতাহিদের ইজতিহাদকে বাতিল ঘোষণা করতে পারে না ।”
আলিয়া,এরদোয়ান ও মুরসির মতো বাংলাদেশেও এমন নেতার আবির্ভাব হওয়া সময়ের দাবী । তাদের হাতে এই মুহূর্তে এমন একটি দল গঠন খুবই জরুরী যারা মানুষের গণতান্ত্রিক ও সমতার অধিকার এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বলে মূলত ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের পথে বাংলাদেশকে এক ধাপ এগিয়ে দিবে এবং সাধারণ জনগণের জন সমর্থন পেয়ে ১-২ বছরের মধ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে সক্ষম হবে ।
বাংলাদেশে দশকের পর দশক ধরে কোনও কোনও ইসলামী রাজনৈতিক দল কাজ করে যাচ্ছে । ১৯৭১ এর আগে পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ছিল জামায়াতে ইসলামী । বর্তমানে অনেকগুলো ইসলামী দল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কাজ করছে । এতো বছর রাজনৈতিক অঙ্গনে কাজ করেও ৯০ % মুসলিমের দেশেও কেন কোনও ইসলামী দল রাজনৈতিকভাবে জয়লাভ করতে পারছে না ? সেটা কি বাংলাদেশের মুসলিমদের ইসলামী রাজনীতি গ্রহণে অনীহা? নাকি দলগুলোর বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বনে অদক্ষতার কারণে তার উত্তর খোঁজা ও সমাধান বের করা খুব জরুরী ।
লেখকঃ লেখক ও সম্পাদক, মহীয়সী ডটকম
…………………………………………………………………………………………………………………………
মহীয়সীর প্রিয় পাঠক! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল, আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ গল্প ও কবিতা পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেইজ মহীয়সী/Mohioshi-তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হ্যাঁ, মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইল-
[email protected] ও [email protected] -এ; মনে রাখবেন, “ধন দৌলত খরচ করলে কমে যায়, কিন্তু জ্ঞান বিতরণ করলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়”। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনি জ্ঞান দান করেন।” (সহিহ বুখারী- ৭১, ৩১১৬, ৩৬৪১, ৭৩১২, ৭৪৬০; মুসলিম- ১০৩৭; ইবনে মাজাহ- ২২১) ।
মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম; আজই আপনি যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে। আসুন, ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি। আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমীন।