Ads

মানুষ বদলায় না, খোদা বদলে যায়

।। আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ।।

প্রায় প্রতিটি ধর্মে দেখা যায়, যারা ওপরের দিকে থাকেন, অর্থ্যাৎ ধর্মগুরু, ইমাম, পুরোহিত, যাজক, তারা ধর্মকে ধর্মের পথে চলতে দেন না। শাসক যদি চান যে এখন থেকে “দ্বীন-ই-ইলাহি’ই রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্যের ধর্ম, উপরোক্ত শ্রেনির ধর্মগুরুরা “দ্বীন-ই-ইলাহি’র শানে বয়ান দিতে শুরু করেন। শাসক ধর্মকে যেভাবে কাজে লাগাতে চান, ধর্মগুরুরা সেভাবে মানুষের কাছে ধর্মের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেন। এটি প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত একইভাবে চলে আসছে। এজন্য সম্ভবত ধর্মকে অনেকে ব্যবসা এবং ধর্মগুরুদের বলেন ‘ধর্ম ব্যবসায়ী’। পাশ্চাত্য জগতে এ সম্পর্কে বাক্য প্রচলিত আছে, “Religion is a smart business idea. They sell an invisible product and if it does not work they blame it on the customer.” (ধর্ম এক চৌকস ব্যবসায়িক ধারণা। তারা অদৃশ্য এক পন্য বিক্রয় করে এবং এটি যদি কাজ না করে, তাহলে তারা গ্রাহকের ওপর দোষ চাপায়।) এক উর্দু কবি বলেছেন:

“জরুরত কে মোতাবেক দোয়া বদল জাতে হ্যায়,

জো লোগ খুদ নেহি বদলতে খুদা বদলতে রাহে।”

(প্রয়োজন অনুযায়ী দোয়া বদলে যেতে থাকে,

যে নিজে বদলায় না, তার খোদা বদলে যায়।)

জালালুদ্দীন রুমি তাঁর মসনবীতে একটি কাহিনি উল্লেখ করেছেন যে, এক মসজিদে ইমাম সাহেব মাগরিব নামাজে ইমামতি করার সময় ফরজ নামাজের প্রথম রাকাতে সুরা আত-তাওবা থেকে তিলাওয়াত করেন, “বেদুইনরা কুফরি ও মুনাফেকিতে সেরা এবং আল্লাহ তাঁর রাসুলের ওপর যা নাজিল করেছেন, সেগুলো শেখার যোগ্যতাসম্পন্ন নয়। কোনো বেদুইন এমনও আছে, যারা আল্লাহর নামে ব্যয় করাকেও (জাকাত) জরিমানা, ক্ষতি ও বোঝা বলে বিবেচনা করে এবং কারও ওপর কোনো বিপদ আসে কিনা, তা দেখার অপেক্ষায় থাকে। তাদের ওপরই বিপদ নেমে আসুক।”

এক বেদুইন কয়েক কাতার পেছনে নামাজে দাঁড়িয়েছিল, সে এগিয়ে এসে ইমামের কানের ওপর প্রচণ্ড মুষ্টাঘাত করে।

দ্বিতীয় রাকাতে ইমাম সাহেব তিলাওয়াত করেন, “তবে, কোনো কোনো বেদুইন আল্লাহ ও কিয়ামতের ওপর ঈমান আনে এবং নিজেদের ব্যয়কে আল্লাহর নৈকট্য ও রাসুলের আশীর্বাদ লাভের উপায় বলে বিবেচনা করেন আল্লাহ তাদেরকে তাঁর অনুগ্রহের অন্তর্ভূক্ত করবেন।” বেদুইন বলে উঠে, “এই তো, এক ঘুষিতে ইমামের হুশ ঠিকানায় এসেছে।”

আরও পড়ুন-

ইসলামী সংস্কৃতির জয়-পরাজয়

অন্য ধর্ম প্রসঙ্গে আলোচনা করার যোগ্য ব্যক্তিবর্গ অবশ্যই আছেন, তারা তাদের ধর্ম ব্যাখ্যা করবেন। বাংলাদেশে যারা একটু বেশি ইসলাম চর্চা করেন, তারা কম চর্চাকারী অথবা আদৌ চর্চা করেন না, এমন লোকজনকে ‘মুমিন’ বিবেচনা করা তো দূরের কথা, ‘কাফির’ তূল্য বিবেচনা করতেও দ্বিধা করেন না। পেটে ক্ষুধা, মসজিদের সামনে মুসল্লিদের কাছে ভিক্ষা প্রার্থনাকারীকে ধমক দিয়ে বলে, “নামাজ পড়িস ব্যাটা!” মাঝে মাঝেই একটি কৌতুক শুনি, “এক ভিখারি মসজিদ, মন্দির, গির্জার সামনে ভিক্ষা চেয়ে চেয়ে পায়নি, হতাশ হয়ে শুড়িখানার সামনে গিয়ে বসেছে। মদপান করে মাতাল হয়ে এক একজন বের হচ্ছে, ভিখারি ভিক্ষা চাইতেই মাতালরা পকেট থেকে একশ’, পাঁচশ’ টাকার নোট বের করে তাকে দিয়ে দিচ্ছে। ভিখারি খুশি এবং বিস্মিত। সে বলে, ‘ওপরওয়ালা, তুমি কোথায় থাকো, আর কোন কোন জায়গার ঠিকানা দিয়ে রাখো।’” কবি বলেছেন:

“ও ক্যায়সে লোগ হ্যায় জিনহে বন্দেগি পছন্দ হ্যায়,

হাম তো শরম-ই-দামনগীর হ্যায় খুদা হোতে।”

(ওরা কেমন মানুষ, যারা প্রশংসা পছন্দ করে,

আমাকে খোদা হতে বললেও তো লজ্জায় গুটিয়ে যাব।)

কোরআনে বহুবার ‘জিহাদ’ (যুদ্ধ) এবং ‘কাতিলু’ ‘কাতিলুনা (হত্যা) শব্দগুলো এসেছে। প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় থেকে  ও পরে  ওয়াজ মাহফিলে ওয়ায়েজিনদের আল্লাহর আরশ কাঁপানো নিনাদে ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ বা আল্লাহর পথে যুদ্ধ এবং ‘আল্লাহর পথে তাদেরকে হত্যা (কাতিলু) করো, যারা তোমাদের হত্যা করে। তবে সীমা লংঘন করো না,” ইত্যাদি আয়াতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শুনে আসছি। কিন্তু আমাদের ভূখণ্ডে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে ইসলামের ব্যাখ্যার পরিবর্তন আইয়ুব খানের সময় থেকে হয়ে আসছে। বিশেষ করে গত দেড় দশকে ধর্মের ব্যাখ্যা সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। কোরআনের পরিভাষা ‘জিহাদ’কে পরিণত করা হয়েছে মহাতঙ্কে। আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ঘরে, ছাত্রাবাসে এবং বলতে গেলে যেকোনো স্থানে ‘জিহাদি’ কিতাব পেয়েছে, তা শিক্ষাক্রমে পাঠ্য হলেও অনুরূপ কিতাবের মালিক, রক্ষকদের পাইকারি গ্রেফতার, রিমাণ্ডে নিয়ে ‘ডিম্ব থেরাপি’ এবং ‘ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে ‘স্বাধীন’ কাজী সাহেবদের এজলাসে হাজির করার ‘আইনের শাসন’ এর চর্চা শুরু হওয়ার পর থেকে বাঘা বাঘা ইসলামী পন্ডিতরা ‘জিহাদ,’ ও ‘কাতিলু’র অর্থ ও তফসির পাল্টে ফেলেছেন। তারা ‘হুকুমতে ইসলাম’ বা ইসলামী রাষ্ট্রে সত্য ও অন্যায়ের এবং ইসলাম ও হুকুমতের বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে যুদ্ধকে বলেন ‘জিহাদ-ই-আসগর’ বা ছোটো যুদ্ধ এবং ‘নফস’ (কুপ্রবৃত্তি) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধকে বলেন ‘জিহাদ-ই-আকবর’ বা বড়ো যুদ্ধ। অতএব তারা জিহাদের ময়দানকে সংকুচিত করে, সেই ‘জিহাদ-ই-আকবরের’ ময়দানকে যার যার অন্তরে বসিয়ে দেন। বাংলাদেশ কোনো ‘হুকুমতে ইসলাম’ নয়, এটা হলো ‘হুকুমতে লা-দ্বীনিয়া,’ বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানে জিহাদের স্থান ও সুযোগ নেই।

আরও পড়ুন-

কোরআন ও হাদিসের আলোকে গবেষণার গুরুত্ব

আমি টেলিভেশনে মরহুম মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকীর একটি আলোচনা শুনেছিলাম। তিনি ‘কাতিলু’ ও ‘কাতিলুন’ শব্দের যে অর্থ বোঝালেন, ‘বোঝালেন’ বললে ভুল হবে। কারণ আমি আমার যৎকিঞ্চিত জ্ঞানে তার বয়ানের মহিমা বুঝতে পারিনি। বরং বলা ভালো ‘তিনি বললেন’ এবং আমি শুনলাম। তার বক্তব্য ছিল ‘কাতিলু’ বা ‘কতল’ শব্দগুলোর অর্থ ‘হত্যা’ করা নয়। এর বুৎপত্তিগত অর্থ বুঝতে হলে ‘আরবি’ ভাষা সম্পর্কে জানতে হবে। তিনি আরও বলেন ‘কাতিলু’ শব্দটি এসেছে আরবি ‘কেতাল’ থেকে, যার অর্থ কোনোভাবেই ‘হত্যা’ করা নয়। আমি এখন আরবি ভাষার বুৎপত্তি কোথায় কার কাছে লাভ করি? অথবা ক’জন মুসলমানের পক্ষে শব্দের নিগূঢ় অর্থ জানা সম্ভব। শতকতা ৯৯.০৯ শতাংশ মুসলমানই তো ‘শোনাউল্লা’ মুসলমান। ‘কাতিলু’ এবং ‘কেতাল’ এর সংঘর্ষে তাদের তো রফাদফা হয়ে যাবে! হে ওপরওয়ালা, পরওয়ারদিগার! তুমি রক্ষা করো!

রামায়ণের কাহিনিতে দেখা যায়, রাবণের কবল থেকে সীতাকে উদ্ধার করে অযোধ্যায় নিয়ে আসার পর প্রজাদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয় যে, এতদিন পর্যন্ত রাবণ সীতাকে আটকে রাখলো, তাঁকে কিছুই করেনি! রাক্ষস রাজা রাবণ, সীতার রূপে মুগ্ধ হয়ে, তাকে উড়িয়ে আনলো লঙ্কায়, আর এমনি এমনি ছেড়ে দিল? রাম সত্যের অবতার, স্ত্রীর সতীত্ব নিয়ে প্রজা সাধারণের যে সন্দেহ তা ভঞ্জনের জন্য তিনি নির্ণয় করেন যে, সতীত্বের প্রমাণ দিতে সীতাকে অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। সীতা কষ্ট পান, কারণ রাবণের রাজ্যে রামের স্মরণই তাকে পুত:পবিত্র রেখেছে। রাবণ তার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেননি। অতএব তিনি পৃথিবীর প্রতি আহবান জানান তাকে ভূতলে আশ্রয় দেওয়ার জন্য। পৃথিবী বিদীর্ণ হয় এবং তিনি পাতালে প্রবেশ করেন। আমি যে সত্য জেনে এসেছি, তা এখন অসত্যে পরিণত হলে কোথায় আশ্রয় নেব, তা ভেবে আমি দিশেহারা। মনে মনে বলি: “হে ওপরওয়ালা, মুঝে উঠা লে।”

এই ডামাডোলের মধ্যেই এক কোরআন গবেষকের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। তিনি দুনিয়া জুড়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত কোরআন বিতরণের মহান দায়িত্ব পালন করেন। মাশাআল্লাহ! এক সমাবেশে আমি তাঁর কাছে ‘আল্লাহর পথে তাদেরকে হত্যা (কাতিলু) করো, যারা তোমাদের হত্যা করে,” আয়াতের যথার্থতা এবং কোরআনের ‘কাতিলু’ ও ‘কাতিলুন’ শব্দ সম্পর্কে মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকীর ব্যাখ্যা সত্য কিনা, তা জানতে চাই। কিন্তু মহান কোরআন সেবক সযত্নে আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যান। আমার যা বোঝা প্রয়োজন ছিল, তা বুঝতে আমার কষ্ট হয় না। শাসকের মর্জি ধর্মেরও নিয়ামক।

আরও পড়ুন-

সন্তানের সাথে কথা বলার অভ্যাস গড়বেন যেভাবে

ধর্মগুরুরা যে কেবল রাজশক্তির ইশারায় উঠেন-বসেন, তা নয়, ধর্মকে তাদের স্থায়ী হাতিয়ার হিসেবে টিকিয়ে রাখতে যা খুশি তাই বলেন ও করেন। ধর্মকে তারা ‘মৌরুসি পাট্টা’ বা পুরুষানুক্রমে ভোগদখলের বন্দোবস্ত করে নিয়েছেন। চোখের সামনে এক ঘটনা ঘটতে দেখে হা হয়ে গিয়েছিলাম। এক আধুনিক শিক্ষিত বিদ্বজন ‘হাউশ’ করে কোরআনের আমপারার বাংলা তরজমা করলেন এবং যথাবিহিত তা প্রকাশিত হলো। ধর্মগুরুরা হামলে পড়লেন। তারা বললেন, ‘উনি কোরআন তরজমা করার কে? কোরআনের কি বোঝেন উনি। উনার ইসলামী লেখাপড়া নাই। উনি কোনো মুফাসসির নন’  ইত্যাদি। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে তো আমি বলতেই পারি, ধর্মগুরুদের ধর্ম ধর্মগুরুরাই পালন করুন। কোরআন -কিতাব তারাই নাড়াচাড়া করে খাক। আমি কেন কেবল ‘শোনাউল্লা’ হয়ে ধর্ম পালন করবো। মনের দু:খে মাঝে মাঝে আহমদ ফরাজের কবিতা আউড়াই:

“বন্দেগি হামনে ছোড় দি হ্যায় ফরাজ,

কিয়া কারে লোগ জব খুদা হো জায়ে।”

(আমি প্রার্থনা ছেড়ে দিয়েছি, ফরাজ,

মানুষ খোদা হয়ে গেলে কি করবো?)

লেখকঃ উইকলি বাংলাদেশ, নিউইয়র্ক এর উপদেষ্টা সম্পাদক, অনুবাদক, লেখক এবং প্রবাসী বাংলাদেশী, ইউএসএ

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে  লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ  লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে লেখক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

আরও পড়ুন