Ads

ষড়যন্ত্রের কবলে বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষা ।। ১ম পর্ব  

।। ড. মো. নূরুল আমিন ।।

মাদরাসা শিক্ষা সম্পর্কে এখন আমি কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। ইসলামের প্রাথমিক যুগে আধুনিককালের প্রাতিষ্ঠানিক ধরনের মাদরাসা ছিল না বললেই চলে। বহু আলেম বা ওস্তাদ নিজেরা গৃহ নির্মাণ করে সেখানে হাদিসের বর্ণনা শুনাতেন এবং ফিকহের অধ্যাপনা করতেন। এ ছাড়া মসজিদসমূহ ছিল জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রস্থল। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে  ফাতেমী সুলতানদের আমলে প্রাচ্যে মাদরাসা ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। ১০০৫ সালে আল হাকিম একটি সুন্নী দারুল ইলম মাদরাসা স্থাপন করেন। নিশাপুরে আল শাইথ আল নিশাপুরীর জন্য একটি বিশিষ্ট  শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। আবু আলী হুসায়নী ১০০৩ সালে হাদিস শিক্ষা দানের জন্য একটি শিক্ষায়তন স্থাপন করেন।

দ্বীনি প্রতিষ্ঠান হিসাবে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সাথে সালজুক সুলতান আলপ আরসালান ও মালিক মাহের প্রধানমন্ত্রী নিজামুল মুলক এর নাম বিশেষভাবে জড়িত। তিনি ইমামুল হারামাইন ও আল জুয়াবনির জন্য ১০৬৫-৬৭ সালে নিজামীয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। নিজামুল মুলক এর  সময় এবং তার অব্যবহিত পরে ইরাক, খুরাশান, আল জাজিরা প্রভৃতি স্থানে মাদরাসা ব্যবস্থা বিস্তৃতি লাভ করে। হিজরী অষ্টম শতাব্দীতে পূর্বাঞ্চলে বহু মাদরাসা বিদ্যমান ছিল। এর মধ্যে নিজামিয়া মাদরাসা ছিল সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। খলিফা আলমুসতানসির ১২৩৪ সালে সুলতান সিরিয়া নামক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। হালাকু খান কর্তৃক বাগদাদ বিধ্বস্ত করার পরও নিজামিয়া ও মুসতানসিরিয়া মাদরাসা বিদ্যমান ছিল। তাতারগণ বহু মাদরাসা ধ্বংস করা সত্ত্বেও হিজরী অষ্টম শতাব্দীতে পূর্বাঞ্চলে বহু মাদরাসা বিদ্যমান ছিল। মোঘলগণও অনেক মাদরাসা স্থাপন করেন। সমরকন্দে তীমুর বংশীয় সুলতানদের আমলে মাদরাসাগুলো সর্বাধিক সমৃদ্ধি লাভ করে। হিজরী পঞ্চম শতকে ও পরবর্তীকালে ইরাক ও সিরিয়ার নগরসমূহে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা প্রসারিত হয়। দামেস্ক শহরে নূরুদ্দীন জংগী (১১৪৬-১১৬৩) এবং সালাহউদ্দিন (১১৭৪-১১৯৩) মাদরাসা প্রতিষ্ঠাকল্পে উদার বদান্যতা প্রদর্শন করেন।

আরও পড়ুন-

সংকটের কবলে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা ।। ১ম পর্ব

নিজামুল মুলকের পরে আলাউদ্দিনের নাম মাদরাসা প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি জেরুজালেমে মাদরাসা প্রবর্তন করেন। সালাহউদ্দিনের সময় হিজাজ প্রদেশেও মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৩৪৯ সালে ইউসুফ আল হাছান স্পেনের গ্রানাডা নগরীতে একটি বিরাট মাদরাসা স্থাপন করেন।

মাদরাসাতে অধিত বিষয় সমূহের মধ্যে কুরআন হাদিস ছিল প্রধান। পরে কিতাবে কালামের বিকাশের সাথে এ দু’টি বিষয় এবং আরবি ভাষাও যুক্ত হয়। ধীরে ধীরে মাদরাসার পাঠ্যসূচীতে উলম আত তাবিঈয়াত ও উলম আন নকলিয়া স্থান পায়। উলুম আত তাবিঈয়াত ছিল বস্তুসমূহের স্থিতি, গতি বিদ্যা, জ্যোতিষ্ক, মানুষ, ইতর প্রাণী, উদ্ভিদ, খনিজ পদার্থ, কৃষি বিদ্যা ও ভেষজ বিদ্যা ইত্যাদি। উলম আল নকলিয়া বলতে বুঝানো হয় কুরআনকে, এর আনুষঙ্গিক তাফসির এবং তাজবীদ, হাদিস  ও তার আনুষঙ্গিক উসুলে হাদিস, ফিকাহ, ইজতিহাদ কিয়াস, ফারায়েজ ও কালাম শাস্ত্র। অর্থাৎ মাদরাসার লক্ষ্য ছিল এবং এখনো আছে সব ধরনের জ্ঞান অর্জন তা আধ্যাত্মিক হোক বা জাগতিক হোক। এই কারণেই আমরা মাদরাসা থেকে উপহার পেয়েছি ইমাম আবু হানিফা, মালেক প্রমুখের মত ইমামদের, বোখারী, মুসলিম, আবু দাউদ প্রমুখ মুহাদ্দিসদের, হানিফ, সাদী গাজ্জালী প্রমুখ কবি দার্শনিকদের, অন্য দিকে তেমনি পাই ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ ও ওমর খৈয়াম প্রমুখ অসংখ্য বৈজ্ঞানিক, চিকিৎসক, গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদদের।

আমার এখানে ইতিহাসকে টেনে আনার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ কথা বলা যে ইসলামের প্রচার প্রসার ব্যক্তি এবং মুসলমানদের আকিদা বিশ্বাস ও জীবনাচারকে ইসলামী ছাঁচে ঢালাই করার ক্ষেত্রে মাদরাসা অতীতে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এখনো করছে। মানব জাতির জন্য যে জ্ঞান উপকারী তারা তারই প্রসার ঘটাচ্ছে।

একটু অতীতে ফিরে যাই। ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল আমার ই-মেইলে মুসলিম মিল্লাতের অন্যতম বরেণ্য শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ অগ্রজ প্রতীম জনাব শাহ্ আবদুল হান্নানের কাছ থেকে ‘Please fight against this conspiracy’ শীর্ষক একটি মেইল পেয়েছিলাম। মেইলে তিনি ওই দিনের প্রথম আলো পত্রিকায় ‘মাদরাসার উপযোগী করতে পাঠ্যবই-এ অদ্ভুত পরিবর্তন’- শিরোনামে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে ইসলামবিদ্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন-

ইতিহাসের অজ্ঞতা গোলামী ডেকে আনতে পারে ।। ১ম পর্ব

মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যক্রমে তখন সময়োপযোগী কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল। তাকে পথভ্রষ্ট করার জন্য মহলবিশেষের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তার সজাগ দৃষ্টি সকল মহলে প্রশংসিত হয়েছে বলে আমি মনে করি। বস্তুত বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশ এবং এদেশের শতকরা ৯২ ভাগ মানুষ মুসলমান। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামের মৌলিক বিধি-বিধান শিক্ষা ও দিকদর্শনের প্রতিফলন হওয়া বাঞ্ছনীয়। পাশাপাশি এই শিক্ষা শিক্ষার্থীদের আধুনিক ও বৈষয়িক জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করে একটি উন্নত জাতি হিসেবে দেশকে গড়ে তুলতে অবদান রাখতে সহায়তা করবে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা। এজন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা ও কর্মকৌশলতা, যোগ্যতা এবং অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠক্রম মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করবে। দেশবাসী দীর্ঘদিন ধরে এই কামনা করে আসছে। দুর্ভাগ্যবশত শুধু বাংলাদেশ আমল নয়, পাকিস্তান আমলেও এই লক্ষ্য অর্জনে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা এবং তার পাঠক্রমকে আমরা ঢেলে সাজাতে পারিনি। এর জন্য শাসক শ্রেণী যেমন দায়ী, তেমন আমরাও দায়ী। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সামগ্রিকভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দ্বিধা-বিভক্ত।

আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার নামে যে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে তা মূলত স্বাধীন, স্বনির্ভর ও আত্মমর্যাদাশীল জাতি গঠনের জন্য তৈরি করা হয়নি বরং একটি কেরানিগোষ্ঠী তৈরির জন্যই তা প্রণয়ন করা হয়েছিল এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে অবয়ব পরিবর্তন করে তা এখনও অব্যাহত রয়েছে।

মাদরাসা শিক্ষাও দ্বিধা-বিভক্তি থেকে রক্ষা পায়নি। এখানে সরকারি ও বেসরকারি দু’টি পদ্ধতি বিদ্যমান এবং সরকারি পদ্ধতিটি ১৭৮০ সালে বৃটিশরা প্রবর্তন করেছিলেন তাদের ধাঁচে লোক তৈরি করার উদ্দেশে। বেসরকারি পদ্ধতিটি আমাদের বিজ্ঞ আলেম-সমাজ ইসলামের স্বকীয়তা রক্ষা করে আলেম সৃষ্টির জন্য তৈরি করেছিলেন। এ দু’টি পদ্ধতির ক্ষেত্রেও বেশ কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছে যার অনেকটাই অভিপ্রেত ছিল না।

ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞান গবেষণা, সমীক্ষা ও অধ্যয়নের বেশির ভাগই হয়েছে আরবী, উর্দু ও ফার্সি ভাষায়। আমরা আধুনিকতার নামে ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার উপর অত্যধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, মাদরাসা শিক্ষাকে এবং আলেমদের অনেকটা আরবী, ফার্সি ও উর্দুমুক্ত করে ফেলেছি।

আরও পড়ুন-

সংকটের কবলে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা ।। ১ম পর্ব

বলাবাহুল্য ভাষা কোন অঞ্চলের সম্পদ নয়, এটা মানবজাতির সম্পদ। জ্ঞান অন্বেষণের জন্য ভাষার ব্যুৎপত্তি অপরিহার্য। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের আলেমদের বেশির ভাগই এখন ইসলামের এই তিনটি ভাষায় কথা বলতে পারেন না। যেমন পারেন না এগুলো লিখতে, বুঝতে অথবা এগুলো থেকে অনুবাদ করতে।

পরের পর্ব পড়ুন-

ষড়যন্ত্রের কবলে বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষা ।। ২য় পর্ব 

চলবে…

[ ৭ পর্বের এই ধারাবাহিক আর্টিকেল পড়তে নিয়মিত যুক্ত থাকুন মহীয়সীর সাথে ]

লেখকঃ প্রাবন্ধিক , গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব  এবং সিনিয়র সহকারী সম্পাদক, দৈনিক সংগ্রাম

…………………………………………………………………………………………………………………………

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সামাজিক পারিবারিক নানা বিষয়ে লেখা আর্টিকেল ,আত্মউন্নয়নমূলক অসাধারণ লেখা, গল্প  ও কবিতা  পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi  তে লাইক দিয়ে মহীয়সীর সাথে সংযুক্ত থাকুন। আর হা মহীয়সীর সম্মানিত প্রিয় লেখক! আপনি আপনার পছন্দের লেখা পাঠাতে পারেন আমাদের ই-মেইলে-  [email protected]  ও  [email protected] ; মনে রাখবেন,”জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম ।” মহীয়সীর লেখক ও পাঠকদের মেলবন্ধনের জন্য রয়েছে  আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম ; আজই আপনিও যুক্ত হয়ে যান এই গ্রুপে ।  আসুন  ইসলামী মূূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রজন্ম গঠনের মাধ্যমে সুস্থ,সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি । আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা সৎ কাজে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে চলো ।” (সূরা বাকারা-১৪৮) । আসুন আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে সমাজে অবদান রাখতে সচেষ্ট হই । আল্লাহ আমাদের সমস্ত নেক আমল কবুল করুন, আমিন ।

ফেসবুকে লেখক ড. মো. নূরুল আমিন

আরও পড়ুন