Ads

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

।। সুমাইয়া সুলতানা তামীমা ।।

ভূমিকা:

সকল জাতির জন্য মাতৃভাষা একটি রহমত স্বরূপ। জন্মের পর একটি শিশু তার মায়ের কাছ থেকে যে ভাষা আয়ত্ত করে তাকে মাতৃভাষা বলে। আর এটি হলাে একটি জাতির স্বদেশি ভাষা। মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রতিটি জাতি, গােষ্ঠী তার স্বীয় ভাব আদান-প্রদান করে থাকে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। এমনি এমনি হয়নি তবে এটা। পৃথিবীর ইতিহাসে আমরাই একমাত্র জাতি যাদের পূর্বপুরুষরা শুধুমাত্র ভাষায় জন্য রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে শহীদ হয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ভাষার জন্য সর্বপ্রথম রক্ত দিয়েছে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে। তাই রক্তের সম্মানার্থে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নাড়া দেয়ায় ইউনেস্কো বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। যা বাংলা ভাষাকে মর্যাদার সুউচ্চ পর্বতে আসীন করেছে। প্রতি বছর সারা বিশ্বে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে মহা আনন্দে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস:

একুশ মানেই হলো- পরাশক্তির কাছে মাথা নত না করা। একুশ একটি বিদ্রোহ, বিপ্লব ও সংগ্রামের নাম। ‘একুশ’ হল মায়ের ভাষায় ভাষায় কথা বলার জন্য রাজপথ কাপানো মিছিল। ভাষা আমাদের অস্তিত্বের একটা অংশ। মানুষের যতগুলাে আত্মপরিচয় থাকে, তার মধ্যে ভাষা অন্যতম। তার দেশ, জাতি, ধর্ম, পরিবার যেমন তার আত্মপরিচয়, তেমনি ভাষাও। আর নিজের আত্মপরিচয় প্রতিটা মানুষের কাছেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। একুশ আমাদের সেই আত্মপরিচয়ের অধিকার অর্জনের মাইলফলক। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দানের জন্য শহীদ হওয়ায় একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছিল। সেই শহিদ দিবসই আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং প্রতিবছর বিশ্বের বহু দেশে তা পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সাধারণ অধিবেশনের গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে মাতৃভাষার জন্য অভূতপূর্ব আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং সেদিন যারা প্রাণ উৎসর্গ করেছেন তাদের স্মৃতির উদ্দেশে দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘােষণার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবটি ২৬টি দেশের সমর্থনসহ ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশ কর্তৃক উত্থাপিত হয় এবং অধিবেশনে উপস্থিত সব সদস্যের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে প্রস্তাবটি সঙ্গে সঙ্গেই গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবের ফলে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেক ভাষাশহিদের রক্তে রাঙানাে অমর একুশ বিশ্ব ইতিহাসে এক নতুন মর্যাদা পেয়েছে। নতুন সহস্রাব্দে বাঙালি জাতির চির গৌরব মহান ভাষা আন্দোলন বিশ্ববাসীর চেতনায় এক নব মহিমায় উদ্ভাসিত হবে।

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রথম ২১ উদ্যাপিত হয় ১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে । ১৯৯২ সাল থেকে ত্রিপুরায় ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করা হচ্ছে। তবে সরাসরি একুশের আন্তর্জাতিক মর্যাদার প্রথম দাবি আসে বাংলাদেশের গফরগাঁও থেকে। ১৯৯৭ সালে একুশের এক অনুষ্ঠানে গফরগাঁও থিয়েটার নামক সংগঠন একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মর্যাদার দাবি উত্থাপন করে। ১৯৯৯ সালের একুশের সংকলন ‘প্রচ্ছদ’ ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস চাই, একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই’ স্লোগান মুদ্রিত করে। গফরগাঁওয়ের নাট্যকর্মীরা একুশের বিশ্ব মর্যাদার দাবি করে শােভাযাত্রা বের করেন।

‘মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’ নামে কানাডার একটি সংগঠন ইউনেস্কো কর্তৃক মাতৃভাষা দিবসকে আন্তর্জাতিক করার পিছনে অনেক অবদান রেখেছে। এ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দুজন বাঙালি যুবক রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম। তারা একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দানের জন্য প্রথমে সংগঠনের দশজন বিদেশিকে নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে অনুরোধ পাঠান। সেখান থেকে বিষয়টি পাঠানাে হয় ইউনেস্কোতে। কিন্তু সেখান থেকে জানানাে হয় কোনাে সংগঠন নয়, সদস্য দেশ থেকে প্রস্তাব যেতে হবে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ থেকে প্রস্তাবটি ইউনেস্কোতে পেশ করা হয় এবং পরিণামে তা বাস্তবায়িত হয়।

এই সংগঠন ২৯ মার্চ ১৯৯৮ জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ নামে একটি দিবস ঘােষণার প্রস্তাব করেন। এভাবে কেটে যায় একটি বছর। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার, ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ । বাংলাদেশ ন্যাশন্যাল কমিশন ফর ইউনেস্কোর পক্ষে-এর সচিব। অধ্যাপক কামালউদ্দিন আহমদের স্বাক্ষরসহ ১৭ লাইনের প্রস্তাব ও যৌক্তিকতার গুচ্ছটি প্যারিস পৌঁছে যায়। প্রস্তাবের শেষ লাইনটি ছিল—

“প্রস্তাব করা যাচ্ছে যে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যারা নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন তাদের স্মরণে এ দিনটি বিশ্বজুড়ে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার জন্য ঘােষণা দেওয়া হােক।”

ইউনেস্কোর নির্বাহী বাের্ডের ১৫৭তম অধিবেশন এবং ৩০তম সাধারণ সম্মেলনে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। অনেক বাধা আসে, কিন্তু সকল বাধা পেরিয়ে ১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯ সেই কাক্ষিত ঘােষণা আসে। প্রস্তাবক হিসেবে মূল অধিবেশনে বাংলাদেশের সাথে সৌদি আরবের নামও যুক্ত হয়। প্রস্তাবকের সমর্থক হয় ভারত, পাকিস্তানসহ ২৭টি দেশ। ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ধারণা সমুন্নত করার লক্ষ্যে ইউনেস্কো প্রতিবছর এ দিনে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে আসছে।

২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম ইউনেস্কোর প্রধান কার্যালয় প্যারিসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটি পালন করা হয়। সেবছর থেকে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতেও মর্যাদার সঙ্গে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার গুরুত্ব:

আমাদের জীবনে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মূল পরিচয় হচ্ছে তার মাতৃভাষা। মাতৃভাষা জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মানুষের এক মৌলিক সম্পদ।

পৃথিবীর বুকে ভিন্ন একটি জাতিসত্তা হিসেবে পরিচয় দিতে বা মাথা তুলে দাঁড়াতে প্রথমেই যেটি প্রয়োজন সেটি হচ্ছে তার “ভাষা”।সেক্ষেত্রে নিজস্ব কোন ভাষা না থাকলে পৃথিবীর বুকে আলাদা জাতিসত্বা হিসেবে পরিচয় দেয়া যাবেনা। আর একটি জাতিকে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে নিঃশেষ করে দিতে তার ভাষাটা শেষ করে দেয়াটাই যথেষ্ট। ভাষা বেঁচে থাকলে তবেই একটি জাতি বেঁচে থাকতে পারবে। ভাষার মাধ্যমে একটি জাতি বাঁচে। আর আমাদের ভাষাগুলোকে নিঃশেষ করতে রাষ্ট্রযন্ত্রের ষড়যন্ত্রের কোন শেষ নেই। তাই আমাদের ভাষাগুলোকে টিকিয়ে রাখতে বৃহত্তর আন্দোলনেরও বিকল্প নেই।

আর নিজের মতৃভাষাটাকে সম্মান করতে হলে অন্যের মাতৃভাষাটাও সম্মান করা প্রয়োজন।অন্যের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান দেখালে তবেই নিজের ভাষা সম্মান করা আশা করা যায়।

বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রচলিত প্রায় সাড়ে তিন হাজার ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষা অন্যতম স্থান অধিকার করে আছে। বাংলা ভাষা পৃথিবীর সর্বাধিক সমৃদ্ধ ভাষাগুলোর একটি। এ ভাষায় চল্লিশ কোটি মানুষ কথা বলে। এর শব্দ সংখ্যা এক লাখ সত্তর হাজার। কারো মতে দু’লাখেরও বেশি। আবার কেউ কেউ বলেন বাংলা ভাষার শব্দ সংখ্যা চার লাখের কম হবে না।

বাংলা ভাষা বাঙালি জাতির কাছে শুধু একটি ভাষাই নয়, এর সাথে মিশে আছে বাঙালি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সবকিছু। কেননা, এই বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাঙালি জাতি। বাংলাদেশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জাতীয় জীবনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের দেশে স্ব স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার উপর বাংলা ভাষায় পাঠাদান খুব বেশি জোরদার করা উচিত। আমি মনে করি একজন মানব শিশুর শিক্ষার বিকাশ ঘটে ৩/৪ থেকে ৯/১০ বছরের মধ্যে। তখন যদি এদের মাতৃভাষার গুরুত্ব বুঝাতে অক্ষম হই তাহলে এই অবজ্ঞা সে সারাজীবন বয়ে বেড়াবে।

ভাষা ও সংস্কৃতির ওপরে এই আগ্রাসন থেকে বাঁচতে হলে মুক্তির পথ আমাদের নিজেদেরই খুঁজে নিতে হবে। এখনই চেষ্টা না করলে অনেক বেশি দেরি হয়ে যাবে। নিজেদের আত্মপরিচয় নিয়ে নিজেদের গর্বিত হতে হবে। নিজের অস্তিত্বকে ভালােবাসতে হবে। আমাদের সন্তানদের আমাদের শেকড়ের সঙ্গে, অস্তিত্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। আমরা যদি আমাদের আত্মপরিচয়ে গর্বিত না হই, তাহলে আমাদের সন্তানদের কাছ থেকে আমরা কী আশা করতে পারি? আসুন বাংলাকে ভালােবাসি, বাংলা চর্চা করি দৈনন্দিন জীবনে। শুধু একটি দিনে ভালােবাসা দেখিয়ে, বাকি তিনশ চৌষট্টি দিন তাকে ভুলে গেলে হবে না। বছরের প্রতিদিন চলুন ভালােবেসে বাংলা বলি, বাংলা গান শুনি, নাটক দেখি, চলচ্চিত্র দেখি, বই পড়ি, মন থেকে ভালােবাসি আমাদের নিজেদের পরিচয়।

ভাষার ব্যবহার কিন্তু শুধু বলাতেই সীমাবদ্ধ নয়। লেখাতেও নয়। মানুষ কী ভাষার গান শােনে, রেডিও শােনে, টিভি দেখে, চলচ্চিত্র দেখে, বই পড়ে বা ইদানীং বলা যায় টেক্সট মেসেজ করে, ফেসবুকের পােস্ট লেখে; এগুলোর সঙ্গেও জড়িত। সেদিক দিয়েও বলা যায়, আমরা বাংলাকে হারাচ্ছি, আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের নিজস্ব অস্তিত্ব। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ইংরেজি ও হিন্দি গান বাংলা গানের চেয়ে অনেক অনেক বেশি জনপ্রিয়। চলচ্চিত্র বা টিভি দুটো মাধ্যম অনেক আগেই দখল করে নিয়েছিল হিন্দি, সেই সঙ্গে এখন যােগ হয়েছে ইংরেজিও। পােশাক-আশাক সাজসজ্জাও হতে হবে সেই রকম। আর অনুষ্ঠান মানেই হিন্দি গানের সঙ্গে নাচ, হিন্দি সিনেমার অনুকরণে নাচ। বাঙালি সংস্কৃতি কই? বাঙালি গান কই?

রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ততক্ষণ পর্যন্ত বরদাস্ত করা হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই স্বাধীনতা রাষ্ট্রের ক্ষতি না করছে। যেহেতু বাংলা ও ইংরেজি ভাষার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব সমান নয়, সেহেতু এ দুটি ভাষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব অবশ্যই বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বিভক্তি ও বৈষম্য সৃষ্টি করার সম্ভাবনা থাকবে। যে কোনো ধরনের বিভক্তি ও বৈষম্য সমাজ ও রাষ্ট্রের অগ্রগতি ব্যাহত করে। কারও কুড়াল কেনার সঙ্গতি আছে বলেই রাষ্ট্র তাকে কুড়াল কিনতে দিতে পারে না। রাষ্ট্র যদি নিশ্চিত জানে যে, অন্যের বা নিজের পায়ে মারার উদ্দেশ্যেই দেশি ও বিদেশি উদ্যোগে সে কুড়াল জোগাড় করা হচ্ছে।

শিক্ষার মাধ্যম নির্বিশেষে বাংলাদেশের যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর শিক্ষার্থীকে রাষ্ট্রভাষা বাংলায় লিখতে ও পড়তে শেখানোর বাধ্যবাধকতা আরোপ করার বিকল্প নেই। বাংলাদেশে শৈশব ও কৈশোর অতিক্রান্ত হয়েছে এমন যে নাগরিক বাংলা ভাষায় গ্রহণযোগ্যভাবে লিখতে ও পড়তে জানে না, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে সে অশিক্ষিত বা মূর্খ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত।

তুর্কির মতো সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী জাতিরা তাদের মাতৃভাষার প্রতি এতটাই শ্রদ্ধাশীল যে দুজন তুর্কি ভাষাভাষী যখন একসাথে থাকে তখন তারা অন্য কোন ভাষা ব্যবহার করবে তা কল্পনাও করা যায়না। অসম্ভব! শ্রেণীতে বাধ্যতামূলক না হলে ইংরেজী/ আরবীতে পাঠদান করবে এমন শিক্ষক হয়তো হাতেগোনা। সবচেয়ে বড় কথা হলো তুর্কি ভাষায় আপনি যেকোন গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের অনুবাদ পাবেন। জ্ঞানকে তারা নিজ ভাষায় আয়ত্ব করতেই ভালোবাসে। যদিও বিদেশী ভাষা শিক্ষার ব্যপারেও সম্প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছ। কিন্তু তারা নিজেদের ভাষাকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে, নানাভাবে সমৃদ্ধ করতে তাদের চেষ্টার কমতি নেই। ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে নিজেদের সংস্কৃতিকেও সমৃদ্ধ করা চাই। তুর্কি সিরিজগুলো এখন সারা বিশ্বের দ্বারে কতটা জনপ্রিয় তা সম্ভবত আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। সেই সিরিজটাও তাদের মাতৃভাষার।

এই জায়গাতে আমাদের বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। আমরা কোন ভদ্র পরিবেশে বাংলা বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করিনা। একটু ইংরেজী বলতে পারলে কিংবা ইংরেজীতে দুয়েক-লাইন কোটেশন দিলে আমরা বাহবা দেই শিক্ষা, বিচার বিভাগ ইত্যাদিতে বাংলা উপেক্ষিত। ভালো কোনো চাকুরীর সন্ধান করুন দেখবেন ইংরেজি না পারায় আপনি আটকে গেছেন। সাহিত্য ভান্ডারে অনুবাদ বিভাগেও সেরকম বিকাশ ঘটেনি ফলে নিজ ভাষায় বিদেশি বিখ্যাত লেখকদের বইগুলো তৃপ্তির সাথে পড়তেও পারিনা। বাংলা ছবির মান ভয়াবহ রকমের খারাপ। সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দি কিংবা অন্যান্য ভাষার চলচিত্র, নাটক ইত্যাদিতে আমরা এতবেশী আশক্ত যাতে ছোট বাচ্চারা, বউ-মারা হিন্দি পর্যন্ত বলতে পারে।

একটি জাতির সমৃদ্ধির জন্য ভাষার সমৃদ্ধি অনেক বেশী জরুরী। আসুন বাংলাকে ধারণ করি, বাংলায় বলি এবং লিখি। বাংলা সেই ভাষা যাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে রক্ত পর্যন্ত দিতে হয়েছে। আসুন শহীদদের ত্যাগের মূল্যয়ণ করি, একুশকে ধারণ করি, বাংলাকে ভালোবাসি। ইংরেজি শিক্ষাও দিবেন কিন্তু ওতোটা জোর জবরদস্তি করে নয়‌। উচ্চ পর্যায়ের সব ভাষাতে বাংলা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হই।

“ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,

এ ভিখারী-দশা তবে কেন তাের আজি?

যা ফিরে, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে! “

~মাইকেল মধুসূদন দত্ত; কত সুন্দর করে বলেছেন।

দুঃখের বিষয়, স্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম এই উপলব্ধিটা থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। নিজেদের আসল পরিচয় কী এটা নিয়ে তাদের কোনাে মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয় না।

শিক্ষার মাধ্যম নির্বিশেষে বাংলাদেশের যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর শিক্ষার্থীকে রাষ্ট্রভাষা বাংলায় লিখতে ও পড়তে শেখানোর বাধ্যবাধকতা আরোপ করার বিকল্প নেই।

 

একটি জাতির সমৃদ্ধির জন্য ভাষার সমৃদ্ধি অনেক বেশী জরুরী। আসুন বাংলাকে ধারণ করি, বাংলায় বলি এবং লিখি। বাংলা সেই ভাষা যাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে রক্ত পর্যন্ত দিতে হয়েছে। আসুন শহীদদের ত্যাগের মূল্যয়ণ করি, একুশকে ধারণ করি, বাংলাকে ভালোবাসি। ইংরেজি শিক্ষাও দিবেন কিন্তু ওতোটা জোর জবরদস্তি করে নয়‌। উচ্চ পর্যায়ের সব ভাষাতে বাংলা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হই।

মাতৃভাষায় শিক্ষার ভিত রচনার গুরুত্ব নিছক দেশপ্রেম বা ভাষাপ্রেমের মতাে বিমূর্ত ভাবের বিষয় নয়, ফেব্রুয়ারি মাসের গালভরা বুলি নয়; এই গুরুত্ব বাস্তবিক, ব্যবহারিক, প্রায়ােগিক এবং বৈষয়িক। আমরা যারা বৈষয়িক বিবেচনায় সন্তানের ‘উজ্জল ভবিষ্যৎ চাই, অর্থাৎ পেশাজীবী হিসেবে সন্তানের সাফল্য দেখতে চাই এবং একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই তাকে লেখাপড়া শেখাই, তাদের চিন্তাভাবনা বদলানাের সময় এসেছে।

বাংলাদেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক– প্রতিটি পাঠে বাংলা ব্যাকরণের মোড়কে সংস্কৃত ব্যাকরণের পুনরাবৃত্তি তেমন তো করায়ই না। যদি কেউ অল্প একটু করায় তাও মুখে মুখে। এতে যে সময় বেহুদা নষ্ট হয়, সেটা লিখে শেখানোর কাজে ব্যবহার করা যেত। শব্দ গঠনের যে অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে তা মুখে মুখে বললেই কেউ পারে না। ব্যাকরণগত শিক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে ব্যাকরণ পারবে না সে তো বাংলা ভাষাও ভালো মতন ব্যবহার করতে পারবে না। তাহলে সে কিভাবে একজন সত্যিকারের বাংলাদেশী হতে পারে? ছাত্ররা লিখতে জানে না, কারণ আমরা তাদের লিখতে শেখাই না। শুধু লিখতে কেন; শিক্ষার্থীদের আমরা যুক্তিসম্মতভাবে, গুছিয়ে কথা বলতেও শেখাই না। এই দোষ প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে যায়। কারণ রোগই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়।

উপসংহার:

শুধু বাংলা ভাষাকে নয়, পৃথিবীর সকল ভাষার নিজস্ব মহিমা অক্ষুন্ন রাখার দীপ্ত শপথ নেবার দিন হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতিসংঘের বিজ্ঞান , শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো মাতৃভাষাগুলাের অধিকার এবং একে মর্যাদাপূর্ণভাবে টিকিয়ে রাখতে যে অনন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা সমগ্র বিশ্বের ভাষাপ্রবাহে অসামান্য অবদান রাখবে। আজ তাই বাঙালি জাতি, মাতৃভাষা এবং বিশ্বের অন্যান্য ভাষার প্রতি সম্মানের দায়িত্ব শতগুণে বেড়ে গেল। একই সঙ্গে এই দিন বিশ্বের বৃহৎ ভাষাগুলাের পাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিপীড়িত , অবহেলিত ভাষাগুলােও সংঘবদ্ধভাবে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা খুঁজে পাবে। বাঙালি হিসেবে আজ আমাদের সবার অঙ্গীকার সর্বস্তরে বাংলা-ভাষার প্রচার ও প্রসার।

লেখকঃ সুমাইয়া সুলতানা তামীমা, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, সরকারি বিএম কলেজ, বরিশাল।

 

মহীয়সীর প্রিয় পাঠক ! সমাজ, পরিবার ও নিজেকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য নানা ধরণের

আর্টিকেল পড়তে মহীয়সীর ফেসবুক পেজ মহীয়সী / Mohioshi এ লাইক দিন  এবং

আমাদের ফেসবুক গ্রুপ মহীয়সী লেখক ও পাঠক ফোরাম এ যুক্ত হয়ে আমাদের সাথেই থাকুন ।

আরও পড়ুন