Ads

কে এই ইব্রাহিম রাইসি?

এম আর রাসেল 

ইব্রাহিম রাইসি একইসাথে ধর্মীয় নেতা, বিচারক ও রাজনীতিবিদ। কর্ম জীবনের দীর্ঘ সময় জুড়ে তিনি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিচার বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি দেশটির প্রধান বিচারপতি।

রক্ষণশীল শিবিরের প্রভাবশালী নেতা ইব্রাহিম রাইসি ইরানের বিখ্যাত মাশহাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেছেন। শহরটির সাথে শিয়াদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঘটনার যোগ আছে। শিয়াদের ৮ম ইমাম আলি আল রেজার কবর এই শহরে। শিয়াদের একমাত্র ইমাম যিনি ইরানে শায়িত আছেন। মাশহাদ নামের পিছনে ইমামের কবরস্থানের একটি ভূমিকা রয়েছে। মাশহাদ অর্থ ‘শহীদদের কবরস্থান’। শিয়া ইতিহাস বলছে ইমাম রেজাকে বিষাপানে হত্যা করা হয়েছে এই শহরে।

আব্বাসীয় খলিফা মামুন ইমামের কবর ঘিরে দরগা তৈরি করেন। কালক্রমে এই দরগা আজও শিয়াদের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। পাহলভী বংশের প্রতিষ্ঠাতা রেজা শাহের বিরুদ্ধে এই দরগা থেকেই বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছিল বর্তমানেও এই দরগাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান আসতান-ই কুদস-ই রাজাভি। প্রতিষ্ঠানটি ইমাম রেজার দরগা রক্ষণাবেক্ষণ করে।

ইতিহাস ও সংগ্রামের জৌলস ছড়ানো ভূমি মাশহাদের আলো বাতাসে বেড়ে উঠেছেন ইব্রাহিম রাইসি। কুম শহরের শিয়া মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় পাহলভী রাজবংশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের পর আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছেন। রাইসি নিবিড়ভাবে ধর্মীয় জ্ঞান আয়ত্ত করেছেন। তিনি হোজ্জাত- আল- ইসলাম উপাধি ধারণ করেন। এর অর্থ ‘ইসলামের প্রামাণ্য অবয়ব’।

ধর্মীয় পদমর্যাদার স্তরক্রমে তাঁর অবস্থান সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির পরেই। শিয়া ঐতিহ্য অনুযায়ী তিনি কালো পাগড়ি পরেন। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি নিজেকে আয়াতুল্লাহ বলেও পরিচয় দিয়েছেন। এই উপাধি সাধারণত দ্বাদশী শিয়া ইসলামের উচ্চপদস্থ নেতারা ব্যবহার করেন। শিয়া ইসলামের অসংখ্য ভাগের মধ্যে বৃহত্তম হল ইসনা আশারিয়া বা ইমামিয়া। দ্বাদশী শব্দটি দিয়ে ইমামিয়া অনুসারীদের ১২ জন নেতাকে বোঝানো হয়, যারা ঐশ্বরিক ভাবে মনোনীত।

বিপ্লব পরবর্তী বছর ১৯৮০ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে রাইসি কারাজ শহরের প্রসিকিউটর জেনারেল হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে গঠিত বিপ্লবী আদালতের ডেপুটি প্রসিকিউটর, ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত তেহরানে প্রসিকিউটর জেনারেল, ২০০৪ সাল পর্যন্ত জুডিশিয়াল অথরিটির ডেপুটি চিফ ও ২০১৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় প্রসিকিউটর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২০১৬ সালে রাইসি ইরানের অন্যতম সম্পদশালী প্রতিষ্ঠান আসতান-ই কুদস-ই রাজাভি দেখাশোনার দায়িত্ব পান। ধর্মীয় কাজের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি বহু দাতব্য কাজও পরিচালনা করে। বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে নির্মাণকাজ, বিদ্যুৎ, কৃষি, জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ ও আর্থিক ব্যবস্থাসহ বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিচালনাও সাথেও প্রতিষ্ঠানটির নাম জড়িয়ে আছে।

সবকিছু ছাপিয়ে পশ্চিমাদের কাছে রাইসি মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে পরিচিত। ২০১৯ সালে এই কারণে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছেন। মানবাধিকরা সংগঠনগুলোর দাবি তিনি ১৯৮৮ সালের বিপ্লবী আদালতের বিচার কার্যে বহুসংখ্যক মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।

রাইসি সঠিক কতজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন তার প্রকৃত সংখ্যা জানা যায় না। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এক তথ্য মতে, এই সংখ্যা প্রায় ৫০০০। যার বেশিরভাগই ছিলেন মুজাহেদিন-ই খাল্ক (এমইকে) এর সদস্য। ২০১৯ সালে এই দলের প্রতিনিধিরা প্যারিসে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ৮০০ রাজনৈতিক বন্দীর ছবি প্রদর্শন করেন। রাইসির প্রতি অভিযোগের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘সেই সময়ের সর্বোচ্চ নেতার জারি করা ফতোয়া অনুযায়ী এই মৃত্যুদন্ডাদেশ যুক্তিসঙ্গত ছিল।’ অন্যদিকে ২০১৭ সালে ফাঁস হওয়া এক অডিও টেপে সেই সময়ের ডেপুটি সুপ্রিম লিডার আলি মন্তাযেরি মতামত শুনতে পাওয়া যায়। তিনি এই মৃত্যুদণ্ডাদেশকে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অপরাধ’ বলে অভিহিত করেছেন।

২০০৯ সালে সংস্কারপন্থী নেতা ইরানের সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী মীর হোসাইন মুসাভি নেতৃত্বে গ্রিন মুভমেন্ট আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে সংগঠিত এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের আটক করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। পক্ষপাতমূলক এই বিচারের জন্য রাইসিকে অভিযুক্ত করা হয়।

রাইসি ২০১৭ সালের নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলেন। ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি হাসান রুহানির নিকট পরাজিত হয়েছিলেন। পরাজয় বরণ করলেও ২০১৯ সালে সুপ্রিম লিডার রাইসিকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেন। ২০২১ সালের নির্বাচনে রাইসি ৬১.৯৫ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। উল্লেখ্য, এবারের নির্বাচনে বিপ্লব পরবর্তী সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে। ভোটের শতকরা পরিমাণ মাত্র ৪২ শতাংশ। বিপ্লব পরবর্তী প্রথম নির্বাচনে ৯৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল। সর্বশেষ ২০২৭ সালের নির্বাচনে ৭০ শতাংশ মোট পড়েছিল।

 আরও পড়ুনঃ উপসাগরীয় রাজনীতিতে ইরান ফ্যাক্টর ও হরমুজ প্রণালী 

আরও পড়ুন