Ads

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা

।। আসাদ পারভেজ ।।

একজন গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে দেশের নানা পত্রিকায় বেগম জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে আবেদন জানিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেছিলাম। বিশেষ করে ‘খালেদা জিয়ার সুচিকৎসা’ হেড লাইন দিয়ে ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতীয় পত্রিকা নয়া দিগন্তে সর্বপ্রথম একটি উপ-সম্পাদকীয় কলাম লিখি। সেসব আবেদনে লিখেছিলাম, তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা করে দিলে জনতার কাছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার যেমন গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে, তেমনি দেশ ও জাতির মঙ্গল হবে। অবশেষে ২বছর ১মাস ১৭দিনের মাথায় বেগম জিয়াকে মুক্ত বাতাসে বিচরণ করার পথ সুগম করে দিয়েছেন। এতে করে ফেইজবুক দুনিয়াতে বিএনপিপন্থি লোকদের নানা মতের পরেও দেখা যাচ্ছে, অসংখ্য নেতা ও কর্মীরা আপনাকে কৃতজ্ঞার সাথে সাধুবাদ জানিয়েছে। প্রথমদিকে সবকিছু আদালতের এখতিয়ারে থাকার কথা বলা হলেও, পরিশেষে সরকারের বিশেষ উদ্যোগে যে বেগম জিয়ার মুক্তির ব্যবস্থা হয়েছে, তা নূন্যতম বিবেক-বুদ্ধি রয়েছে এমন সকলেই অনুভব করেন।

পৃথিবীর আদি থেকে আজ অবধি নাটকীয়তার ঘাটতি নেই বললেই চলে। কখনও কখনও মহানায়কদের পরাজয় ঘটেছে নাটকের রচয়িতাদের সুকেশৈলী মঞ্চায়নে। তবে জাহিলিয়াতের নাটকীয়তার বর্বরতাকে সততা, মেধা আর এক রবের সত্যবাণী প্রচারের মধ্য দিয়ে হার মানিয়েছেন নবি মুহাম্মদ সা.। তিঁনিই প্রথম বিশ্ব সভ্যতাকে করেছেন বিকশিত। কিন্তু আদর্শ আর হীনমন্যতার লড়াই আজও চলমান।

আদি আর মধ্যযুগ পেরিয়ে সভ্যতার শীর্ষ পর্যায়ে মানবজাতির অবস্থান কী-না জানি না। কিন্তু দেশে দেশে রাষ্ট্রনায়কদের আজকের কর্মকাণ্ড স্পষ্টভাবে পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করছে। সকল তন্ত্রকে পেছনে রেখে গণতন্ত্রের আড়ালে স্বৈরতন্ত্র আজ সবচাইতে বিকশিত ও শক্তিশালী। পৃথিবীর বেশকিছু দেশ এই গণতন্ত্রের বাতায়নে বিশ্বদরবারে নিজেদের শির করেছে উন্নত। স্পষ্টবাদী স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র কিংবা ফ্যাসিবাদের চাইতে গণতন্ত্রের লুকায়িত শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রের অধিবাসিদের চরমভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।
বহুদেশে এমনটাই চলছে। এমন শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে একজন শাসক প্রভাবশালী হয়ে উঠলেও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেন না। আর দীর্ঘস্থায়ী হতে গেলে সাম্রাজ্যের গায়ে ভেঙে পড়ার দাগ আঘাত আনে। ইতালির বেনিতো মুসোলিনি আর জার্মানির এডলফ হিটলারের কর্মকাণ্ড কে না জানে।

আমাদের দেশ কোন যে অজানা পথে তা অনেকেই জানেন না। যা কোনোভাবেই দেশ ও জাতির জন্য সুখকর হতে পারে না। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে; দেশের সার্বিক অবস্থা যখনই চরম নাজুকের পথে ধাবিত হয়, তখনই বিশেষ যেকেনো একটা ঘটনার অবতারণা হয়। যা অনেকের কাছে পূর্ব মঞ্চায়িত নাটক মনে হয়। গত একযুগ দেশ ও দেশের বাইরে অবস্থিত প্রায় আঠার কোটি বাংলাদেশি নাগরিক এই নিয়ে দৃশ্যমান অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অসংখ্য নাটকের অবতারণার মধ্যে বর্তমান সময়ে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, কারাবন্দি জীবন, ক্যাসিনোকাণ্ড একাকার হয়ে গেলো।

সমগ্র জাতি আজ ক্যাসিনোকাণ্ড আর দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ে রঙ তামাশায় ব্যস্ত। নামকরা বেশকিছু আওয়ামীপন্থি উদিয়মান নেতা তাস-জুড়া-মাদক ও নারী কেলেঙ্কারির মতো অপমানজনক কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। যাতে নৈতিকতার চরম অবক্ষয়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। কে জানে তাদের কর্মকাণ্ডে কত মানুষের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।

নিত্যপণ্যের বাজারে কোথাও চাহিদার সাথে জোগানের ঘাটতি নেই। এমতাবস্থায় অর্থনীতির ভাষায় মূল্যবৃদ্ধি হবার কথা নয়। তাহলে কেনো হচ্ছে এই মূল্যবৃদ্ধি? কেন দেশ প্রেম হারিয়ে যাচ্ছে? কেনো ন্যায়ের পথে সমাজ গড়া সম্ভব হচ্ছে না। জাতির অধিকাংশ মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়ে কেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত?

দীর্ঘদিন থেকে জনমুখে শুনে আসছি, সরকার কোনো বৃহৎ কিছুকে আড়াল করতে নাকি মিডিয়া ও জনগণকে অন্যদিকে ডাইভার্ট করে ব্যাতিব্যস্ত রাখে। আমি অবশ্য তা বিশ্বাস করি না। তবে ইদানিংকালে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো এমনটাই করে যাচ্ছে।

অফুরন্ত ভোগ-বিলাসের চিন্তা থেকে লোভ-লালসা দানা বেধেছে আমাদের মনে। যা থেকে সততা ও নৈতিকতাবোধের অবক্ষয়, অধ:পতন এবং মানুষে মানুষে বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা, সামজিক ও রাজনৈতিক অস্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার অভাব দীর্ঘদিন ধরে হৃদয়ে জেঁকে বসেছে।

সমাজ সংস্কারকরা সমাজ ও রাজনীতির মূল ব্যবস্থাকে অনৈতিক নব্য সামন্ততান্ত্রিক ধারা থেকে বের করতে পারেননি। একই সাথে সামাজিক চরিত্রের নৈতিক ও গণতান্ত্রিক উত্তরণও ঘটাতে পারেননি। এর বিপরীতে যাদের কাজ করার কথা তারা নিজেরাই লাইনচ্যুত।

দেশের স্থপতির কন্যার কাছে আমরা এমন মেধাশূণ্য কাজ আশা করতে পারি না। যদিও বিএনপি-জামায়াত’র মত দলগুলোর নেতা-কর্মীরা বলেন, এরাতো ভোটারবিহীন সরকার। আমি অবশ্য তা নিয়ে ভাবি না। আমার কথা হলো সরকার তো সরকারই। এই সরকার সৈরতান্ত্রিক কিংবা অগণতান্ত্রিক যাই হোক না কেনো।

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে যিনি বসে থাকবেন তার কাজ হলো- যা কিছু নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত এমন সবকিছুর হেফাজত করা। তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি, চলমান সরকার দেশকে জনবান্ধব করে তুলতে বেশকিছু আগাছা পরিষ্কার করে নিচ্ছেন। যা নিজ দলের অনেকের কাছে পছন্দনীয় না হলেও আমাদের কাছে গ্রহণীয়।

সরকার প্রধান ক্যাসিনো সম্রাটদের মুখোশ উন্মোচন করার কিছুটা সাহস দেখিয়েছেন। সাথে অনেক জনবান্ধব নেতারা যে রাতের অন্ধকারে কুকর্ম করেন, তা প্রকাশ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। মূল হোতাদের আটক করতে পারলে জনগণ এমন কাজের প্রসংশা অবশ্যই করবে। অত:পর বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা পাচার, শেয়ার বাজার ধ্বংস, যুবক ও হলমার্ক কেলেংকারী, নারী- শিশুর প্রতি নৃশংসতা, কিশোর গ্যাং, টর্চার সেল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ধোঁকাবাজি, মিথ্যাচার, নদী-জলাশয় দখল, শিক্ষার দুরবস্থা, স্বাস্থ্য খাতে অব্যস্থা, খাদ্যে ভেজাল, বৈষম্য, গুম-খুন-ধর্ষণ, প্রশ্নপত্রফাঁস থেকে শুরু করে অবৈধ সকল কাজে লিপ্তদের আইনের আওতায় আনবে বলে বিশ্বাস করি। এই ক্ষেত্রে অবৈধভাবে নির্বাচিতদের বাদ দিলেও জনগণ আপাতত মানবে।

কিন্তু মনে রাখতে হবে, দিনের শেষে এই জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। তাই জনগণকে বারবার ঠকানো যাবে না। জনগণের সবচাইতে ভালোবাসার জায়গায় আঘাত করে পৃথিবীর কোনো সম্রাট সামাজ্য রক্ষা করতে পারেনি।

বেগম খালেদা জিয়া ৭৭ বছর বয়সী একজন নারী, যিনি তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপির চেয়ারপারসন। অথচ আজ মুমূর্ষু অবস্থায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার বিরুদ্ধে ৩০টিরও অধিক রাজনৈতিক মামলার মধ্যে দুটিতে সাজাপ্রাপ্ত যার একটিতে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতের সাজা হাইকোর্ট আপিলে পাঁচ বছর বৃদ্ধি করে ১০ বছর হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে সাজা ভোগ করছেন। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের করা সকল মামলা থেকে শেখ হাসিনা মুক্তি পেয়েছেন। যা গণতন্ত্রের নীতি-নৈতিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

দেশের প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারায় মতে, ‘দণ্ডিত ব্যক্তির আপিল সাপেক্ষে আদালত লিখিতভাবে কারণ লিপিবদ্ধ করে আদেশ প্রদান করতে পারবেন যে, আপিলকৃত দণ্ড বা আদেশ কার্যকরীকরণ স্থগিত থাকবে এবং আসামি আটক থাকলে আরও নির্দেশ দিতে পারবেন যে তাকে জামিনে বা তার নিজের দেয়া বন্ডে মুক্তি দিতে পারবেন।’

দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা যে, হাইকোর্টে আপিল চলাকালে ফৌজদারি কার্যবিধিতে ৪২৬ ধারায় প্রদত্ত সুযোগ বেগম খালেদা জিয়ার ভাগ্যে জোটেনি। সে সুযোগ তিনি প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন অ্যাপিলেট ডিভিশন থেকেও পাননি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস কত প্রকার ও কী কী তা একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাথে সরকারের আচরণে ফুটে উঠেছে। জীবন সায়াহ্নে এসে বেগম জিয়ার সুচিকিৎসার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৌশলের কাছে বন্দি হয়েছে।

উচ্চ আদালতে জামিনে ব্যর্থ হয়ে বেগম জিয়া কারাবন্দী ছিলেন। বিএসএমএমইউ প্রিজন সেলে ভর্তি থাকা অবস্থায় অসুস্থতা বেড়ে গেলে পরিবারের আবেদনক্রমে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা মোতাবেক সরকারপ্রধান নির্বাহী আদেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে শর্তসাপেক্ষে দণ্ডাদেশ স্থগিত করে ৬ মাসের মুক্তি দেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা নিবেন। এবং বিদেশ যেতে পারবেন না। বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়া সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় জীবন সায়াহ্নে। মেডিক্যাল বোর্ড উন্নতমানের চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য সুপারিশ করেছে।

কেনো বেগম জিয়াকে বিদেশ নিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে? এমন প্রশ্ন জাগতেই পারে। তা দেশবাসীরও জানা উচিত।বেগম জিয়ার যে অসুখ, তা প্রধানত পরিপাকতন্ত্রের। কোন জায়গায় তার রক্তপাত হচ্ছে, তা নির্ধারণ করা আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ ডাক্তারদের পক্ষেও সম্ভব না। রক্তপাতের জায়গাটি চিহ্নিতকরণে যে ধরনের টেকনোলজির দরকার তা আমাদের দেশে মোটেও নেই। তাতে করে তাকে সুচিকিৎসা প্রদানে একটি ‘অ্যাডভান্স সেন্টারে’ নেওয়া দরকার। এজন্যে বিজ্ঞ ডাক্তাররা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা জার্মানীতে নেয়ার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।

সরকারের পক্ষে দৃঢ়তার সাথে আইনমন্ত্রী সংসদে বলছে, বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার প্রার্থনা যেহেতু ইতঃপূর্বে সরকার নামঞ্জুর  নিষ্পত্তি করেছে, সেহেতু এ বিষয়টি Re-open করে পুনর্বিবেচনার আইনগত কোনো বিধান নেই। আইনমন্ত্রীর এমন বক্তব্য আমি সঠিক বলে মনে করি না।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, ‘কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে সরকার যে কোনো সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত যা মেনে নেয় সেইরূপ শর্তে যে দণ্ডে সে দণ্ডিত হয়েছে, সেই দণ্ডের কার্যকরীকরণ স্থগিত রেখে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশবিশেষ মওকুফ করতে পারবেন।’

এ ছাড়াও উক্ত ৪০১ ধারার উপ-ধারা ৬-এ বলা হয়েছে যে, ‘সরকার সাধারণ বিধিমালা বা বিশেষ আদেশ দ্বারা দণ্ড স্থগিত রেখে এবং আবেদনপত্র স্থগিত রেখে এবং আবেদনপত্র দাখিল ও বিবেচনার শর্ত সম্বন্ধে নির্দেশ দিতে পারবেন।’

উক্ত আইনে শর্ত মওকুফ বা শর্ত শিথিল করার সম্পূর্ণ ক্ষমতা রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ অর্থাৎ সরকারের কাছে রয়েছে। আইনমন্ত্রী ওই আইন যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক না কেন সরকারপ্রধানের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার উন্নতমানের চিকিৎসার প্রশ্নে আইন প্রয়োগের বিষয়াদি।

সরকার এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশের চিকিৎসা অনেক উন্নতমানের। যদি তাই হয় তবে আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গসহ ধনী শ্রেণীর সবাই চিকিৎসা বা শরীর চেক-আপ করানোর জন্য অহরহ বিদেশে যাচ্ছেন কেন? যাদের অর্থ-কড়ি নেই তারাও তো শেষ সম্বল বিক্রি করে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। বিদেশে বেগম জিয়ার চিকিৎসার আবেদনটি কি বিবেচনাযোগ্য নয়?

সরকার বলতে চায়, নিষ্পত্তিকৃত বিষয়টি পুনঃবিবেচনা করার আইনি বিধান নেই। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় জামিনের অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে জামিন মঞ্জুর করার বিধান রাখা হয়েছে। ওই ধারায় শর্ত দেয়া হয়েছে যে, ‘আদালত এই দোষে (জামিনের অযোগ্য অপরাধ) অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তি ১৬ বছরের নিম্নবয়স্ক বা স্ত্রীলোক বা পীড়িত অক্ষম হইলে তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারবেন।

মানহানির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে জামিনযোগ্য ধারায় জামিন নিতে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট অহরহ জামিনযোগ্য ধারায় জামিন দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ সে আইন বেগম জিয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর হয়নি। তিনি অসুস্থ, নারী এবং শারীরিকভাবে কি অক্ষম নন? আইন কি তার প্রশ্নে স্বাভাবিক গতিতে চলছে?

দেশীয় সংবিধানের ১০৩ অনুচ্ছেদ মোতাবেক হাইকোর্ট বিভাগের রায়, ডিক্রি, আদেশ বা দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি ও তা নিষ্পত্তির এখতিয়ার আপিল বিভাগের রয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৫ মোতাবেক আপিল বিভাগ নিজ প্রদত্ত রায় বা আদেশ পুনঃবিবেচনা করার ক্ষমতা রয়েছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, সরকার সংশ্লিষ্ট আইনের ৪০১ ধারায় প্রদত্ত আদেশ কেন পুনঃবিবেচনা করতে পারবে না? সরকারপ্রধানের নানা কথায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, তার সদিচ্ছাই এখানে মুখ্য বিষয় হয়ে আটকে আছে বেগম জিয়ার চিকিৎসা।

সরকারের যদি সদিচ্ছার ঘাটতি না হয় তবে বেগম জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর আইনগত বহু রাস্তা খোলা আছে। আইনের কাছে মানবতা পরাস্ত হতে পারে না।   The Probation of offenders Ordinaance 1960 এবং The Probation of offenders Rules  ১৯৭৫ মোতাবেক সরকার যেকোনো সময় যেকোনো সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে মুক্তি দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরার সুযোগ দিতে পারে। অনুরূপ আইন পৃথিবীর সব রাষ্ট্রেই রয়েছে।

রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমা প্রদর্শনের অধিকার নিয়ে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত কোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বনা ও বিরাম মঞ্জুর করার অধিকার এবং যেকোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকবে।’ কিন্তু সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে সম্পূর্ণভাবে খর্ব করা হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনো পরামর্শ দান করেছেন কি না এবং করে থাকলে কী পরামর্শ দান করেছেন, কোনো আদালত সেই সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের তদন্ত করতে পারবেন না।’ সংবিধানের অত্র অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্রপতি কর্তৃক কোনো কারণেই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ব্যতীত ৪৯ অনুচ্ছেদে ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা প্রয়োগ করা যাবে না। ফলে ঘুরে ফিরে সব ক্ষমতাই প্রধানমন্ত্রীর উপরে বর্তায়। এ জন্যই সরকারি দল প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে সম্বোধন করে।

বেগম জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে আদেশ দিতে কেন অনীহা বা বিলম্ব, এ বিষয়টি নিয়েও পাবলিক পারসেপশনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। জনগণ মনে করে, বিদেশে উন্নতমানের পরীক্ষা নিরীক্ষা করালে কারারুদ্ধ অবস্থায় সরকার বেগম জিয়াকে অপচিকিৎসা দিয়েছে কি-না তা বের হয়ে আসতে পারে। ইতোমধ্যে বেগম জিয়াকে ‘স্লো পয়জন’ দেয়া হয়েছিল কি-না, সেই প্রশ্নটি বিএনপির মহাসচিব উত্থাপন করেছেন। সরকার হয়তো মনে করতে পারে যে, বেগম জিয়া এ দুনিয়া হতে যত তাড়াতাড়ি বিদায় নেবেন সরকারের জন্য ততই মঙ্গল। সরকারপ্রধান হয়তো ক্ষোভ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে বেগম জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে অনীহা প্রকাশ করছেন। তবে এখন যা হচ্ছে জাতির জন্য সৃষ্টি হবে এক খারাপ দৃষ্টান্ত।

বিগত ১/১১ সেনা সমর্থিত সরকারের সময় দুই প্রধানমন্ত্রী কারাবন্দী ছিলেন। আমার যতটুকু মনে পড়ে, শেখ হাসিনা (প্রধানমন্ত্রী) কারামুক্ত হয়ে সে সময় বলেছিলেন, তাকে স্লো পয়জন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য মোতাবেক বোঝা যায় যে, আমলাতান্ত্রিক এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য স্লো পয়জনের একটি গোপন পদ্ধতি কারাগার সংস্কৃতিতে বিদ্যমান রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘ দিন কারাবন্দী থাকাবস্থায় তাকেও স্লো পয়জন করা হয়েছে কি-না তা অবশ্যই সরকার নিয়ন্ত্রণমুক্ত উন্নতমানের হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যাবে। এ বিষয়টির কারণেও বেগম জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে বলে জনগণের মধ্যে একটি ধারণা ধীরে ধীরে বদ্ধমূল হচ্ছে।

দেশের জেলকোড অনুযায়ী বন্দীর স্বাস্থ্যের চিকিৎসা করার দায়িত্ব সরকারের। অসুস্থ অবস্থায় কোনো ফাঁসির আসামিকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানোর নিয়ম আমাদের আইনে নেই। কারাগারে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কারা কর্তৃপক্ষ কোনো বন্দীকে মেডিক্যাল অফিসারের সার্টিফিকেট ছাড়া শাস্তি কার্যকর করতে পারবে না।জেলকোডের ৫০ ধারায় উল্লেখ্য যে, শাস্তিমূলক খাবার একক বা যৌথভাবে, কিংবা বেত্রাঘাত, কিংবা ৪৬ ধারার (২) উপ-ধারার অধীন শ্রমের পরিবর্তনের কোনো শাস্তি সেই পর্যন্ত আরোপ করা যাবে না, যেই পর্যন্ত মেডিক্যাল অফিসার যে বন্দীকে শাস্তি দেয়া হবে তাকে পরীক্ষা না করেন। তিনি যদি মনে করেন যে বন্দী উক্ত শাস্তি গ্রহণের জন্য উপযুক্ত, তা হলে ১২ ধারায় বর্ণিত শাস্তি বইয়ের যথোপযুক্ত কলামে সেই অনুযায়ী সার্টিফিকেট প্রদান করবেন।

যদি তিনি মনে করেন, বন্দী শাস্তি গ্রহণের জন্য অনুপযুক্ত, তা হলে তিনি যথোপযুক্ত রেকর্ডে তার মতামত লিপিবদ্ধ করবেন এবং বর্ণনা করবেন যে, বন্দীকে যে ধরনের শাস্তি প্রদান করা হয়েছে তার জন্য সে একেবারেই অনুপযুক্ত বা তিনি কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন মনে করেন কি-না।
শেষের ক্ষেত্রে তিনি বর্ণনা করবেন, কী ধরনের শাস্তি বন্দী কোনো প্রকার শারীরিক ক্ষতি ছাড়া গ্রহণ করতে পারবে।’

সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ অসুস্থতার গ্রাউন্ডে যাবজ্জীবন সাজার অভিযোগে অভিযুক্ত এবং সাজাপ্রাপ্ত অনেক বন্দীকে জামিন দিয়েছেন, জেনে-শুনেই এ কথা বলছি। রাজনৈতিক কারণে রুজুকৃত মামলায় রাজনৈতিক সাজা হওয়ার কারণেই বেগম জিয়া আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। জীবন সায়াহ্নে সরকারের কারণেই আইন আদালত তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফলে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ উন্নতমানের বৈদেশিক চিকিৎসা এখন সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার ওপর।

সরকারের কাছে অনুরোধ করব, কোটি জনতার নয়ন মণি বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে এমন কিছু করবেন না; যা দেশ-জাতি কিংবা আপনাদেরও বিপদ ডেকে আনবে।
নাটকীয় কোনো সিনেমার আড়ালে তার যেন অস্বাভাবিক মৃত্যু না হয়। অতএব বড় কোনো ক্ষতি হবার আগে আমাদের খবর নিতে হবে বেগম জিয়া কেমন আছেন।
দুর্নীতি ও নিরাপত্তা এই জাতির সবচাইতে বড় সমস্যা। তা দূরকরণে সমস্যার শিকড় চিহ্নিত করতে হবে। যদিও দেরি হয়ে গেছে, তারপরও সমাধানের পথে হাঁটার প্রক্রিয়া বের করা জরুরি। না হয়, দেশের মধ্যে যে পরিমাণ পুকুর চুরি হচ্ছে, তা সাগর চুরিতে পরিণত হবে।

সরকার প্রধান আপনি তো বঙ্গবন্ধুর কন্যা। আপনার মনে ভালোবাসার ঘাটতি থাকার কথা নয়। মেধাহীন কোনো মানুষের কথা শুনে নিশ্চয় আপনি হৃদয়হীন হবেন না। বেগম জিয়ার মুক্তির পথ সুগম করে দিলে আপনার জনপ্রিয়তা বাড়বে কিন্তু কমবে না। তিনি গুরুতর অসুস্থ। তার কিছু হলে আপনি জাতি ও বিবেকের কাছে হেরে যাবেন। এতে করে আপনার বাবাও প্রশ্নবিদ্ধ হবেন। আপনার একটু চিন্তাশীল ভাবনা মমতাময়ী একজন মা সুচিকিৎসা পাবেন। একই সাথে জাতির ঘোরতর অন্ধকার কেটে যাবে, ইনশাআল্লাহ।

লেখকঃ আসাদ পারভেজ, গবেষক ও রাষ্ট্রচিন্তক

আরও পড়ুন-দিল্লিতে উগ্র হিন্দুত্বের তাণ্ডব

 

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা – খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা – খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা – খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা- খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা -খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা

আরও পড়ুন