Ads

টেক্সাসের ভয়ানক হত্যা-আত্মহত্যা- মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গী

এইচ বি রিতা 

মা-বাবা, নানী ও বোনকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যার পর টেক্সাসের বাঙালি পরিবারের দুই ছেলে সন্তান নিজেরাও আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনার আগে ফারহান তৌহিদ(১৯) ইনস্টাগ্রামে তার সুইসাইড নোটে লিখেছেন, ‘আমি নিজেকে ও আমার পরিবারকে হত্যা করেছি।’ আরও লিখেছিলেন কীভাবে তিনি নবম শ্রেণি থেকে মানসিক হতাশার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছিলেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইনস্টাগ্রাম পোস্টে ফারহান লিখেছিলেন, তাঁর বড় ভাই তানভীর তৌহিদ (২১) বলেছিলেন, ‘আমরা যদি এক বছরে সবকিছু ঠিক করতে না পারি, তবে আমরা নিজেদের ও পরিবারকে হত্যা করব।’
ইন্সটাগ্রাম পোষ্ট এবং সুইসাইডল নোট থেকে আমরা এখানে স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি যে, এটি একটি পরিকল্পিত ‘মার্ডার সুইসাইট।‘এখানে হত্যাকারী দুই ভাই দীর্ঘদিন ধরে হতাশায় ভুগছিলেন এবং এই হতাশা থেকে বেরিয়ে আসতে তারা একমাত্র মাধ্যম হিসাবে ‘হত্যা এবং আত্মহত্যা’কেই উত্তম পন্থা হিসাবে বেঁছে নিয়েছিলেন।

এখন কথা হচ্ছে, এই নির্মম ঘটনাটি কি একদিনে ঘটেছে? অবশ্যই না। ফারহান এবং তানভীরের চিন্তা-ধারার এই বিকৃত রুচি বা অধঃপতন বহু দিন ধরেই চলছিল। পরিবারের কেউ কি সেটা শুরুতেই লক্ষ্য করেছিলেন? এই ঘটনার দুই মাস আগেই তারা ইনস্টাগ্রাম পোষ্টে সেটার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। পরিবার, আত্বীয়, বন্ধু কারো নজরে কি পড়েনি? হতাশাগ্রস্থদের সুইসাইডাল লক্ষণগুলি মোটামোটি স্পষ্ট, সেটাও কি পরিবারে, বিশেষ করে তাদের মা-বাবার কারো নজরে পড়েনি? তবে কি এটা পারিবারিক অবহেলা ছিল? এখনো তদন্ত চলছে। কিছুই স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না যেহেতু পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। হৃদয় বিদারক এই ঘটনা থেকে এখন আমাদের অনেক কিছু ভাবার আছে। নিজেকে এবং নিজ পরিবারকে নিয়ে আরো গভীর ভাবে সচেতন হবার বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তারুন্যের উদ্দাম গতিশীলতা দিন দিন শিথীল হযে আসছে। আত্নহত্যার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। ২০১৩ সালের ন্যাশনাল ভাইটাল স্টেটিস্টিক রিপোর্ট পরিসংখ্যান দেখায় যে, মানসিক স্বাস্থ্য সংকটের কারণেই এই আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। প্রকৃতপক্ষে, আত্মহত্যা এখন কিশোর-তরুণদের মধ্যে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিডিসি’র তথ্য অনুসারে বিগত ২০০৭ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ১০ থেকে ২৪ বছরের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মাঝে আত্মহত্যার এই সংখ্যা ৫৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বিগত এক বছরে নিউইয়র্ক নগরীতে, বিশেষ করে বাঙালি কমিউনিটিতেও তরুণদের আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশ কিছু তরুণদের আত্মহত্যা ছিল হ্নদয় বিদারক।

সুইসাইডোলজি, মনস্তাত্ত্বিকবিদ এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, মানসিক অসুস্থতা আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষজ্ঞ মাইক্যাল মোসকোস, জেনিফার অ্যাকিলিস এবং ডগ গ্রে’র মতে, আত্মহত্যার দুর্ঘটনার কারণগুলির মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক কারণগুলি বিদ্যমান। ২০১৬ এর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ দ্বারা একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, আত্মহত্যার ঝুঁকির কারণগুলির মধ্যে হতাশা এবং অন্যান্য মানসিক ব্যাধি এবং সাবসটেন্স এভিউজ ব্যাধিটি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

মানসিক চাপ একটি মনস্তাত্ত্বিক উপলব্ধি এবং শরীরের প্রতিক্রিয়া। তবে এই দীর্ঘ মেয়াদী মানসিক চাপ আমাদের জীবনকে কতটা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে, তা হয়তো আমাদের জানা নেই। মানসিক চাপ থেকে শারীরিক সমস্যাগুলো বৃদ্ধি পায়। যেমন-মাথাব্যথা, হজমজনিত সমস্যা এবং ঘুমের স্বল্পতা। এটি বিভ্রান্তি, উদ্বেগ এবং হতাশার সৃষ্টি করার উৎস। আমেরিকান সাইকোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, চিকিৎসাবিহীন দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ এর ফলে উচ্চ রক্তচাপ এবং ইম্মিউন সিস্টেমের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি স্থূলত্বের নির্ভরযোগ্য উৎস এবং হৃদরোগেরও কারণ।

বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনাগুলোতে সব সময় সতর্ক করা হয় যে, আমাদের জীবনে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপের পাশে ব্যক্তিজীবনের উদ্বেগ(Anxiety) আমাদের ডিপ্রেশন এবং ডিমেনশিয়াজনিত সমস্যাগুলো বৃদ্ধির ঝুঁকি বাড়ায়। বেক্রেষ্ট হেলথ সায়েন্সেসের রটম্যান রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নেতৃত্বে পর্যালোচনাটিতে, পশু ও মানব গবেষণায় দেখা যায় যে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ, উদ্বেগ,এবং হতাশা আমাদের মস্তিষ্কের ক্ষেত্রগুলিকে মারাত্বকভাবে প্রভাবিত করে।
এখন বুঝতে হবে হতাশা(Depresion), মানসিক চাপ(Mental Strss), এবং উদ্বেগ(Anxiety) কি? আমরা অনেক সময় এই তিনটি বিষয়কে এক করে ফেলি। যদিও এরা একে অপরের সাথে জড়িত, কিন্তু এখানে সামান্য পার্থক্য বিদ্যমান। হতাশার অনেকগুলি সম্ভাব্য কারণ রয়েছে যেমন, জেনেটিক্স, মস্তিষ্কের রাসায়নিক এবং ব্যাক্তির জীবন যাপন পরিস্থিতি। দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ এর পরিস্থিতিগুলি যদি আমরা ভালভাবে মোকাবেলা করতে না পারি, তবেই হতাশার ঝুঁকি বাড়ে। অর্থাৎ হতাশা মানেই আমরা প্রচন্ড মানসিক চাপে থাকতে পারি, কিন্তু মানসিক চাপ মানেই যে হতাশা, তা নয়। আবার উদ্বেগ হতে পারে মানসিক চাপের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। উদ্বেগ হ’ল ভয়, এবং এর অনুভূতি। এটি আপনাকে অস্থির এবং উত্তেজনা বোধ করাতে পারে এবং দ্রুত হৃদস্পন্দন ঘটাটে পারে।

আমরা জানি যে, কিশোর বছরগুলি মূলত একটি মানসিক চাপের সময়। এ সময় তাদের দেহের পরিবর্তন, চিন্তার পরিবর্তন এবং অনুভূতির পরিবর্তন হয়। এ সময়টাতে পরিবার, বন্ধুমহল, স্কুল, বা স্বজনদের কাছ থেকে যে কোন ধরণের মানসিক চাপ, পারিবারিক কলহ, সম্পর্ক ভঙ্গন, তিরস্কার, বিভ্রান্তি, ভয় এবং সন্দেহমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুভূতি, যে কোন কিশোর-কিশোরীর সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু আমরা সে বিষয়গুলোকে একেবারেই প্রাধান্য দিচ্ছিনা।

এমনকি প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানটিকেও আমরা একটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতায় রাখতে চাচ্ছি। পড়াশুনা, চাকরীর সুবাদে আমাদের সন্তানরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও আমরা আবেগী হয়ে পরছি যেটা তাদের অগ্রগতির পথে অন্তরায়। এতে তারা বিরাট মানসিক সমস্যার পরছে। তৈরী হচ্ছে পিতা মাতার প্রতি অসন্তুষ্টকজনক ক্ষোভ, বিরক্তি ও হতাশার। কেউ কেউ এর সমাধানে বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যামূলক ভয়ংকর পথটি।
আমাদের জন্য মানসিক চাপ নতুন কোন ব্যপার নয়। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে যে হারে আত্মহত্যার প্রবনতা বাড়ছে, এটা অনেকের ক্ষনস্থায়ী মানসিক চাপকে দীর্ঘস্থায়ী করবে বলে মনে করছেন মনস্তত্ত্বিকবিদরা। এবং এতে করে হতাশার ঝুঁকি বাড়বে। তারপর আবারও ঘটবে এমন সব অনাকাঙ্ক্ষিত পারিবারিক ‘মার্ডার সুইসাইট।‘
এই মানসিক চাপ থেকে পরিত্রাণের উপায় তবে কি?

আদিম যুগে আমাদের পূর্বপুরুষরা যখন গুহা বা জঙ্গলে বসবাস করতো, তখন সচরাচর তারা হিংস্র বন্যপ্রাণি দ্বারা আক্রমন হতো। এবং হিংস্র বন্যপ্রাণীদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে তাদের একটাই পথ ছিলো-হয় প্রাণিটার সাথে লড়াই করা কিংবা জীবন বাঁচানোর জন্য দৌড়ে পালানো।
যুগ পাল্টেছে। এখন বন্যপাণীর সাথে লড়াই করার প্রয়োজনও ফুরিয়েছে। তবে দৈনন্দিন জীবনে টিকে থাকার নানান উপকরণ দত্তক নিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত আমরা পাওয়া-না পাওয়া, হার-জিত, হতাশা-ব্যান্জনার যে লড়াই করে যাচ্ছি, তাতে আমাদের সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টিম উদ্দীপ্ত থাকছে এবং নিঃসৃত হচ্ছে বিভিন্ন স্ট্রেস-হরমোন, যেমন- এড্রিনালিন, নর-এড্রিনালিন এবং কর্টিসল। বণ্য আদিমতা শেষ হলেও লড়াই আমরা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি। আর একেই বলে ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স, অর্থাৎ ট্রেস রেসপন্স (চাপ প্রতিক্রিয়া)

ট্রেস রেসপন্স হচ্ছে আমাদের অটোনোমিক নার্ভাস সিস্টেমের একটি স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। দিনের পর দিন ক্রমাগত দুঃশ্চিন্তা ও চাপ নিতে থাকলে শরীরের স্নায়ু ও পেশিগুলো যে পরিমাণে সংকুচিত হয়, সে অনুপাতে শিথিল হতে পারে না। যার ফলে নানারকম সাইকোসোমাটিক বা মনোদৈহিক রোগব্যধি আমাদের আক্রমন করে বসে।

যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. মেয়র ফ্রেডম্যান এবং ডা. রে রোনেম্যান দীর্ঘ গবেষণার পর দেখান যে, হৃদরোগের সাথে অস্থিরচিত্ততা, বিদ্বেষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভুল জীবনাচরণের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। আর এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে জীবন সম্পর্কে আমাদের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টি। আর এটাই ট্রেস রেসপন্স।

ধরুন,আপনি কারো থেকে টাকা ধার করেছেন। পাওনাদার সে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু আপনি এই মুহূর্তে টাকা শোধকরতে পারছেন না। তখন কি করবেন? নিজেকে রক্ষার্থে পাওনাদারকে মেরে ফেলবেন? পালিয়ে যাবেন? নাকি পাওনাদারকেঅনুরোধ করে সময় চাইবেন দেনা শোধ করতে? আপনি এখন পরিস্থতি সামাল দিতে যেভাবে রিয়্যাক্ট করবেন, সেটাই ট্রেস রেসপন্স। এবং রিয়েকশন যাই হোক, তা আমাদের সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টিমকে উদ্দীপ্ত রাখছে। কাজেই, ট্রেস এড়ানো কিছুতেই সম্ভব হচ্ছেনা।

এখানে ইতিবাচক এবং নেএখানে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুই ধরনের রেসপন্সই আমাদের জন্য উন্মুক্ত। নির্ভর করে আমরা কোনটা বেঁছে নিচ্ছি।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া টেক্সাসের ছয় সদস্যের হত্যা-আত্মহত্যার বিষয়টি একটি নেতিবাচক স্ট্রেস রেস্পন্স এর বাস্তবিক উদাহরণ। পরিবারের দুই ভাই ফারহান এবং তানভির হতাশায় ভুগছিলেন। দীর্ঘদিন যাবত হতাশায় আক্রান্ত দুই ভাই এই সমস্যাটি থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজছিলেন, কিন্তু পাচ্ছিলেন না। ফলশ্রুতিতে তাদের উদ্বেগ এবং মানসিক চাপ আরো বেড়ে যায়। তারাতারা কিভাবে এই চাপ থেকে বেড়িয়ে অন্য সবার মত একটি সুস্থ্য-স্বাচ্ছন্নময় জীবন যাপন করবেন, তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তারা একাকীত্ববোধ করছিলেন। হতাশাগ্রস্থ্য জীবনে তারা পৃথিবীকে দেখেছিলেন ভয়ংকর দস্যু হিসাবে, যেখানে তাদেরকে নিরাপত্তা দেবার মত কোন মানুষ ছিলনা। এমন কি নিজ পিতা-মাতা, বোন, নানী কাউকে তারা দৃশ্যত দেখতে পাচ্ছিলেন না। এবং সে সে মুহুর্তে আত্মহত্যা তাদের জন্য একমাত্র মুক্তির পথ হিসাবে সামনে এসেছে। মানসিক সমস্যা থেকে সেরে উঠতে তাদের জন্য ইতিবাচক কোন পথ ছিলনা। এটা

একা আত্মহত্যা করলে সেটাও তাদের পরিবারের জন্য লজ্জাজনক হতো বলে ভাবছিলেন । এবং তাই দুই ভাই সিদ্ধান্ত নিলেন পরিবারের বাকিদের হত্যা করে এই লজ্জা থেকে মুক্তি দেবার। আমরা এখানেও দেখতে পাই যে, তারা পরিবারকে গুরুত্ব দিতেন। তারা শুধু জানতেন না, সেটার প্রয়োগ। মানসিক বিচ্ছিন্নতা তাদের উপর এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে, এক দৃষ্টিকোণ থেকেই তারা ভাল-মন্দে পৃথিবীকে দেখছিলেন, এখানে অন্য কারো প্রবেশ ছিলনা।
কেনহত্যা করে আত্মহত্যাই কেন হল সমাধান? পিতা-মাতা, পরিবার কি তাদের তাদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে অবগত ছিলেন? যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে তাদের সন্তানদের এই মানসিক সমস্যাটা নিয়ে ভেবেছিলেন? সন্তানদের সেরে উঠতে যথেষ্ট সহযোগীতামূলক পদক্ষেপগুলো কি নিয়েছিলেন, নাকি চিরাচরিত স্বভাবে মানসিক সমস্যাটাকে অভিশাপ ভেবেছিলেন? প্রযুক্তির ব্যাবহারে মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া সকল কথাবার্তা কি তাদের পরিবার, বন্ধু বা আত্বীয়দের কারো নজরে পড়েনি? প্রশ্নের শেষ নেই।

প্রতিবেশীরা বলছেন, তারা একটি সুখী পরিবার ছিল। তার অর্থ, অনেক কিছুই অজানা থেকে গিয়েছিল। আমাদের সমাজে এখনো এই ‘হতাশা বা মানসিক চাপ’ শব্দটাকে খুব গুরুত্বের সাথে নেয়া হয়না। কেউ মানসিক বিচ্ছিন্নতায় পড়ে গেলে সেটাকে প্রায়শই পরিবার, আত্বীয়, বন্ধুদের দ্বারা কটাক্ষ করা হয়। এখনো আমরা ভাবি, মানসিক বিচ্ছিন্নতা মানেই একটি রোগ এবং এটা অন্যরা জানলে লজ্জা। কত অজ্ঞ আমরা।

হতাশাগ্রস্থ্য হওয়া খুব স্বাভাবিক। মানসিক উদ্বেগ খুব স্বাভাবিক। এটা এমন কোন ভয়াবহ রোগ নয় যা সেরে উঠবার নয়। এই সমস্যায় মোকাবেলা করতে ডাক্তারের শরণাপন্নের সাথে পারিবারিক ইতিবাচক সম্পর্ক এবং সহযোগীতা সব চেয়ে বেশী জরুরি। সন্তানদের সাথে আমাদের পারিবারিক সম্পর্কটা কেমন হয়া উচিত? অবশ্যই বন্ধুত্বপূর্ণ। অবশ্যই পর্যাপ্ত সময় ব্যায়ে একটি সুন্দর পরিবারই হতে পারে আমাদের সন্তানদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়।
আমরা যারা আমেরিকা বসবাস করছি, আমাদের প্রায় সবারই সন্তানদের সাথে একটা বিশাল ‘জেনারেশন গ্যাপ’ রয়েছে। আগের সময় এবং আজকের সময়টার মধ্যে ব্যবধান ‌রয়েছে অনেক। আমরা বাবা-মায়ের ধমক-পিটুনি খেয়ে বেড়ে উঠেছি। তারা যা বলেছেন বা চেয়েছেন, আমরা তাই করেছি। সেখানে নিজেদের কোন মতামত বা ইচ্ছে প্রকাশ করার সুযোগ ছিলনা। নিজের মেধা বিকাশের কোন অবকাশ ছিলনা; আর তাই ডাক্তার, ইনজিনিয়ার, শিক্ষক হওয়ার মত মেধাবী আমরা আজ হয় আমেরিকার ক্যাব ড্রাইভার কিংবা ডানকিনের কর্মচারী।

কিন্তু আজ দিন বদলেছে। পরিবেশ, পরিস্থিতি, প্রযুক্তির ব্যবহার, নাগরীক অধিকার, সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।আজকের এই জেনারেশন গ্যাপটা ঠিক এই খানেই। সবকিছু বদলে গেলেও বদলাতে পারছিনা আমরা। আমরা নিজেদের মত করে সন্তানদের উপর সকল ধর্ম, কর্ম, সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চাচ্ছি। ছোটবেলা আমরা কখনো বাবা মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলিনি। তাদের ইচ্ছা, মতাদর্শেই আমরা চলেছি। আজ আমরা ভাবি, আমাদের সন্তানরাও তাই করবে। সমস্যা এখানেই।

আমরা নিজেদের মত সন্তানদের গড়ে তুলতে চেষ্টা করছি। সন্তানেরা কি পরিধান করবে, কি করবে, কার সাথে চলবে, কোথায় যাবে, এমনকি পড়াশুনা করে তারা কি হবে, সেটাও আমরা নির্ধারণ করতে চেষ্টা করছি। আর এতে আমাদের সন্তানরা মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হচ্ছে। হতাশায় ভুগছে।

আমরা জানি যে, কিশোর বছরগুলি মূলত একটি মানসিক চাপের সময়। এ সময় তাদের দেহের পরিবর্তন, চিন্তার পরিবর্তন এবং অনুভূতির পরিবর্তন হয়। এ সময়টাতে পরিবার, বন্ধুমহল, স্কুল, বা স্বজনদের কাছ থেকে যে কোন ধরণের মানসিক চাপ, কলহ, সম্পর্ক ভঙ্গন, তিরস্কার, বিভ্রান্তি, ভয় এবং সন্দেহমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও অনুভূতি, যে কোন কিশোর-কিশোরীর সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিরুপ প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু আমরা সে বিষয়গুলোকে একেবারেই প্রাধান্য দিচ্ছিনা।

এমনকি প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানটিকেও আমরা একটি নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতায় রাখতে চাচ্ছি। পড়াশুনা, চাকরীর সুবাদে আমাদের সন্তানরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও আমরা আবেগী হয়ে পড়ছি যেটা তাদের অগ্রগতির পথে অন্তরায়। এতে তারা বিরাট মানসিক সমস্যার পরছে। তৈরী হচ্ছে পিতা মাতার প্রতি অসন্তুষ্টকজনক ক্ষোভ, বিরক্তি ও হতাশার। কেউ কেউ এর সমাধানে বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যামূলক ভয়ংকর পথটি।

সংস্কৃতি একটি উল্লেখ্যজনক বিষয়। সামাজিক আচরণ, মিথষ্ক্রিয়ার ধরণ, জ্ঞানীয় গঠন এবং সামাজিকী করনের মধ্য দিয়ে যে বুঝাপড়া অর্জিত হয়, সেটাই সংস্কৃতি। আমরা জন্মসূত্রে বাঙ্গালী হলেও পরিবার নিয়ে বাস করছি আমেরিকাতে। কাজেই নিজ সংস্কৃতি হ্নদয়ে ধারণ করে হলেও ভিন্ন এই নতুন সামাজিক গড়নকে গ্রহন করতে হবে এবং নতুন জনগোষ্ঠীর সাথে সামষ্টিক আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে আমরা সন্তানদের জন্য উন্মুক্ত পথ খোঁজে পাবনা। জেনারেশন গ্যাপে আমরা কেবল বিভ্রান্তই হবো এবং আমাদের সন্তানরা ক্ষতিকারক পথটি বেছে নিবে, যার মধ্যে আত্মহত্যা একটি।
মানসিক চাপ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি উপাদান। একে ছাড়া জীবন যাবন বলা যায় অসম্ভব। তবে, যতটা সম্ভব বাস্তবপরিস্থিতি মেনে নিয়ে তার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার মানসিকতা গ্রহণ করতে পারলে, সময়কে ভাগ করে পরিকল্পনাঅনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে, দৈনন্দিন জীবনধারণে বিরুপ মনোভাব ও আচরণ এড়িয়ে চলতে পারলে, হতাশা, চাপ, উদ্বেগ অনেকটাইকমে যাবে।

আমাদের সন্তানরা আমাদের আগামীর ভবিষ্যত। কাজেই আমাদের সন্তানদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। সন্তানদের মত প্রকাশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। তাদের চাহিদা, তাদের ইচ্ছে, শখ, কষ্ট, মেধা সবকিছু জানার চেষ্টা করতে হবে। তাদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে হবে যেন সব কিছু তারা খোলা মনে শেয়ার করতে পারে। মন্দ কিছু করলে সেটা বিরুপ ভাবে নয়, গালি বা চিৎকার করে নয়, বরং সহনশীলতার সাথে সন্তানদেরকে বুঝাতে হবে। ভাল মন্দ, ন্যায় অন্যায়, নৈতিকতার সঠিক শিক্ষায় একটা অবকাঠামো সেই শিশু বয়স থেকে গড়ে তুলতে হবে যেন আগামীর পথে তারা নিজেরাই সঠিক পথ বেছে নিতে সক্ষম হয়।

সন্তানদের যথেষ্ট সময় দিতে হবে। কথোপকথন রাখতে হবে। মুখে নয়, আচরণে তাদের জানাতে হবে যে, আমরাই তাদের সর্বোত্তম ভালবাসা ও নিরাপদমূলক মানুষ। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নিয়ে কোন ধরণের বৈষম্যমূলক কথা তাদের সাথে বলা উচিৎ নয়। অতিমাত্রায় প্রযুক্তির ব্যবহার ও সুবিধাগুলো আমাদের সন্তানদের অনেকটাই গা ঘেঁষাঘেঁষি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। সেটা খেয়াল রাখতে হবে। রোজ অন্তত একবার হলেও সন্তানের পাশে বসে তার চোখের দিকে তাকাতে হবে, বুঝতে হবে কি হচ্ছে। জানতে চাইতে হবে, ‘আর ইউ অকে?” বলতে হবে, “ডু ইউ নিড ইনিথিং?’ বুঝাতে হবে, “আই এম হিয়ার ফর ইউ।“ যে কোন সমস্যায় আমাদের সন্তানদের একমাত্র নিরাপত্তা ও নিরাপদ আশ্রয় হলাম আমরা, বাবা-মা।

সবশেষে, আমাদের সন্তানেরা নিরাপদ থাকুক। আপনার সন্তানের মাঝে যদি এমন কোন লক্ষন দেখা দেয়, যেমন- পর্যাপ্ত না ঘুমানো, ক্ষুদামন্দা, ওজম হ্রাস, নিজের ক্ষতি সম্পর্কিত কোনও কথা বলা, আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদাবোধ হারানো, বন্ধুবান্ধবের প্রতি আগ্রহ হ্রাস, খিটখিটে মেজাজ, উদ্বিগ্ন বা ক্লান্তি ভাব, সিদ্ধান্তহীনতা, উদাসীন আচরণে, স্কুল বা কাজে মনোনিবেশ না করা, অসহায় বোধ করা, নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা, অপরাধবোধ, নিজেকে মূল্যহীন ভাবা, সামাজিক ঘনিষ্ঠতা এড়ানো…. ইত্যাদি, তবে দ্রুত অবশ্যয়ই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। প্রয়োজনে সন্তানকে কাউনসেলিংয়ের ব্যবস্থা করবেন কিংবা মেনটাল হেল্থ সার্ভিসের ব্যবস্থা নিতে ডাক্তারকে অনুরোধ জানাবেন। ন্যাশনাল সুইসাইড প্রিভেনশন লাইফলাইনে যোগাযোগ করতে পারেন।
আপনার সন্তান, আপনার সম্পদ। আপনাকেই সে সম্পদের দায়ীত্ব নিতে হবে যত্নের সাথে।

লেখকঃ যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক, কলামিস্ট ও শিক্ষক 

আরও পড়ুন