Ads

দিল্লিতে উগ্র হিন্দুত্বের তাণ্ডব

আসাদ পারভেজ

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন প্রতিরোধে আমজনতার সম্মিলিত প্রতিবাদ। জনতার আন্দোলন থামিয়ে দিতে রাষ্ট্রশক্তির সরাসরি মদতে দিল্লিতে চলে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত নৃশংস গণহত্যা; যেমনটা ব্রিটিশরা করেছিল ১৮৫৭ সালে। সে সময় দেশের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে নেতৃত্বদানকারী মুসলিম সম্প্রদায়কে একেবারে নিশ্চিহ্ন করার পথে হেঁটেছিল ইংরেজরা। মুঘল, পাঠান আর সুলতানি যুগের সমন্বয়ে গড়ে উঠা দিল্লি শহরের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে ছিল মুসলমানদের কৃষ্টি আর ঐতিহ্য। তারা বুঝতে পারে, এগুলো যতদিন থাকবে, ততদিন ভারতবাসীকে নিরাপদে শাষনের নামে শোষণ করা যাবে না। তাই দিল্লির বুকে মুসলমানদের ঐতিহ্য, অর্থনৈতিক ভিত, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বুনিয়াদসহ সমস্ত কিছুকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার কাজে নেমেছিল ব্রিটিশরা।
ভারতের মাটিতে হিন্দুত্ববাদী রাম-রাজত্ব কায়েমে একই পথে হাঁটছে বিজেপি সরকার।

দিল্লির চাঁদনি চক এলাকায় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দু-মুসলিম অসাম্প্রদায়িকতার সম্প্রীতি ধ্বংস করেছিল ব্রিটিশ। তারা লালকেল্লার নিকটবর্তী এলাকার মুসলিম আবাসভূমি ধ্বংস করে নতুন দিল্লি গড়ে তোলে। ব্রিটিশ আমলে রাইসিনা হিল এলাকায় যেভাবে মুসলিম বসতিগুলো উচ্ছেদ করা হয়েছে, একইভাবে তা আবার ফিরে এসেছে নরেন্দ্র মোদি চালিত সরকারের দিল্লি গণহত্যার মাধ্যমে।এই নগরের জাফরাবাদ, জহুরি, ভোজপুরি ও শিব বিহারসহ নানা স্থানে বিজেপি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে মুসলমানদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। রাষ্ট্রশক্তির মদদে একক সম্প্রদায়ের হত্যাকে কোনোভাবেই গণহত্যা না বলে দাঙ্গা বলা যাবে না। সত্যিকারার্থে দিল্লিতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপে গণহত্যা চলছিল।

মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন অমিত শাহদের নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্বেচ্ছাচারিতায় ব্যবহার করে ভয়াবহ গণহত্যা সংগঠিত করেছিলেন। ঠিক একই ব্যক্তি আরও হিংস্র ও বিধ্বংসীরূপে পুরাতন ও নতুন সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে দিল্লির বুকে এক বীভৎস গণহত্যা চালান। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণ প্রতিবাদেমুখর হওয়ার সাথে প্রতিরোধের সংকল্পে দৃঢ়তা পায়। কিন্তু সবকিছুকে আরএসএসের নীল-নকশায় ধ্বংস করা হয়Ñ যা বাস্তবায়নে বিজেপির ধর্মান্ধ আচরণকে মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালসহ বামপন্থিরা একপ্রকার সমর্থন করেন।

মুসলিমশূন্য হিন্দুত্বের ভারত গঠনের দীর্ঘদিনের এক মহাপরিকল্পনা আরএসএসের। সেই বিকৃত ও চিরন্তর ভারতবর্ষের বহুত্ববাদী চিন্তা-চেতনার সমন্বয়বাদী ধারার সম্পূর্ণ বিরোধী এক চিত্রকে তারা স্থায়ী করতে চায়। এহেন কর্মকাণ্ড পুরো ভারতে চূড়ান্ত গৃহযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করছে; তারই আভাস দিল্লির পৈশাচিকতার ভেতর দিয়ে চলা গণহত্যা।

প্রতিটি সকালের মতো ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সালে দিনের রবি আলোকিত করেনি দিল্লির হৃৎপিণ্ড। এই দিন উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে একের পর এক হিন্দুত্ববাদী সহিংস আক্রমণে দিশেহারা হয়ে উঠে স্থানীয় মুসলমানরা।সংসদের উভয় সভায় সিএএ পাসের প্রতিক্রিয়ায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকেই দেশজুড়ে সাধারণ জনতার প্রতিবাদ শুরু হয়। তাদের অহিংস আন্দোলন এনআরসি,এনপিআর ও সিএএ-এর মতো বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের হটকারী সকল প্রকার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে।

চলমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ২২-২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যবর্তী রাতে রাজধানীরউত্তর-পূর্বাংশেরসিলামপুর-জাফরাবাদমহাসড়কের একপ্রান্তেপ্রায় হাজারখানেক নারী প্রতিবাদে নামেন। তাদের বিক্ষোভে সিলামপুর মেট্রো স্টেশনে প্রবেশ ও প্রস্থানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। দ্রুত সময়ে পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী জড়ো হয়। সাধারণ নারীদের এই আন্দোলন ছিল একেবারেই অহিংস। কিন্তু একে উসকে দিতে বিজেপি রাজনৈতিক কৌশলে স্থানীয়এক উগ্র নেতাকে জগন্যভাবে ব্যবহার করে।দিনের বেলায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন জেলার ডিসিপি বেদ প্রকাশ সূর্য।

প্রশাসনের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা বেদ প্রকাশের সামনে সাধারণ জনতার শান্তিপূর্ণ অবস্থানের বিরুদ্ধে বিজেপির নেতা কপিল মিশ্র প্রকাশ্যে উগ্র বক্তব্য রাখেন। তিনি পুলিশকে তিন দিনের আলটিমেটাম দিয়ে হুমকির সুরে বলেন, ‘এ সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থল থেকে বিক্ষোভকারীদের যেকোনোভাবে সরিয়ে ফেলুন, নাহলে বিষয়টি আমরা নিজেদের হাতে কঠোরভাবে দমন করব।এতে করে তারা (মুসলমানরা) শান্তিতে থাকতে পারবে না।’

সমাবেশে তার বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে স্থানীয় উগ্র হিন্দুদের হিংস্রতা নতুন করে জেগে ওঠে। তারা পরদিন উত্তর-পূর্ব দিল্লির বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের ওপর হিংস্র বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের উগ্রতা এত বেশি ছিল যে, দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পূর্বপরিকল্পনামতেই বিজেপি কপিল মিশ্রকে দিয়ে ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।

ঘোলাটে পরিস্থিতির প্রথম দিন সরকার পুলিশকে লেলিয়ে দেয় জনতার ওপর। পরের দিন শুরু হয় একমুখী দাঙ্গা। সিলামপুর, জাফরাবাদ, কারাওয়াল নগর, গোকুলপুরি, মৌজপুর চক, ব্রহ্মপুরী, কর্দমপুরি, বাবরপুর, শিবপুরি, ভজনপুরা এবং চাঁদবাগে হিংসার আগুন জ্বলে ওঠে। এর মধ্যে ২৫ ফেব্রুয়ারি কপিল মিশ্র দাঙ্গায় প্ররোচনা দিয়ে টুইটে লিখেন, সিএএ সমর্থনকারীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে তিনি ভয় পান না। একটি ভিডিও টুইট করে আরও লিখেন, জাফরাবাদকে খালি করা হয়েছে, সেখানে আর কোনো শাহিন বাঘ হবে না। তার একাধিক বক্তব্যে হিন্দুত্ববাদীদের মনে সাহস বেড়ে যায়।তারা বুঝতে পারে, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনা না থাকলে সে বাববার এমন আচরণ করত না।

দিল্লির নানা স্থানে হিন্দু জাতীয়তাবাদী উগ্র জনতা কপালে তিলক এঁকে জয় শ্রী রাম ও হিন্দুওঁ কো হিন্দুস্তান স্লোগান তুলে মুসলিম স্থাপনায় হামলা করে। তারা ঐতিহাসিক বহু মসজিদসহ মুসলমানদের ঘরবাড়ি, দোকান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও যানবাহনসহ যাবতীয় সম্পত্তি পেট্রোলবোমা আর অ্যাসিডের বোতল নিক্ষেপ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনায় গেরুয়া পতাকা উড়িয়ে সাম্প্রদায়িকতার শেষ ক্ষতটুকু সারে। অশোক নগরের একটি মসজিদ ভাঙচুর শেষে গম্বুজের মাথায় হনুমান পতাকা টাঙ্গিয়ে দেয়। এ ছাড়া মসজিদের কার্পেটের সাথে কুরআন পোড়ানোর নজির পাওয়া যায়। গোকুলপুরির একটি মসজিদেও নির্লিপ্তভাবে হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে। সাত দিনের হিংস্রতাকে বিশ্ব জনমত দাঙ্গা না বলে অকপটে গণহত্যা বলেছে। দাঙ্গা শেষে গলির চিপায়, ড্রেন-নালা ও বিহার-গোকুলপুরির খালে মানুষের লাশ পাওয়া যায়। যদিও সরকার ৪৯জন বনি আদম নিহত আর কয়েকশত আহতের কথা স্বীকার করে (ঝধসববৎ ণধংরৎ, ঞযব জড়ড়ঃং ড়ভ ঃযব উবষযর জরড়ঃং: ঞযব ঘবি ণড়ৎশ ঞরসবং, ২৭ ঋবনৎঁধৎু ২০২০)।

রয়টার্সের ভাষ্য মতে, অবশ্য বহু নিরপেক্ষ সংবাদকর্মী উগ্র হিন্দুদের হাতে আহতসহ চরম লাঞ্ছিত হয়। যাদের অনেকে পোড়া মসজিদ কিংবা আগুন ধরিয়ে দেওয়া মুসলিম স্থাপনার ছবি তুলতে গিয়ে চরম বিব্রতকর প্রশ্নে জর্জরিত হয়। এ সকল সাংবাদিকের ধর্মপরিচয় নিশ্চিতকরণে খতনা আছে কি না, তাও দেখার চেষ্টা করে।

মুসলমানদের সাথে বহু হিন্দু নিহত ও তাদের স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে মর্মে সরকারের চালিত মিড়িয়ায় প্রচারিত হয়।সত্যিকারার্থে মুসলিমশূন্য এলাকায় লুটতরাজে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনার নিচে পড়ে এবং নিজেদের এলোপাতাড়ি গুলি চালাচালিতে কয়েকজন উগ্র হিন্দু মারা যায়। এ ছাড়া মুসলিম স্থাপনারগুলোর আগুনের জ্বলন্ত শিখার পাশে থাকাতে কয়েকটি হিন্দু স্থাপনা সায়-সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দিল্লি পুলিশ ও প্রশাসন সম্পূর্ণরূপে একমুখী দাঙ্গাসহ গণহত্যা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়।বিশ্বসম্প্রদায়েরচাপে পড়ে বিজেপির প্রশাসন ১২৩টি এফআইআর নথিভুক্ত এবং সহিংসতায় জড়িত কয়েকশত নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে; যদিও তা ছিল লোক দেখানো।

লেখকঃ গবেষক, কলামিস্ট ও মানবাধিকারকর্মী

লেখকের প্রকাশিত লেখাসমূহ-

ইতিহাসে ফিলিস্তিনঃ পবিত্র ভূমির মালিকানা (পর্ব-১)

ইতিহাসে ফিলিস্তিনঃ পবিত্র ভূমির মালিকানা (পর্ব-২)

ইতিহাসে ফিলিস্তিনঃ পবিত্র ভূমির মালিকানা (পর্ব-৩)

আরও পড়ুন