Ads

পঙ্খিরাজের অপেক্ষায়!

ডা: আলী জাহান

১. অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ কর্মজীবী মানুষ এখন পঙ্খিরাজ ঘোড়ার অপেক্ষায় আছেন। কল্পনার সেই ঘোড়া বাস্তবে খুবই প্রয়োজন। বাংলাদেশে অনেক কিছুই পর্দার অন্তরালে ঘটে। পঙ্খিরাজ ঘোড়াকে কি পর্দার অন্তরালে দেশে আমদানি করা হয়েছে? আর যদি তা আমদানি করা না হয়ে থাকে, তাহলে আগামীকাল থেকে শুরু হওয়া চূড়ান্ত বা আখেরি লকডাউনে লক্ষ লক্ষ কর্মজীবী মানুষ কর্মস্থলে পৌঁছাবেন কীভাবে?

২. বিভিন্ন কিসিমের লকডাউনের পরে আগামী বৃহস্পতিবার (০১ জুলাই) চূড়ান্ত লকডাউন বা শাটডাউন শুরু হচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশের মানুষ বিভিন্ন স্বাদের এবং রূপের লকডাউন দেখেছেন। আংশিক লকডাউন, কোয়ার্টার লকডাউন, হাফ লকডাউন, শিথিল লকডাউন, উষ্ণ লকডাউন, সর্বশেষ আখেরি লকডাউন শুরু হচ্ছে। কেন দেয়া হচ্ছে লকডাউন?

৩. খুব সহজ উত্তর- করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমানো। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন রূপের লকডাউন দিয়ে কি এ প্রাদুর্ভাব কমানো সম্ভব হয়েছে? পৃথিবীর সব জায়গায় লকডাউন দেওয়ার পর দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে করোনা সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার কমতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের তা কমেনি তো বটেই বড় সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে। এর একটি ব্যাখ্যা আসা দরকার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে এই ব্যাখ্যা দিতেই হবে। মৃত্যু এবং সংক্রমনের সংখ্যা কেন বেড়ে গেল? হালকা-পাতলা লকডাউন যে কাজ করবে না তা কি আপনারা বুঝতে পারেননি?

৪. অতীত ইতিহাসের আলোকে বলতে পারি যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অথবা সরকার এই ব্যাখ্যা দেবে না। হয়তো তাদের কাছে এই ব্যাখ্যা নেই। থাকলেও হয়তো প্রকাশ করা হবে না। করোনা সংক্রান্ত জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটি কি এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন? নাকি আপনাদের কথা বলা নিষেধ? লকডাউন দিয়ে যদি সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা না কমে তাহলে মানুষ লকডাউন মানবে কেন?

৫. সরকার এই ব্যাখ্যা না দিলেও সাধারণ মানুষ জানে কেন এই লকডাউন কাজ করেনি। সরকার লকডাউন কার্যকর করতে পারেনি।সাধারণ মানুষ এ লকডাউন কার্যকর করতে অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে আসেননি। তাদেরকে সেভাবে মোটিভেটেড করা সম্ভব হয়নি।সরকারের দেওয়া হরেক কিসিমের লকডাউন কেন কাজ করেনি তার এনালাইসিস হওয়া দরকার। প্রতিটি লকডাউন ঘোষণা দেওয়ার পর বাস স্টেশন, ট্রেন স্টেশন, লঞ্চঘাট আর সুপার মার্কেট গুলোতে মানুষের যখন ভীড় হচ্ছিল, তখন আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোথায় ছিলেন? শতশত নয়, হাজার হাজার নয়, বরং লক্ষ লক্ষ মানুষ শপিং করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন, শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার জন্য ফেরিঘাটে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, ঠেলাঠেলি গাদাগাদি করে বাস এবং ট্রেনে চড়েছেন। হয়তো উনারা উনাদের গন্তব্যে পৌঁছেছেন। কিন্তু উনারা যে তাদের সাথে করোনা বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন তা কি আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বুঝতে পারেননি? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা ব্যাপারটি ধরতে পারেননি?

৬. সরকার একদিকে জনগণকে বিনামূল্যে কিছু টিকা দিয়েছেন। বিদেশ থেকে নতুনভাবে টিকা আনার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। খুবই ভালো কথা। জনগণকে বিনামূল্যে টিকা দিচ্ছেন কিন্তু করোনা টেস্ট করানোর জন্য টাকা নিচ্ছেন, এর ব্যাখ্যা কী? টাকা দিয়ে করোনা টেস্ট করাতে রাজি নয় এমন মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে কতো? লাখ তো নয়ই বরং কয়েক কোটি মানুষ এই ক্যাটাগরিতে পড়বে। দুবেলা দুমুঠো ভাত জোগাড় করতে তাদের সারা দিন চলে যায় তারা টাকা দিয়ে করোনা টেস্ট করাবে? কোন পাগলও এই কথা বিশ্বাস করবে? তাই ধরে নেওয়া যায় জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশ করোনা টেস্ট করাচ্ছেন না। কেনই বা করাবেন? পৃথিবীর কোন কোন দেশে টাকা দিয়ে করোনা টেস্ট করাতে হয়? উনারা উন্মুক্ত ময়দানে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। বাজারে যাচ্ছেন, চায়ের দোকানে বসছেন, শপিংমলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, অফিস আদালতে যাচ্ছেন। একই সাথে করোনার বংশবৃদ্ধি করে যাচ্ছেন। হালকা-পাতলা লকডাউনের ব্যর্থ হবার এটি একটি বড় কারন। জ্ঞানী ব্যক্তিরা কি তা বুঝতে পারছেন না?

৭. বলছিলাম পঙ্খিরাজ ঘোড়ার কথা। আগামীকালের আখেরি লকডাউনে ব্যাংক (আংশিক) এবং গার্মেন্টস খোলা থাকবে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ থাকবে। জরুরি কাজে নিয়োজিত ছাড়া কোন যন্ত্র বাহিত যানবাহন চলবেনা।ব্যাংকে এবং গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি গুলোতে কতজন মানুষ কাজ করেন? প্রায় সাড়ে চার হাজার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন প্রায় ৫০ লক্ষ গার্মেন্টস কর্মী। ফ্যাক্টরির ভিতরে না হয় ধরে নিলাম সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা হচ্ছে। কিন্তু এই ৫০ লক্ষ মানুষ ফ্যাক্টরিতে যাবে কীভাবে? যন্ত্র চালিত গাড়ি নিষিদ্ধ। তাহলে কি তারা রিকশা এবং ঠেলাগাড়িতে যাবে? তাদের জন্য পঙ্খিরাজ ঘোড়া দরকার। পঙ্খীরাজে চড়ে মুহূর্তেই তারা বাসা থেকে ফ্যাক্টরিতে চলে যাবেন। কাজ শেষে সেই পঙ্খিরাজ তাদের তাদেরকে আবার বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। ব্যাপারটি কতো সুন্দর না! কোন ঝামেলা আছে?

৮. ব্যাংকের যারা মাঝারি এবং ছোট লেভেলে কাজ করেন তারা কীভাবে কাজে যাবেন? তাদের কপালেও কি রিক্শা এবং ঠেলাগাড়ি? লাখ লাখ কর্মী এবং কর্মকর্তাকে কি ব্যাংকগুলো নিজস্ব গাড়িতে নিয়ে যেতে পারবে? সম্ভব? কোনভাবে সম্ভব? সম্ভব নয়। তাদের সেই আর্থিক এবং মানসিক অবস্থা না থাকারই কথা। অভাগা সেই ব্যাংক কর্মচারীদের জন্য প্রয়োজন পঙ্খিরাজ ঘোড়া!

৯. গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি গুলোতে নিজস্ব উপায়ে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে কর্মীদের কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজে যারা পড়াশোনা করেন তাদের বিদ্যা বুদ্ধি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গার্মেন্টসে যারা কাজ করছেন তাদের চেয়ে বেশি হবার কথা। কোটি টাকার প্রশ্ন হচ্ছে, ফ্যাক্টরি গুলোর কর্মীরা যদি স্বাস্থ্যসম্মতভাবে কাজ করার যোগ্যতা রাখেন তাহলে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা কেন পারবেন না?

১০. কল্পনার সেই পঙ্খিরাজ ঘোড়া আজ খুব প্রয়োজন। নাহলে মানুষকে বাঁচানো যাবে না। বাঁচার জন্য প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি করে পঙ্খিরাজ ঘোড়ার খুব দরকার। সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকবে, শান্তিতে অফিস ফ্যাক্টরিতে কাজ করা যাবে। বোনাস হিসেবে পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে মানুষ কিছুক্ষণের জন্য হলেও দেখতে পাবে যে তাঁরা যাদেরকে উপরতলায় পাঠিয়েছিলেন সেই মানুষগুলো ওখানে গিয়ে সমতলের কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। উনারা চোখ থাকতেও অন্ধ, কান থাকতেও বধির।

আরও পড়ুন-

আবু আদনানের অলৌকিক ফিরে আসা এবং গুগল ম্যাপের রহস্য!

লেখক ডা: আলী জাহানের গ্রাফিতি

লেখকঃ কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, যুক্তরাজ্য, সাবেক পুলিশ সার্জন ( Forensic Medical Officer), British Police

আরও পড়ুন