Ads

পশ্চিমবঙ্গের আদ্যোপান্ত এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যত

হাসান আল বান্না

আজ পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন মমতা। যদিও তিনি নিজ আসনে নন্দীগ্রামে হেরেছেন। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী আগামী ছয় মাসের মধ্যে তাকে অন্য কোন আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে আর সেটা হয়তবা তিনি হইবেনও বটে। একটি ত্রিমুখী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তিনি এবার রেকর্ড সংখ্যক ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন।

ত্রিমুখী পরিস্থিতি এজন্য যে : ক. মমতার দলের মীরজাফরদের দিয়ে সুসংগঠিত বিজেপি স্বয়ং ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে ভোট যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। খ. ২৭ বছরের রাজত্ব করা সিপিএম, কংগ্রেস ও পীর আব্বাস সিদ্দিকীর সম্মিলিত দলের সাথে ভোট যুদ্ধ। গ. তিনটি বিশেষ ফাটাকেষ্টের তীব্র নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তিনজন ফাটাকেষ্ট বলতে প্রথমজন হচ্ছে : বাংলা সিনেমার হিরো ফাটাকেষ্ট নায়ক মিঠুন চক্রবর্তী। যিনি ইতিপূর্বে তৃণমূলের পক্ষে ছিলেন কিন্তু তেমন কোন সুবিধা করতে পারেননি বলে বিজেপির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার টোপে বিজেপির পক্ষে ব্যাপক নির্বাচনী প্রচরণায় অংশ নিয়ে মাঠকে মাঠ, গ্রামের পর গ্রাম চষে বেড়িয়েছেন।

দ্বিতীয় ফাটাকেষ্ট হচ্ছে : হিন্দুত্ববাদী ফাটাকেষ্ট। যিনি হচ্ছেন শুভেন্দু অধিকারী। মমতার ডান খ্যাত শুভেন্দু অধিকারী বিজেপির মূখ্যমন্ত্রী হওয়াট টিকেটে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদেন। স্বয়ং মমতার দূর্গ নামে খ্যাত নন্দীগ্রাম মমতার বিপক্ষে বিজেপির প্রার্থী হয়ে জয় লাভ করেন। যদিও মূখ্যমন্ত্রী হওয়া সুদূরপরাহত যতদিন মমতা বেঁচে থাকবেন। এখানে শুভেন্দু অধিকারী অনেক বড় ভূল করলেন কারন তিনি যদি তৃণমূলে থাকতেন তবে আজ নিশ্চিত মন্ত্রী হতে পারতেন।

তৃতীয় মুসলিম ফাটাকেষ্ট হচ্ছেন : পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। পশ্চিমবঙ্গের আকাশে বাতাশে আলোচনা আছে, বিজেপির ২০০ কোটি টাকা ঘোষ খেয়ে মুসলিম ভোট ভাগ করতে মমতার বিরুদ্ধে জোট বাঁধেন আব্বাস। কিন্তু তার শোচনীয় পরাজয়ে প্রমানিত হয় ওইসব পীর জাদা মাদা মন্দীরেই মানায় রাজনীতিতে নয়। যদিও ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছিল আলেমদের নেতৃত্বেই। এতসব ত্রিমাত্রিক সমীকরণের মধ্যে দিয়েই আজ মমতাকে পুনরায় বিজয় মালা পরিধান করতে হয়েছে।

তারমধ্যে আরো ঘোরতর অভিযোগ ছিল আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় সরকারের গোলাম রাজ্যপাল এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী সিবিআই সহ সম্মিলিত পরোক্ষচেষ্টা ছিল বিজেপির পক্ষে। এত সবকিছু ছাপিয়ে মমতা আজ অগ্নিকন্যা হয়ে পুনরায় পচিমবঙ্গের মসনদে এটাই বাস্তবতা।

আমি বাংলাদেশের জনগণ, গণমাধ্যম ও মানবিকতার কর্মীদের পক্ষ থেকে মমতাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। দুই এক দিনের মধ্যেই আমার অভিনন্দন বার্তা পৌছে যাবে পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ে। আশা করছি, মহামারী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের পক্ষ থেকে দিদিকে সাক্ষাতেই অভিনন্দন জানিয়ে আসবো। এবার শিরোনামে ফিরছি।

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন নিয়ে শুধু ভারত নই বরং পুরো বাংলাদেশও অধির আগ্রহী ছিল। কারন হচ্ছে, মমতা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থাকাকালীন বিজেপি সরকারের বিতর্কিত নাগরিক আইন এনআরসি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশর সচেতন মহল এবং পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সমাজের উদ্বিগ্নতা ছিল যদি বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের মাটির ভূকর্তা হলে শুরুতেই এনআরসি বাস্তবায়ন করবে। সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের মতো লাখো মানুষের ঢল নামবে বাংলাদেশের দিকে। তবে মমতা এবার ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়াই আপাতত সেই শঙ্কা নেই।

এবারে মমতার সাফল্যে সামনে কেন্দ্রীয় সরকারে বিজেপির ক্ষমতা আসা বড্ড চ্যালেন্জ দাঁড় করিয়েছে। কংগ্রেসের হাত দিয়েই ভারত স্বাধীনতা লাভ করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গত ৭০ বছরের অধিক সময়ে ক্ষমতার মসনদে আসীন ছিল। কিন্তু গত ১০ বছরে কংগ্রেসের কোমড় ভেঙে যায়। বাংলাদেশের বিএনপির মতো কংগ্রেস এখন দন্তহীন বাঘ। আমার মতে ঐতিহাসিক কংগ্রেসের এমন করুন পরিনতি তিনটি কারনে : এক. বাবরী মসজিদের সমাধান না করে ঝুলিয়ে রেখে ৩০ কোটি মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, দুই. উগ্র হিন্দুত্ববাদী আইএস কে দমন করতে ব্যর্থ হওয়া তিন, প্রণব মুখার্জির মতো আইএস ও বিজেপি ঘরোনার ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি বানানো।

উপরোক্ত তিনটি কারনই সুস্পষ্ট হবে একটি বিষয় পরিষ্কার করলে, সেটা হচ্ছে কংগ্রেসের ভোটার কারা? অথবা কাদের উপর দাঁড়িয়ে আজকের কংগ্রেস? মূলত উদার ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক মানসিকতা সম্পন্ন হিন্দু আর সাধারণ মুসলিম এবং নিন্মবর্ণের হিন্দু সমাজ হচ্ছে কংগ্রেসের ভোটার। কিন্তু উপরে উল্লেখিত তিনটি কারনেই কংগ্রেস তার ভোটারদের নিকট আস্থার সংকটে ভোগছে। এই সংকট না কাটানো পর্যন্ত কংগ্রেসের এমন পরিনতি থেকে রেহাই দেওয়ার কেউ নেই। আর এই সংকট গুলো কাটাতে হলে মমতাকে এগিয়ে নিয়ে এসে আগামীতে কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী করার ঘোষণা দিতে হবে। কারন মমতা ইতিমধ্যেই ভারতের উদার ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দু ও সচেতন মুসলিমদের নিকট আস্থার প্রতীক হতে পেরেছেন।

কংগ্রেসের সংকট উত্তরন কেন কামনা করছি? কারন হচ্ছে, ভারত পৃথিবীর বৃহত্তর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ভারতের গণতন্ত্র টেকসই করতে হলে বিরোধী রাজনৈতিক দলকেও কোমড় সোজা করে দাঁড়াতে হবে। আর বহুভাষী, বহুজাতি ধর্মের ভারতকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত রাখতে পারে কেবল দুইটি মন্ত্র তা হচ্ছে গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। গণতন্ত্র সুসংহত করতে অবশ্যই সরকারী দলের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন। আশা করি মমতাকে দিয়ে কংগ্রেস সেই শক্তিমান রাজনৈতিক দলের অভাব পূরণ করতে পারবে।

আরও পড়ুন