Ads

পশ্চিমবঙ্গ ,আসাম, আরএসএস ও বিজেপি সম্পর্কে কিছু কথা

এম আর রাসেল 

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন নিয়ে বছরের শুরু থেকেই চায়ের কাপে তুমুল ঝড় উঠছে। পড়শি দেশের এই রাজ্য সম্পর্কে আগ্রহ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গের ২২০০ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে। দেশভাগের সময় রাজনীতির খেলায় সুদক্ষ কিছু খেলোয়াড় থাকলে হয়তো আজ বাংলার মানচিত্র একটু বড়ই থাকতো। পশ্চিম বাংলার কিছু অংশ বর্তমান বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড হতো৷

সেই সময় পূর্ব বাংলার হেভিওয়েট নেতার সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। শেরে বাংলা একাই আর কিইবা করতে পারতেন। তিনি কিপ ক্যালকাটা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দেশভাগের আলোচনা চলাকালীন যুক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন সোহরাওয়ার্দী। কিন্তু দেশভাগের উষালগ্নে প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন। এই নেতার আগমন কিপ ক্যালকাটা আন্দোলনকে থামিয়ে দেয়৷

কলকাতাকে ছেড়ে দেয়ার ফলে পূর্ব বাংলা তেত্রিশ কোটি টাকা পাবে। এই টাকা দিয়ে ঢাকার ব্যাপক উন্নয়ন হবে। কলকাতাকে পূর্ব বাংলায় রাখা গণতন্ত্র বিরোধী – এসব বুলি দিয়ে কলকাতাকে ভারতের কাছে ছেড়ে দেয়া হয়৷  পার্টিশন কাউন্সিলে প্রথম দিকে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি ছিলেন সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দিন। সোহরাওয়ার্দী বাংলার প্রতি অনুরাগ পোষণ করলেও অন্যজন ছিলেন পুরোই উল্টো। পরে নাজিমুদ্দিন এই কাউন্সিল থেকে সোহরাওয়ার্দীকে সরিয়ে দেন।

খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেও পূর্ব বাংলার জন্য উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই করেননি। তিনি পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হয়ে সোহরাওয়ার্দীকে ভারতের দালাল, পাকিস্তানের শত্রু বলে আখ্যা দিয়েছেন। উল্লেখ্য দেশভাগের পরই সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানে চলে যাননি। তিনি ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান যান।

দেশভাগের সময় ভাগ বাটোয়ারায় পূর্ব বাংলা তেত্রিশ কোটি টাকা পাবে এমন তথ্য ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল পূর্ব বাংলা এক পয়সাও পায়নি। নানা হিসেব নিকেশ শেষে দেখানো হল পূর্ব বাংলার পাওনা নয়, দেনা থাকে ছয় কোটি টাকা। নাজিমুদ্দিন গংদের কূটকৌশলে পূর্ব বাংলা কলকাতা ও অর্থ দুই হারিয়েছে। এ নিয়ে আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, ‘শুধু রেডক্লিফ একা আমাদের ঠকাতে পারেন নাই, আমরা সকলে মিলিয়াই আমাদেরে ঠকাইয়াছি’।

দেশভাগের ইতিহাস পড়তে গেলেই রাজনৈতিক নেতাদের বিষেদাগার করতে মন চায়। তাদের নির্বুদ্ধিতার দণ্ড দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষদের। ভারতবর্ষে নানা সমস্যা ছিল এটা সত্য, কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ আদৌ যে কোনো যুতসই সমাধান ছিল না তা আজ স্পষ্ট।

ক্রুসেডের পর থেকেই জাতিরাষ্ট্রের সূচনা হয়। ফরাসি বিপ্লবের পর তা গতি পায়। জাতি রাষ্ট্র করেও কি হানাহানি বন্ধ করা গেছে? আবার ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের মাঝেই যদি শান্তি খুঁজে পাওয়া যেত তাহলে আজ মধ্যপ্রাচ্য, মধ্যএশিয়া মিলে একটি রাষ্ট্র থাকতো। উসমানিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে আলাদা রাষ্ট্র তৈরি হতো না।

অনেকে বলবেন এখানে সাম্রাজ্যবাদীদের হাত ছিল। কিন্তু এই দায়ভার দিয়েই কি অন্য সব কারণকে ঢেকে দেয়া যায়? পশ্চিমবাংলা ভারতবর্ষের রাজনীতি চর্চার আতুড়ঘর বললে নিশ্চয় অত্যুক্তি হবে না৷ অবশ্য এর পাশে পূর্ব বাংলাকেও রাখতে হবে৷ এক কথায় এক সময়ের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি নানা দিক দিয়ে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়েছিল।

ব্রিটিশ ছাড় আন্দোলন বাংলার মাটিতেই প্রবলতা পেয়েছিল। মাস্টার দ্য সূর্যসেন, প্রীতিলতা তো পূর্ব বাংলারই সন্তান ছিলেন। নীল বিদ্রোহের আগুন, তেভাগা আন্দোলন, নুরূলদীনের জাগো বাহে কূন্ঠে সবাই এর বিপ্লবী উচ্চারণ এই বাংলাতেই সুর ছড়িয়েছিল। সিপাহী বিদ্রোহ, ওয়াহাবী আন্দোলন, বাঁশের কেল্লা, ফরাজী আন্দোলন, সিধু আর কানুর গল্প, কোল বিদ্রোহ, সন্দ্বীপ বিদ্রোহ, ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ সহ নানা ঘটনার সাথে বাংলার নাম জড়িয়ে আছে।

আফসোসের বিষয় হল আন্দোলন সংগ্রামে বাংলা জেগে উঠলেও শান্ত জনপদ গড়তে বাংলার মানুষ ব্যর্থ হয়েছে। নেতাদের অদূরদর্শিতা আর জনগণের অসহিষ্ণুতা এই দুই মিলে বাংলা বারবার রক্তাক্ত হয়েছে। সন্দেহ নেই ১৯৪৬ সালে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং দেশভাগ তরান্বিত করেছিল।

এক সময় বলা হতো ‘What Bengal thinks today, India think tomorrow’। বাংলার কার্যক্রম তা প্রমাণ করেনা। যাই হোক এসব নিয়ে অম্ল-মধুর তর্ক করে কূল-কিনারা পাওয়া যাবে না, সেই আলাপ আপাতত শিকেয় তোলা থাক৷ পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতির মাঠ বরাবরই জমে উঠে। কিন্তু এবার এই মাঠ অন্য সময়ের তুলনায় একটু বেশিই উত্তপ্ত ছিল। সব উত্তাপ শেষে বাংলার বাঘিনী খ্যাত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুনরায় মুখ্যমন্ত্রীর শপথ নিয়েছেন।

বলা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ইতিহাসে একক দল হিসেবে তৃনমূল কংগ্রেস রেকর্ড সংখ্যক ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছে। ১৯৭২ সালের পর এককভাবে কোনো দল এত বেশি ভোট পায়নি। ১৯৭২ সালে কংগ্রেস ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এবারের নির্বাচনে তৃণমূল ৪৭.৯৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে।

নির্বাচনে বিজেপির মরিয়াভাব চোখে পড়েছে। বাংলা বধে বিজেপি হেন কোন চেষ্টা নেই করেনি। মোদি, অমিত শাহ সহ হেভিওয়েট সকল নেতারা এই নির্বাচনে সক্রিয় ছিলেন। চতুর্মুখী কৌশল দিয়েও বাংলা জয় করতে পারলো না বিজেপি৷ তবে বিজেপি যে পশ্চিম বাংলায় ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে তা স্পষ্ট৷ প্রত্যেক নির্বাচনে পূর্ববর্তী নির্বাচনের তুলনায় ভাল করছে বিজেপি। সদ্য শেষ হওয়া নির্বাচনে বিজেপি ৭৭ টি আসন পেয়েছে যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। ২০১১ সালে আসন ছিল শূণ্য, ২০১৬ সালে ছিল ৩ টি।

বিজেপি নামের দলটির জন্ম হয় ১৯৮০ সালে। এর আগে ১৯৫১-৫২ সালের প্রথম নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদী দল হিন্দু মহাসভা ও ভারতীয় জনসংঘ -দুই দল মিলে ১৩ টি আসন পেয়েছিল। জনসংঘ থেকেই বিজেপির জন্ম হয়। বিজেপির জন্ম ১৯৮০ সালে হলেও এর আধ্যাত্মিক সংগঠন আরএসএস এর জন্ম ১৯২৫ সালে। বিজেপির আজকের এই সাফল্যের পিছনে মূল চালিকাশক্তি হল আরএসএস।

আরএসএসের উগ্রবাদী চরিত্রকে ভারতের সবাই সমর্থন করে না। তবে এদের রুখে দাঁড়ানোর জোরালো কোন পদক্ষেপ খুব একটা দেখা যায়না। এটা স্পস্ট বিজেপি ধর্মের নামে উগ্রতার বিষবাষ্প ছড়ায়, তবু এদেরকে মৌলবাদী তকমায় ভূষিত করা হয় না। এদের কার্যক্রমকে বন্ধ করতেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না।

আরএসএস পশ্চিমবঙ্গে ইতোমধ্যে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। রাজ্যটির ৩৪১ টি ব্লকের সবকটিতে আরএসএসের ইউনিট আছে। রাজ্যের ৩ হাজার ৩৪২ টি গ্রাম পঞ্চায়েতের অর্ধেক এখন তাদের হাতে। প্রতিটি পঞ্চায়েতে তারা শাখা করতে চায়। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে আরএএসের শাখা ছিল ৫৮০। এক দশকে এই সংখ্যা চারগুণ হয়েছে। বলে রাখি শাখাগুলোতে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একবার বৈঠক হয়। বছরে ৬ টি উৎসব হয়।

আরএএস এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে সদস্য রিক্রুট করে৷ সদস্যদের দক্ষতা বাড়াতে বিভিন্ন কর্মশাল পরিচালনা করে। তথ্য প্রযুক্তির দক্ষতা বাড়াতে আইটি মিলন নামে কর্মশালা হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল প্রতি বছর আরএসএস এর সদস্য সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৯ সালের দ্য প্রিন্ট-এর হিসাব মতে আরএসএসের সদস্য হতে পশ্চিমবঙ্গ থেকেই বেশি আবেদন জমা হয়েছে। বাম ফ্রন্টের দাপটে এক সময় পশ্চিমবঙ্গে দলটি দাঁড়াতেই পারেনি।

সময়ের পরিক্রমায় আজ বামফ্রন্টের অবস্থান কতটা নাজুক এবারের নির্বাচন তা বলে দিচ্ছে। দলটি এবার একটি আসনও পায়নি। একই অবস্থা প্রাচীন দল কংগ্রেসের। কংগ্রেস, বামফ্রন্ট ও আব্বাস সিদ্দক্কীর দল ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট মিলে সংযুক্ত মোর্চা গঠন করা হয়েছিল।

পশ্চিমবঙ্গে আরএসএসের আজকের এই অবস্থান হটাত করেই তৈরি হয়নি। এর জন্য ব্যয় করতে হয়েছে ছয় যুগ। ধীর পায়ে চলে সংগঠনটি পশ্চিমবঙ্গে মহীরুহ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। আরএসএস শক্তিশালী হওয়া মানেই বিজেপির শক্তি বৃদ্ধি হওয়া। আরএসএস থেকেই বিজেপির নেতা নির্বাচিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ আরএসএসের প্রচারক ছিলেন৷

লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ৪২ জন প্রার্থীর ২৯ জন ছিলেন আরএসএস-এর সংগঠক৷ ২০১৯ সালের এই নির্বাচন বিজেপিকে আশাতীত সাফল্য উপহার দিয়েছিল। বিজেপি ১৮ টি আসন নিজের ঝুলিতে ভরেছিল। এই জয়ের পিছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল আরএসএস। ২০১৩-১৮ সালের মধ্যে রাজ্যজুড়ে আরএসএসের উদ্যোগে স্কুল, কলেজ ও সেবাকেন্দ্র গড়ে ওঠে।

মজার ব্যাপার হলো আরএসএস বিনা বাধায় এসব কাজ সমাধা করে। সেই সময় মমতার সাথে বিজেপির সখ্য ছিল। পশ্চিমবঙ্গে আরএসএসের উত্থান মমতার আমলেই হয়েছে। পূর্বেই বলেছি বামদের আমলে আরএসএস খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি।

বামদের হটাতে বিজেপি প্রথমে মমতাকে সমর্থন দেয়। মাওপন্থীদের দমনেও তারা সক্রিয় ছিল। মমতার এককালের বন্ধুই আজ প্রধান প্রতিপক্ষে পরিণত হয়েছে। এবারের নির্বাচনে বিজেপি হেরে গেলেও সামনের নির্বাচনে মমতাকে বিদায় করতে এখন থেকেই কাজ শুরু করবে তা বেশ বুঝতে পারা যায়৷

আসামেও এক সময় বিজেপির কোনো অবস্থানই ছিল না। বলা হয় দেশভাগের পর পুরো আসামে আরএসএসের সদস্য ছিল তিনজন। সেই সংখ্যা এখন হাজার ছাড়িয়ে লক্ষের কাতারে চলে গেছে। এখন আরএসএস ক্যাডারই আছে আনুমানিক ২৫ হাজার। ৯০০-এর বেশি ‘শাখা’ আছে তাদের। নানা নামে অঙ্গ সংগঠন আছে ২১টি। বিদ্যাভারতী স্কুল আছে প্রায় ৫০০।

এখন বলতে গেলে আসামের প্রধান শক্তি হল বিজেপি। টানা ২য় বারের মতো তারা বিধানসভায় জয় পেল। ২০১১ সালেও বিধানসভা নির্বাচনে দলটি মাত্র ৫ টি আসন পেয়েছিল। ২০১৬ সালে এসে পায় ৬০ টি আসন। এবারের নির্বাচনে বিজেপি ৭৪ টি আসন পেয়েছে। আসামে আরএসএসের নীতি মানুষ গ্রহণ করেছে। পশ্চিমবঙ্গেও কি আরএসএসের নীতির বাম্পার ফলন ঘটবে?

আরও পড়ুন