Ads

পাক-রুশ বন্ধুত্বের নয়া দিগন্তে ভারতের আকাশে ঘন কালো মেঘ

মো. মিরাজুল ইসলাম

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা কথা আছে, “স্থায়ী শত্রু বা মিত্র বলে এখানে কিছুই নেই, যা আছে তা হলো স্বার্থ “। স্নায়ুযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয়ের পিছনে আজকের পাকিস্তানের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৯৭৯-১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সোভিয়েতের আফগান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আফগান মোজাহেদিন, আল-কায়দা গঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল পাকিস্তানের, অর্থ সহায়তা করত সৌদি আরব, আর সেই অর্থের বিনিময়ে অস্ত্র সরবরাহ করত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এককথায় বললে, আজকের তালিবান এবং আল-কায়দা সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানের প্রডাকশন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট। এটা ওবামা প্রশাসনের আমলে হিলারি ক্লিন্টন খোলাখুলিভাবে স্বীকার করেছেন যে তখন প্রয়োজনে আমরা তালিবান সৃষ্টি করেছিলাম। যাইহোক সে অনেক কথা। মূল আলোচনায় আসা যাক।

সম্প্রতি (এপ্রিল, ২০২১) রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ভারত সফর শেষে পাকিস্তান হয়ে দেশে ফিরে যান। এটা ছিল দীর্ঘ ৯ বছর পরে রাশিয়ার কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার পাকিস্তান সফর। এখানে দ্বিপাক্ষিক নানান ইস্যু নিয়ে পৃথক পৃথক বৈঠকে ল্যাভরভের সাথে আলোচনা হয় পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কোরেশি এবং পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সাথে। পাকিস্তানের ভাষ্যমতে, ভ্লাদিমির পুতিন ল্যাভরভ মারফত পাকিস্তানকে Blank Cheque পাঠিয়েছেন। পাকিস্তান এই চেকের কতটা সুযোগ নিতে পারে, কতটা অংক বসিয়ে নানান সুযোগ আদায় করে নিতে পারে, সেটাই দেখার বিষয়।

ল্যাভরভের ভাষ্যমতে,

সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানের ভূমিকা অত্যন্ত কার্যকরী ও ফলপ্রসূ। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানকে যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দেওয়ার জন্য রাশিয়া প্রস্তুত।

ল্যাভরভের মতে,

পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে আফগান সমস্যা সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে আফগান শান্তি আলোচনায় রুশ কর্তৃপক্ষ মধ্যস্থতার ঘোষণা দিয়েছেন এবং তালেবান কর্তৃপক্ষের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন। এখানে রাশিয়ার ভূমিকা কার্যকরী করার পিছনে মূল কারিগর হলো পাকিস্তান, আর সহকারী কারিগর হলো তুরস্ক ও কাতার। এসব প্রেক্ষিতে এই মুহূর্তে পাকিস্তানকে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানে যে কোনো ধরনের সামরিক সরঞ্জাম দিতে রাশিয়া প্রস্তুত। কিন্তু এখানে ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি থেকে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে শীতল যুদ্ধ থেকে শুরু এখন পর্যন্ত ভারত সর্বদাই সোভিয়েত এবং পরবর্তী রাশিয়ার পাশে ছিল, তো রাশিয়া এখন কেন পাকিস্তান পক্ষাবলম্বন করবে? এত দিনের বন্ধুত্বের ফলাফল কি এটা?

এই প্রশ্নের উত্তরে যদিও রাশিয়া এখনো খোলামেলা কিছু বলেনি, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এর পিছনে সুদীর্ঘ ও চৌকস কোনো প্লান নিয়েই খলনায়ক পুতিনের রাশিয়া দক্ষিণ এশিয়ায় পদার্পণ করতেছে।

এটা জেনে রাখা দরকার যে এখনো পর্যন্ত ভারতের আমদানিকৃত সামরিক সরঞ্জামের ৮০% এর বেশি অস্ত্রশস্ত্র রাশিয়ার। ভারতের শক্তিশালী ব্রহ্মস ক্রুজ মিসাইল রাশিয়ার সাথে যৌথভাবে গবেষণার ফলাফল। এছাড়াও বিদ্যুৎ খাতে ভারতের শান্তিপূর্ণ পরমাণু কার্যক্রম ও সামরিক ক্ষেত্রে পারমাণবিক বোমা তৈরিতে রাশিয়ার সহযোগিতা ছিল অনস্বীকার্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চীন ও পাকিস্তানকে মোকাবেলায় ভারত যুক্তরাষ্ট্রের শরণাপন্ন হয় এবং রাশিয়া থেকে ব্যাপক মাত্রায় অস্ত্র আমদানির হার হ্রাস করে ফেলে। যদিও ২০২০ সালে হঠাৎ করে লাদাখের গালওয়ান ভ্যালিতে চীন-ভারত উত্তেজনা দেখা দিলে ভারত সামরিক সহায়তা এবং সমাঝোতার জন্য রাশিয়ার শরণাপন্ন হয়, তবুও ভারতের দৃষ্টি এখন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কোষাগারে। তবে ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে লাদাখ ইস্যুতে ভারতের রাশিয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না, কেননা এখানে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিলেও চীন সরাসরি এ প্রস্তাব নাকচ করে দেয়৷ তাই উত্তেজনা প্রশমন করতে এবং ভারতের নিজ ভূখণ্ড রক্ষায় নয়াদিল্লি পুতিনের পা ছুঁতে বাধ্য হয় এবং তৎক্ষনাৎ কিছু ফাইটার জেট ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম কেনার চুক্তিতে সই করে।

২০১৮ সালের অক্টোবরে রাশিয়ার অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ ক্রয়ে ভারত-রাশিয়া চুক্তি হলেও এটা ঝুলন্ত রয়েছে। কারণ ভারত যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের Indo-Pacific Strategy এর সক্রিয় পার্টনার তথা কোয়াডের অন্যতম সদস্য, তাই যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই ভারতের হাতে রাশিয়ার এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চলে আসুক তা ইতিবাচক দৃষ্টিতে নিবে তো না-ই, বরং নানাভাবে চাপে ফেলবে এতে কোনো সন্দেহ নেই । এমনকি চীন ইস্যুতে ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন উঠে যেতে পারে, আর তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত বন্ধুহীন হয়ে পড়বে।

রাশিয়া বিষয়টি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে পর্যবেক্ষণ করেই তার চির বৈরি পাকিস্তানের সাথে হাত মিলিয়েছে। ভবিষ্যতে নতুন কোনো স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হলে গোলপোস্ট ঠিক থাকলেও খেলোয়াড় হয়ত রদবদল হবে এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট। এমনকি এরদোগানের তুরস্ক হতে পারে অন্যতম খেলোয়াড়।

দেখা যাক পুতিনের Blank Check পাকিস্তান কতটা কাজে লাগাতে পারে। তবে ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ পাকিস্তান এই মুহূর্তে চীন-রাশিয়া-তুরস্ক-ইরানের সাথে সম্পর্কটা আরও মজবুত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। যে করেই হোক #পিটিআই এর ইমরান সরকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করার জন্য মরিয়া হয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার।

কয়েক দশকের বন্ধুত্বের অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তানের অন্ধ সমর্থক সৌদি আরব এবং আরব আমিরাত এই মুহূর্তে পাকিস্তান থেকে মুখ ফিরিয়ে ভারতের সাথে নানামুখী পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। এমনকি এখানে কাশ্মীর ইস্যুটা সৌদি-আমিরাতের কাছে কোনো ইস্যুই না।

২০১৮ সালের অক্টোবরে পুতিন নয়াদিল্লি সফরে আসলে নরেন্দ্র মোদি এস-৪০০ ক্রয়ের জন্য রাশিয়ার সাথে ৫২০ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি সই করে। এই চুক্তির বিনিময়ে রাশিয়ার অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ এর কয়েক ব্যাটারি ভারতকে দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। কিন্তু এরপর থেকে ভারতের কৌশলগত নতুন মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনীতিক পর্যায়ে ভারতকে চাপের হুমকিও দেয়। কিন্তু ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে লাদাখ সমস্যার আগে ভারত মার্কিনীদের এই চাপকে খব একটা গুরুত্ব দেয়নি।

গতবছরের মাঝামাঝি সময়ে লাদাখ সীমান্তে চীনের সাথে ভারতের উত্তেজনা সৃষ্টি হলে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং মস্কো সফরে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত এস-৪০০ দ্রুত পাবার জন্য রাশিয়াকে তাগিদ দেয় বলে নানান মিডিয়া সূত্রে জানা যায়। কিন্তু এশিয়ার জায়ান্ট এবং উদীয়মান বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি চীনকে রুখতে ২০২০ সালের শেষের দিকে ভারত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে কোয়াড নামে নতুন জোট গঠন করে। তারপর থেকেই এস-৪০০ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে মারাত্মক চাপে রেখেছে। গত মার্চ ২০২১, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লয়েড অস্টিন দিল্লী সফরে আসলে এস-৪০০ ইস্যুটি নতুনভাবে উত্থাপিত হয় বলে মিডিয়া সূত্রে জানা যায়। ঠিক তার পরের মাস অর্থাৎ এপ্রিলে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ভারত সফরে আসলে এস-৪০০ ইস্যুসহ নানান ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থা নড়বড়ে মনে হলে দিল্লি সফর শেষ করে তিনি সরাসরি ভারত থেকে পাকিস্তানে যান। বিভিন্ন মহলের ধারণা তাহলে কি এস-৪০০ এর চুক্তি পাকিস্তানের সাথে হতে যাচ্ছে?

আমার দৃষ্টিতে যেহেতু এই মুহূর্তে পাকিস্তানে ভঙ্গুর অর্থনীতি বিরাজ করছে, কাজেই ইসলামাবাদের সাথে মস্কোর অবকাঠামোগত চুক্তির পাশাপাশি হালকা-পাতলা সামরিক সরঞ্জামের চুক্তি হতে পারে। তবে দীর্ঘ পরিক্রমায় পাকিস্তান রাশিয়ার এস-৪০০ এর চালান পেলে অবাক হওয়ার কিছুই নেই এবং ভারতের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির কারণে চোখবুঁজে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে বলে মনে হয় না। ভারতের রাফায়েলকে কাউন্টার দেওয়ার জন্য রাশিয়ার তৈরি পঞ্চম প্রজন্মের স্টেলথ্ ফাইটার সুখোই-৫৭ এবার মনে হয় পাকিস্তানের হাতে চলেই আসবে। কেননা পাকিস্তান তাদের জেএফ-১৭ থান্ডার নিয়েই যতই বড়াই করুক না কেন সেটা ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি তেজাসকে মোকাবিলা করতে সক্ষমতা রাখলেও রাফালের কাছে এই জেএফ-১৭ থান্ডার যে কোনো পাত্তাই পাবে না, সেটা পাকিস্তান ভালো করেই জানে।

এটা মাথায় রাখা জরুরী যে বাইডেন প্রশাসন এস-৪০০ ইস্যুতে ভারতকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিবে বলে ভাবাটাও বোকামির সামিল। আর পাকিস্তান এটাই সুবর্ণ সুযোগ মনে করে পুরনো সকল ভেদাভেদ ভুলে রাশিয়ার সাথে দহরমমহরম সম্পর্ক চালিয়ে যাবে বলে আমার দীর্ঘ বিশ্বাস। আবারও একই কথা পুনরাবৃত্তি করবো যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্থায়ী শত্রু-মিত্র বলে কোনো বাণী নেই। এখানে সকল সম্পর্কের মূলে রয়েছে পারস্পরিক স্বার্থ। স্বার্থ ফুরালে সম্পর্কও তলানিতে এসে পড়ে।

আমরা অপেক্ষা করছি পাক-রুশ সম্পর্কের নতুন নতুন কেমিস্ট্রি দেখার জন্য। আরো অপেক্ষা করছি যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।

 লেখকঃ কলাম লেখক ও ছাত্র, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন