Ads

প্যালেস্টাইন সংকটঃ মিঠেকড়া আলাপ

এম আর রাসেল 

প্যালেস্টাইন ইস্যু এতদিন বলতে গেলে ঝিমিয়ে ছিল। মাঝে মাঝে পত্রিকায় শিরোনাম হলেও বর্তমান সময়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছে৷ কিছুদিন পরে ঠিকই হারিয়ে যাবে। এমনটাই তো হয়ে আসছে গত কয়েক যুগ ধরে। বিশ্ব রাজনীতির খেলার মাঠে একের পর এক আসর জমে উঠে। কিছু খেলা সাময়িক উত্তেজনা জাগিয়ে চিরতরে হারিয়ে যায়। আর কিছু খেলা স্মৃতিকোষে চিরস্থায়ী আবেদন রেখে স্থিত হয়। সময়ে সময়ে এই খেলার আয়োজন করা হয়।

এমনি এক খেলার মাঠ হল প্যালেস্টাইন। সময়ে সময়ে এই মাঠ রক্তাক্ত হোলিখেলায় কেঁপে উঠে। খেলা তখনই জমে উঠে যখন দুই পক্ষই সমান শক্তিশালী হয়। নয়তো এই খেলায় এক পক্ষের উপর্যুপরি আক্রমণে অন্য দল শোচনীয় পরাজয় বহন করবে এমনটাই স্বাভাবিক।

প্যালেস্টাইন ও ইসরাইলের খেলায় যুগের পর যুগ ধরে একপক্ষই বারংবার পরাজিত হচ্ছে। পরাজিত পক্ষের উপর বিজিত পক্ষ যাচ্ছেতাই আচরণ করে ইতিহাসের পাতায় এমনটাই চোখে পড়ে। দখলদার শক্তি ইসরাইল তেমনটাই করে চলেছে। এখন প্রশ্ন হলো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় প্যালেস্টিনিয়ানরা বার বার পরাজিত হয়েও নিজেদের শক্তিশালী করতে কোন পদক্ষেপ নিয়েছে কি?

ইতিহাস বলে মধ্যপ্রাচ্যের সমৃদ্ধ এলাকা ছিল কেনান মানে প্যালেস্টাইন। অনেক আগে থেকেই এ এলাকার মানুষ শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রগামী ছিল। অধিকার আদায়ের সংগ্রামেও তারা একধাপ এগিয়ে ছিল। উসমানীয়দের অধীন থেকে স্বাধীন হওয়ার চেষ্টাও তারা করেছিল অনেক আগে থেকেই। ১৮৭৫ সালে তারা প্রথম আরব ঐক্য প্রচেষ্টার উদ্যোগ নেন। সাত বছর পরে তারা মিশরের ওরারি আন্দোলনে শরিক হন।

১৯১৯ সালের অল-প্যালেস্টাইন পার্টি, ১৯২০-এ আরব কংগ্রেস, ১৯২৫-এ ট্রেড ইউনিয়ন, ১৯২৯-এ উইমেন ফেডারেশন, ১৯৩১-এ জার্নালিস্ট মুভমেন্ট, বেদুইন আদালত, ১৯৩৪-এ জয়েন্ট একশন ফর লিবারেশন ফোরাম প্রভৃতি সকল উদ্যোগের সাথেই তাদের নাম জড়িয়ে আছে।

লড়াকু এই জাতি কেন আজ অন্য রাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠাতেও তারা ব্যর্থ। হামাস- ফাতাহ দ্বন্দ্ব, পিআইজে, গ্রুপগুলো একত্র হলেও প্যালেস্টিনিয়ানরা শক্তিশালী হতো। অন্য রাষ্ট্ররা আর যাই হোক স্বাধীন প্যালেস্টাইন প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে না এটা নিশ্চিত।

বৃহৎ অর্থে প্রতিটি রাষ্ট্রই নতুন ভূমি পেতে চায়। জার্মান দার্শনিক রেজেলের তত্ত্ব তো তাই বলে। অন্য রাষ্ট্র যতই মুখে নীতির গান শোনাক সুযোগ পেলে কেউ নতুন ভূমি দখল থেকে বিরত থাকবে না। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আরব ইসরাইল ১ম যুদ্ধে মিশর ও জর্ডান যথাক্রেমে গাজা ও পশ্চিম তীর দখলে নিয়েছিল। তখন মিশর ও জর্ডান চাইলেই তো স্বাধীন প্যলেস্টাইন রাষ্ট্র গঠন করতে পারতো, কিন্তু তা হয়নি। এর পর ২য় আরব ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল মিশর ও জর্ডানের কাছ থেকে গাজা ও পশ্চিম তীর ছিনিয়ে নেয়।

পড়ুনঃ বেয়াড়া সন্তানকে কেউ শাসন করে না

ধর্মীয় ভাবাবেগ বৈশ্বিক রাজনীতিতে একটি কৌশল হলেও আসল গন্তব্য নয়। যদি আসল গন্তব্যই হতো তাহলে আজ পুরো মুসলিম বিশ্ব পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী জোট হতো। আর প্যালেস্টাইন এতদিন মুসলিমদের দখলে থাকতো।

ইসরাইলকে শুরু থেকেই ব্রিটেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করে আসছে। পশ্চিমা শক্তি নিজস্ব স্বার্থ আদায়ে পৃথিবীর মধ্যখানে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সকল সহযোগিতা করেছে। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পিছনে শুধুই কি পশ্চিমাদের দায় দিলেই পিঠ রক্ষা পায়? হুসেইন পরিবার বা সৌদ পরিবারও কি সমান দোষে দোষী নয়? ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ফাঁদে পা দিয়ে আরব জাতীয়তাবাদ জিকির তুলে তারা কোন প্রকারান্তরে মধ্যপ্রাচ্যে চিরন্তন এক ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির পথ সুগম করে দিয়েছেন।

ব্রিটিশ ও ফ্রান্স একদিকে আরবদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে উসমানীয় শক্তিকে বিনাশ করেছেন। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে নিজেদের মাঝে গোপন চুক্তি করেছেন যা সাইকস-পিকট নামে পরিচিত। আবার বেলফোর ঘোষণা দিয়ে ইহুদীদের সমর্থন নিয়েছেন। ক্ষমতার বিস্তারে নীতির গান শুনে ভুলে গেলে চলবে না।

প্যালেস্টিনিয়ানরা এখন পর্যন্ত কোনো শক্তিশালী সামরিক বাহিনীই গড়ে তুলতে পারেনি৷ বিচ্ছিন্ন ভাবে চোরাগোপ্তা আক্রমণ করে আর যাই হোক শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল কোনো বাহিনীকে কাবু করা যায় না। হামাস, ফাতাহ, প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ সকলেই কোন না কোন পক্ষের সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছে। সম্মিলিত কোন উদ্যোগ নিতে পারলে ইসরাইল বেকায়দায় পড়ত এটা নিশ্চিত।

সাম্প্রতিক সংঘাতের দিকেই তাকানো যাক। হামাস একাই লড়ছে। সিরিয়া ও লেবানন থেকে দুই একটা রকেট ছুড়েই তারা ইস্তফা দিয়েছে। যদি সিরিয়া থেকে প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ, লেবানন থেকে হিজবুল্লাহ, গাজা থেকে হামাস, পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সকলেই সম্মিলিত ভাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধের রুখে দাঁড়াত তবে ইসরাইল নিমিষেই কাবু হয়ে যেত।

আজ সব গ্রুপগুলোই অন্য দেশের দরকষাকষির গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইরান, তুরস্ক যার নামই বলি সব দেশই নিজস্ব স্বার্থে গ্রুপগুলোকে সহায়তা করছেন। বিশ্ব রাজনীতির গভীরে চোখ দিলেই এই সত্যতা বুঝতে পারা যায়।

রাশিয়া ও চীনও প্যালেস্টাইন ইস্যুতে ইসরাইলের বিপক্ষে কথা বলছে এর পিছনেও রয়েছে ভূ-রাজনীতির জটিল হিসাব নিকাশ। মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বাড়াতে ও বৈশ্বিক নেতামিতে স্বচ্ছ ইমেজ তৈরিতে চীন প্যালেস্টিনিয়ানদের পক্ষে একটু-আধটু কথা বলছে। পূর্ব-ভূমধ্যাসাগর ঘিরে গ্যাস রাজনীতিতে মিশর ও ইসরাইলের পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করতে রাশিয়াও সরব থাকবে এটাই হলো মোদ্দা কথা।

সম্প্রতি ওআইসির সম্মেলনে তুরস্ক প্যালেস্টাইন রক্ষায় সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছেন। সন্দেহ নেই প্রস্তাবটি আশাদায়ক, কিন্তু প্রশ্ন হল এটি বাস্তবায়ন আদৌ কি সম্ভব? আল আকসা মসজিদের ঘটনা কেন্দ্র করে ওআইসির জন্ম হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। ওআইসির কাজের খতিয়ান আমাদের চোখের সামনেই আছে। নতুন এই প্রস্তাবের অগ্রগতি দেখতে হলে অপেক্ষা করতে হবে।

সর্বশেষ খবর হলো অস্ত্রবিরতিতে ইসরাইল ও হামাস সমর্থ হয়েছে। এমন ঘটনাও নতুন কিছু নয়। এর আগে ইসরাইল অপারেশন কাস্ট লিড, অপারেশন পিলার অফ ডিফেন্স, অপারেশন প্রোটেকটিভ এজ চালিয়েছিল। এবার পরিচালিত অপারেশন গার্ডিয়ান অফ দ্য ওয়ালস আপাতত বন্ধ হলেও প্যালেস্টিনিয়ানদের দুদর্শার কোন শেষ হবে কি? আবার হয়তো নতুন কোন অপারেশনে কেঁপে উঠবে প্যালেস্টাইন ভূ-খণ্ড। এর শেষে কবে হবে কেউ বলতে পারে কি?

মহীয়সীতে আরো পড়ুনঃ

গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন ও বাইডেনের ইসরাইল প্রীতি

ইসরাইল-ফিলিস্তিন বর্তমান সংকট ঘিরে রাজনীতির খেলা

 

আরও পড়ুন