এম আর রাসেল
হুমায়ূন আহমেদ- এর বই পড়ছিলাম। বইটির নাম ‘সকল কাঁটা ধন্য করে’। বইটি মূলত নানান কিছিমের গল্পের সংকলন। এখানে ‘আমরা কোথায় চলেছি’ শিরোনামে একটি গল্প আছে। গল্পটিতে একটি বাক্যে এসে থমকে গেলাম। লেখক লিখেছেন,
‘পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ জন্মায় হৃদয়ে জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়ে। সেই প্রদীপ যেন সারা জীবন জ্বলতে পারে সে জন্যে বাবা-মারা প্রদীপে তেল ঢেলে দেন। বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরাও এই কাজটি করেন। পরবর্তী সময়ে শিক্ষকরা এই দায়িত্ব পালন করেন। দেশের কবি-সাহিত্যিকরাও এই কাজটি পরোক্ষভাবে করেন। তাহলে কি ধরে নেব, প্রদীপে তেল ঢালার কাজটি আমরা করতে পারছি না? প্রদীপ যখন পূর্ণ। জ্যোতিতে জ্বলার কথা,তখন তা নিভে যাচ্ছে।’
আপ্তবাক্যটিতে গভীর ভাবনার সংকেত রয়েছে। আমরা প্রদীপে তেল ঢালার কাজ করছি কি? প্রশ্নটি আমাদের মনের আরশিতে ভেসে উঠে কি? একটু ভেবে দেখতে বলি!!
সামাজিক নানা অসংগতির প্রাচুর্য, তরুণ প্রজন্মের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কলুষতা , কিশোর গ্যাং-এর বিকাশ, নানাবিধ অপকর্ম ও অনাচারের দৌরাত্ম্য দেখলে বুঝতে পারা যায় আমরা সবাই নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করছি।
এখন অনেকেই হয়তো বলবেন আমাদের কিইবা করার আছে। তাদেরকে বলি আমাদের অনেক কিছু করার আছে। আমরা যারা শিক্ষার আলোয় নিজের অন্ধকার জগতকে আলোকিত করেছি, তাদের অন্য সবার মতো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরলে চলে না। আমাদের কিছু দায়িত্ব রয়েছে।
সমাজের তরে, দেশের তরে কিছুটা সময় ব্যয় করার প্রয়োজন রয়েছে। এই সময় ব্যয় আমরা করছি কি? ভেবে দেখতে বলি!!! শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে স্মরণ করতে বলি। উদ্দেশ্যকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন কি? যদি দিয়ে থাকেন তবে আপনি এভাবে নিশ্চুপ থাকতে পারেন না। জেগে উঠুন, আওয়াজ তুলুন।
এবার চলুন শিক্ষার সেই মূল উদ্দেশ্য কি সেটা জেনে আসি। আপনাদের প্রথমেই জন মিল্টনের কথা মনে করিয়ে দেই। ইংরেজি সাহিত্যের পিউরিটান যুগের শক্তিশালী প্রতিভা। প্যারাডাইজ লস্ট ও প্যারাডাইজ রিগেইন মহাকাব্যের স্রষ্টা। শিক্ষা নিয়ে এই মনীষীর একটি উক্তি আমরা প্রায় বলে থাকি। উক্তিটি হল- “Education is the Harmonious development of body mind and soul”।
এখন প্রশ্ন হল- আপ্তবাক্যটি কি শুধুই কাগজে ও কলমের নিবেই সৌন্দর্য ছড়িয়েছে, না সৌন্দর্যের সুবাসে আমাদের হৃদয় সুবাসিত করেছে? বাস্তবে এমন সুবাসিত হৃদয়ের মানুষ খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়।
এমন মানুষ না থাকলে প্রদীপে তেল ঢালার কাজ ব্যাহত হবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের শিক্ষিত সমাজের আলোকিত মানুষরা আজ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রদীপে তেল ঢালার কথা কি তাদের মনে পড়ে? মান্না দের সুরেই বলি ‘খুব জানতে ইচ্ছা করে’। শিক্ষিত সমাজের দুর্দশার চিত্র আজ স্পষ্ট। এ প্রসঙ্গে চীনা দার্শনিক লাও জু-এর কথা মনে পড়ছে। তিনি মনে করতেন যে,
‘জ্ঞানের প্রসারের সাথে সাথে বদমাশের সংখ্যা বাড়ছে বৈ কমছে না। তাই শুধু বিদ্যা লাভ করলেই চলবে না, প্রকৃতিকে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। বিদ্যার উদ্দেশ্য পার্থিব সাফল্য নয় অথবা সাফল্যের সাথে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালনা নয়। বিদ্যার উদ্দেশ্য হল ব্যক্তিসত্তার বিকাশ।’
আমাদের চারপাশ আজ বদমাশ দিয়ে ভরে গেছে। পার্থিব সাফল্যের জন্যই সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ঘটানোর সময় কোথায়?
আবার প্রদীপে তেল ঢালার জন্য যারা অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তাদের অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। তারা মুখে জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের বয়ান করেন। কিন্তু এই মধুর তত্ত্বকথার খোলসে যে কত দানবীয় মন লুকিয়ে থাকে তা খুব সহজে অবলোকন করা যায় না।
জ্ঞান অর্জন ও এর প্রয়োগ পদ্ধতি আজ সম্পদ অর্জনের প্রধানতম বিনিয়োগ মাধ্যম হয়ে পড়ছে। এখানে লাভ লোকসানের হিসাবটাই মুখ্য, অন্য সব গৌণ। এমন শিক্ষাব্যবস্থার কাছে প্রত্যাশার আর কিইবা থাকতে পারে।
শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ রুখতে না পারলে মানবিক গুনাবলী সম্পন্ন মানুষ পাওয়া যাবে না। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে গেঁথে দিতে হবে। এ ভিন্ন অন্য কোনো পথ নেই।
এ প্রসঙ্গে গ্রীক দার্শনিক প্রোটাগোরাস-এর একটি সুভাষিত উক্তি স্মরণ করিয়ে দেই। তিনি বলেছিলেন,
‘বিদ্যার উদ্দেশ্য দারিদ্র্যও নয়, ঐশ্বর্যও নয়। বিদ্যা আমাদের শিক্ষা দিবে কিভাবে এদের সমন্বয় করতে হয়। বিদ্যা শিক্ষা করে শিক্ষার্থীদের ঐশ্বর্যের দাস হলে চলবে না, বরং ঐশ্বর্যের প্রভু হতে হবে।’
আমরা কি প্রভু না দাস?- প্রশ্নটির জবাব খুঁজতে বলি।
লেখক- গবেষক ও কলামিস্ট