Ads

বসনিয় মুসলিম যুবতি ইয়াসমিনা ও আখেরাতের আদালত

।। জিয়াউল হক ।।

বসনিয়া মুসলিম নারী ইয়াসমিনা। তিরিশের ঘরে এখনও পা দেন নি। দুই শিশু পুত্র সন্তানের মা। স্বামী সার্ব পশুদের হাতে নিহত হয়েছে মাত্র কয়েক সপ্তাহ হলো। তার বাড়ি ঘরও সার্বরা পুড়িয়ে দিয়েছে। তিনি তার গ্রামের অন্যসব নারী শিশু’সহ আশ্রয় নিয়েছেন জাতিসংঘের আশ্রয় শিবিরে।

জাতিসংঘ মুসলমানদের আশ্রয় দিয়েছে একটি ক্যাম্পে, তাদের শান্তি মিশনের সৈন্যরা দিন রাত পাহারা দিয়ে নিশ্চিত করছে এই শিবির থেকে যেন কোন মুসলমান পালিয়ে যেতে না পারে। কিন্তু শিবিরের বাইরে বসনিয়া মুসলমানদের যে কচুকাটা করছে, তাদে ঘর বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করছে, পুরুষদের ধরে ধরে হত্যা করছে, নারীদের করছে ধর্ষণ, বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, সে সব রোধে তাদের কোন মাথাব্যাথা নেই। কারণ, তারা নিরপেক্ষ থাকতে চায়।

বসনিয় সৈন্যবাহিনী ও সাধারণ পুরুষরা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, তারও কোন সুযোগ নেই, কারণ তাদের উপরে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে জাতিসংঘ। তারা কোথাও থেকে কোন ধরনের অস্ত্র পাবে না, তাদের কাছে যেন কোন পক্ষ থেকে কোনরকম অস্ত্র সম্ভার পৌছুতে না পারে, তা নিশ্চিত করাও জাতিসংঘের দায়িত্ব। তবে তাদের জান ও মালের নিরাপত্তা দেবার কোন দায় নেই তাদের।

এই শরনার্থী ক্যাম্পে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নেয়া বা আশ্রয় পাওয়া বসনীয় নারীদের একজন হলেন সদ্য বিধবা যুবতি; ইয়াসমিনা। স্বামীকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে সার্বরা, তিনি কোন মতে শিশু দু’পুত্রকে নিয়ে পালিয়ে এসে উঠেছেন এ ক্যাম্পে। ভাগ্য ভালো যে সার্ব পশুদের হাতে ধরা পড়েন নি। ধরা পড়লে তারা নির্ঘাৎ তার দুই মাসুম বাচ্চাকে হত্যা করে তাকে বাঁচিয়ে রাখতো তার উপরে পাশবিক নির্যাতন চালানোর জন্য, যেমনটা অনেক নারীর বেলাতেই তারা করেছে।

শিক্ষিতা ও অত্যন্ত স্মার্ট ইয়াসমিনার জীবন ও জগৎ সব পাল্টে গেছে রাতারাতি। তিনি বুঝে গেছেন এ জমিনে তিনি নিরাপদ নন, নিরাপদ নয় তার দু’টি সন্তানও। এখান থেকে সরে পড়তে না পারলে তাদের সামনে, বিশেষ করে, তার দুই সন্তানের সামনে কোন নিরাপদ ভবিষৎ নেই। কিন্তু জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর ফরাসি সৈন্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দিয়ে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়াটা তো এক কথায় অসম্ভব এক ব্যাপার।

ক্যাম্পে জাতিসংঘেরই এক কর্মকর্তা রয়েছে। সেই কর্মকর্তা শরনার্থীদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ, আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মচারী কিংবা সংবাদকর্মীদের বিশেষ পাস সরবরাহ ও সুপারিশ করলে দয়াপরবশ হয়ে মানবিক (!) কারনে তারা কিছু নারী ও শিশুকে আমেরিকা’সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেতে দিতেন। এ ব্যবস্থা থাকার কারণে সেই ক্যাম্পের কর্মরত কর্মকর্তা বেশ কিছু নারীর নিকট থেকে মাথাপিছু তিন হাজার ডয়েশ মার্ক অর্থ ও সেই সাথে যৌনসম্ভোগের সুবিধার বিনিময়ে অনেক নারীকে সংবাদকর্মী বা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কর্মী সাজিয়ে বিশেষ পাস দিয়ে চলে যেতে সাহায্য করেছে।

নানা কানে এরকম গুজব শুনে ইয়াসমিনা যোগাযোগ করেছিলেন ফরাসি নাগরিক জাতিসংঘের সেই কর্মকর্তার সাথে। অসম্ভব সুন্দরী ইয়াসমনিার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারেনি সেই নারীলোলুপ ধর্ষক, শান্তিরক্ষক মিশনের শান্তিরক্ষী অফিসার! সে দয়া করে রাজী হয়েছে ইয়াসমিনা যদি তার শয্যাসঙ্গী হয় এবং দুই সন্তান ও নিজের জন্য মাথাপিছু তিন হাজার ডয়েশ মার্ক প্রদান করে নগদ, তা হলে তাকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করে বসনিয়া থেকে প্রতিদিন ছেড়ে যাওয়া জাতিসংঘের বিশেষ বিমানে করে বাইরের দুনিয়ায় চলে যেতে সে সহায়তা করবে।

এরকম একটা ডিল যখন পাকাপোক্ত, ঠিক তখনই বিষয়টা টের পেয়ে যান বিবিসির বিখ্যাত সাংবাদিক জন সিম্পসন (John Simpson)। জন নিজে উদ্যোগ নিয়ে ইয়াসমিনার সাথে কথা বলেন, বিস্তারিত জেনে নেন। এর পরে সারাজেভোর জাতিসংঘ দপ্তরে গিয়ে শরনার্থী শিবিরের প্রধান উক্ত কর্মকর্তার সাথে দেখা করে তার সাথে ইয়াসমিনার বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলাপও করেন।

উক্ত মানবতাবাদী মহান কর্মকর্তা বিষয়টি অস্বিকার না করে বরং খোলাখুলি তা স্বীকার করেন এবং জন’কে নিশ্চয়তা দেন যে, যদি ইয়াসমিনা তার সাথে কৃত চুক্তি বাস্তবায়ন করে তা হলে সেও তার কথা রাখবে এবং ইয়াসমিনা ও তার দুই সন্তানকে নিরাপদে বসনিয়া বা ইওগোশ্লাভিয়ার বাইরে চলে যেতে পারে, সে বিষয়টা নিশ্চিত করবে।

হ্যাঁ, জাতিসংঘের উক্ত কর্মকর্তা কথা রেখেছিলেন। কেননা ইয়াসমিনাও তাকে দেয়া তার ওয়াদা পালন করে শয্যাসঙ্গী হয়ে যৌনসূখ দিয়েছে নিজের দুই মাসুম বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য। সে নিজে বেঁচেছে, তার মাসুম দুই বাচ্চাকে নিয়ে আমেরিকা পাড়ি দিয়েছে। যাবার দিন বিমান উড়ার আগে সাংবাদিক জনের সাথে তার শেষমহুর্তে দেখা হয়ে যায়। সেই স্বাক্ষাতে ইয়াসমিনা মাত্র একটি বাক্যের দ্বারা সারা পুরুষ জাতি আর পুরো সভ্যতাগর্বিত বিশ্বের প্রতি যে ঘৃণা উগড়ে দিয়ে গেছেন, তা নাকি জন সিম্পসন সারা জীবনেও ভুলতে পারেন নি!

ভুলতে আমিও পারি না। বিশ্ব মুসলমানদের খেলাফত, বা একটি কেন্দ্রিয় রাজনৈতিক প্লাটফরম না থাকায় এরকম কত ইয়াসমিনা তাদের ইজ্জত হারিয়েছে তার হিসেব কে রাখে? বিশ্ব রাখেনি। তবে এক আল্লাহ নিশ্চয় রেখেছেন। পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে ফতওয়া ঝাড়তে, ‘কাফের’ ‘মুরতাদ’ আখ্যা দিতে ব্যস্ত আধুনিক আল্লামাদের সামনে হিসেবের সে খাতা সেদিন তিনি হয়তো মেলে ধরবেন। আমার যদি সুযোগ হয় সেদিন আল্লামাদের জবাব শোনার, তবে শুনবো। সে অপেক্ষায় বসে আছি।

লেখকঃ ইংল‍্যান্ডের বেসরকারী মানসিক হাসপাতালের সাবেক সহকারী পরিচালক ও লেখক, ইংল‍্যান্ড

লেখকের আরও লেখা-

কোন মুসলমান লেখক গবেষক কি এগিয়ে আসবেন না?

আরও পড়ুন