Ads

বস্ত্রহীন এ শহরে!

ডা: আলী জাহান

১. ভদ্রলোক গতকাল মারা গেছেন। আগে কিছু অসুস্থ ছিলেন। হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় সিলেটের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ সংসদের তিনি একজন নির্বাচিত এমপি ছিলেন। তাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তবে সিলেটে বাড়ি হবার সুবাদে অনেকবার নাম শুনেছি।

২.করোনা মহামারিতে কে, কখন মারা যাবেন তার কোনো হিসেব নেই। পরিচিত মুখগুলো যখন হঠাৎ হারিয়ে যায় তখনই ভাবনার উদ্রেক হয়। আমরা এ মহামারি পাড়ি দিতে পারবো তো! আমরা কেউই এই প্রশ্নের উত্তর জানি না। অনন্ত, অসীম শক্তির আধার মাবুদে এলাহীই একমাত্র জানেন যে, আমরা কারা এই মহামারিতে বেঁচে থাকবো।

৩. সিলেটের এক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফখর উদ্দিন। একসাথে এমসি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়াশোনা করেছি। একসাথে এমসি কলেজের হোস্টেলেও ছিলাম। সেই হিসেবে ফেসবুকে আমি তার সাথে সংযুক্ত। তিনি তার টাইমলাইনে গতকাল মারা যাওয়া সাবেক এমপির একটি ছবি শেয়ার করেছেন। ছবিটি দেখে আমি অবাক হয়েছি। বিস্মিত হয়েছি। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, সাবেক এ এমপিকে একটি ছোট মিছিল থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক সাহসী সন্তান জামার কলার ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন।

জামা ধরে টানা কি বাংলাদেশের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে? বেশ কয়েক বছর আগে আরেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে রাস্তায় গায়ের শার্ট খুলে পেটানোর ছবি এবং ভিডিও এখনো অনলাইনে ভেসে বেড়ায়। বস্ত্র হরণের এ ঘটনার কোনো বিচার হয়েছে বলে আমার জানা নেই। হলে হতেও পারে।

৪. নাগরিকদের বস্ত্রহরণ কখন থেকে শুরু হলো এবং এর কি আদৌ কোনো শেষ আছে? বস্ত্রহীন শহরগুলোতে বস্ত্র পরে কি থাকা যাবে না? নাকি বস্ত্র পরা একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার? প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের যদি এই পরিণতি হয় তাহলে সাধারণ মানুষের কি হতে পারে?

৫. অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিনের অধ্যাপক। পঞ্চম বর্ষে ওয়ার্ডে উনার ক্লাস করছি। স্যার হঠাৎ কথা প্রসঙ্গে স্কিজোফ্রেনিয়া নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। খুব সুন্দর একটি প্রশ্ন করলেন। তিনি আবার সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। অনেকদিন হয়ে গেছে স্যারের সেই প্রশ্ন এবং উত্তর আমার স্মরণ থেকে মুছে যায়নি। আপনাদের সাথে আমার সেই অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো।

৬. অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলছিলেন, আমরা পাগল না সুস্থ তা একটি আপেক্ষিক শব্দ। পোশাক পরা উচিত কিনা তাও আপেক্ষিক। স্যারের কথা শুনে আমরা একটু অবাক হলাম। স্যার বলতে থাকেন। ১০০ জন মানুষের মধ্যে মাত্র দু’জন Schizophrenia and Bipolar Mood Disorder (সহজ বাংলায় পাগলামি) রোগে আক্রান্ত। এদের অনেকেই রাস্তাঘাটে কাপড়় ছাড়া ঘোরাফেরা করে। বাকি ৯৮ জন সুস্থ আছে বলে দাবি করা হয়। অন্য কথায় বলতে গেলে পাগলদের সংখ্যা কম, সুস্থ মানুষদের সংখ্যা বেশি। সে কারণে তোমরা যখন রাস্তায় কোন বস্ত্রহীন লোককে দেখতে পাও তখন তোমাদের কাছে তা পাগলামি বলে মনে হয়। তবে সংখ্যাটা যদি উল্টে যায়। যেমন ধরো পাগলদের শহরে মাত্র শতকরা দু’জন সুস্থ মানুষ আর ৯৮ জন Schizophrenia/ Bipolar Mood Disorder রোগী থাকে তাহলে তাদের কাছে সুস্থ মানুষদের পোশাক পরে থাকাকে হাস্যকর মনে হবে। ওরা মনে করবে তোমরাই পাগল। বস্ত্রহীন ওই সমাজের বস্ত্র পরে থাকলে পোশাক বিহীন পাগলরা তখন আধুনিক পোশাক পরিহিত লোকদের নিয়ে খিলখিলিয়ে হাসবে। একজন আরেকজনকে বলবে ‘পাগলদের অবস্থা দেখো। কোনো প্রয়োজন ছাড়াই পোশাক পরে আছে’।

৭. মাঝেমধ্যে কল্পনায় বস্ত্রহীন শহরের দৃশ্য কল্পনা করি। সেই শহরে পোশাক পরা লোকদের বড়ো দুর্দিন। কারণ তাদের সংখ্যা নগন্য। তাদের পোশাক নিয়ে কেউ টানাটানি করলে বা খুলে ফেললে বাকি লোকেরা হাততালি দেয়। কেউ বলে না ‘ এ কাজটি আপনি করতে পারেন না।’

৮. সদ্য প্রয়াত সাবেক এ সংসদ সদস্যের ছবি দেখে আমি আমাকে প্রশ্ন করছি, আমরা কি আসলেই কোনো বস্ত্রহীন শহরে বসবাস করি?

লেখক ডা: আলী জাহানের গ্রাফিতি

ডা: আলী জাহান
ইংল্যান্ডে কর্মরত চিকিৎসক ও
সাবেক পুলিশ সার্জন ( Forensic Medical Examiner), British Police.
যুক্তরাজ্য।

আরও পড়ুন