Ads

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের মিঠেকড়া বয়ান

এম আর রাসেল

আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। দেশটি নিয়ে আমাদের দেশে মিশ্র অনুভূতির আলাপ শুনতে পাওয়া যায়। একদল আছেন যারা ভারত নাম শুনলেই নাক ছিটকায়। অন্য দল আছেন যারা ভারত প্রেমে গদ্গদ হয়ে আবেগের ভেলায় মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ান।

এর বাইরে অন্য একটি দল আছেন যারা ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়াতে ও আবেগিক প্রেমের গান গাইতে নিষেধ করেন। তারা স্মরণ করিয়ে দেন, ‘একটি দেশ আর যাই করুক তার প্রতিবেশী বদলাতে পারে না।’ আপনি কোন দলে থাকবেন সেটা একান্তই আপনার বিবেচনা। তবে বল্গাহীন আবেগ ও যুক্তিহীন আলাপ আর যাই হোক ভাল কিছুর সংবাদ দিতে পারে না। আবার নিজ দেশের জনগণ একে অপরকে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করেও যে কোনো ফায়দা পাওয়া যাবে না এটাও সুনিশ্চিত।

এখানে জানিয়ে রাখি, দুটি দেশের সম্পর্কের গভীরতা বুঝতে হলে জনগণের মতামতকে অবশ্যই আমলে নিতে হবে। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরের মতে, দুটি স্তরে দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়। একটা হল সরকার এবং সরকার, অপরটা হল জনগণ এবং জনগণ। তাই সম্পর্কের আসল স্বরূপ বুঝতে হলে শুধু সরকারের ভাষ্যকেই একমাত্র উৎস মনে করা যাবে না। জনগণ এবং জনগণের সম্পর্কে কেমন সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

ভারত যা কিছু করে তা নিজ স্বার্থ মাথায় রেখেই করে। আমাদের দেশও এমন জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনায় রেখে সকল কাজ করতে পারলে আজ ভিন্ন কিছু দেখা যেত। ভারত বাংলাদেশের সম্পর্কের সূচনালগ্নে ইন্দিরা গান্ধীর এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘‘অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন মতামত রয়েছে, তবে প্রতিটি দেশের উচিত নিজস্ব পথ অনুসরণ করা। বন্ধুত্বের ভিত্তি পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে হওয়া উচিত।’

ভারত নিজস্ব পথ অনুসরণ করছে। আমাদের পথটা কি এখনও নির্দিষ্ট হয়েছে? আমরা দেখতে পাই, ভারতে কংগ্রেস বা বিজেপি যেই ক্ষমতায় থাকুক না কেন তাতে কৌশল পরিবর্তিত হয়েছে কিন্তু পথ একই আছে। পক্ষান্তরে আমাদের দেশে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে ভারতের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারেও আমূল পরিবর্তন ঘটে।

সম্পর্কের মধুচন্দ্রিমা বা বিষাদপর্ব উভয় সময়ে বাংলাদেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়েছে। এর পিছনের কারণগুলো নিয়ে গভীর জানাশোনার প্রয়োজন রয়েছে। কেবল উল্লম্ব হুংকার আর হম্বিতম্বি প্রদর্শন করলেই প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাবে না।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে সচরাচর যেসব মতামত চোখে পড়ে বেশিরভাগই আমার কাছে পক্ষপাতদুষ্ট মনে হয়। খুব কম লেখাতেই নিরপেক্ষ বয়ান দেখতে পেয়েছি। আবার বেশিরভাগ লেখাতেই ইনিয়ে বিনিয়ে ভারতের স্তুতিগান গাওয়া হয়েছে।

জেনে রাখা ভালো, বিশ্ব ব্যবস্থায় এক দেশের সাথে অন্য দেশের সম্পর্ক নির্ধারণে এর ছিটেফোঁটা মূল্যও নেই। আজ ভারত বন্ধু আগামীকাল এই বন্ধুই গলায় ছুরি বসাবে না এর কোন নিশ্চয়তা আছে কি?

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারত মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। এর জন্য ভারতের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো, কিন্তু এর জন্য নিজ দেশের সুবিধা আদায়ে জোর গলায় কথা বলব না এমন তো কোনো কথা নেই।

একটি দেশের স্বাধীনতা অর্জনে অন্য দেশ সাহায্য করে এমন উদাহরণ বিশ্বে প্রতুল। এটাকে বিশাল কোন ব্যাপার মনে করার যুক্তিসংগত কারণ আছে কি? ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে নিজের প্রয়োজনে। এই ভারতই স্বাধীনতার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীকে অস্ত্র সহায়তা দিয়েছে। সম্পর্কের মূল্যায়নে এই বিষয়টিকেও মাথায় রাখতে হবে।

বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের ৫০ বছরের দীর্ঘ সময়ের মূল্যায়ন করতে গেলে হতাশার চিত্রই বেশি চোখে পড়ে। এক ছিটমহল বিনিময় ও সমুদ্র সীমা বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যতীত আর কোন ভালো খবর আছে কি? আবার এর মধ্যেও ছিটমহল বিনিময় নিয়ে কথা আছে। ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তির সফল রূপায়ন ঘটেছে ২০১৫ সালে। বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে চুক্তি হলেও এতদিন বিষয়টা ঝুলে ছিল। কেন এত দেরি হল এ বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করলে দোষের কিছু হবে কি?

ীমান্ত হত্যা, পানি বণ্টন চুক্তি, বাণিজ্যিক ঘাটতি নিরসন, ট্রানজিট সুবিধা প্রভৃতি বিষয়গুলো এই ৫০ বছরেও সমাধান হয় নি। বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে প্রতি বছর মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটছে। পৃথিবীর অন্য কোনো সীমান্তে এমন ঘটনা অপ্রতুল। বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের সীমান্ত বাহিনীর কাছে এমন উপহার অন্য কোন দেশ পায় কিনা আমার জানা নেই।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। এত বছর ধরে এই কমিশন প্রত্যাশিত কোন কাজই করতে পারেনি। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে আজ মরুভূমি হওয়ার উপক্রম অথচ এ নিয়েও যৌক্তিক কোনো সমাধা এখনও হয়নি। এত বছরের তিস্তা চুক্তি অধরাই থেকে গেছে। বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশ ভারতের ৫৪ অভিন্ন নদীর প্রায় প্রত্যেকটির প্রবেশ মুখেই ভারত বাঁধ দিয়েছে। এর ফলে আমরা উপহার পেয়েছি চমৎকার সুন্দর চকচকে ধূলিতপ্ত এক একখানি মরুভূমি।

স্বাধীনতার পর ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক বাজারে পরিণত হয় বাংলাদেশ। এক সময় ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের পাট শিল্প ভালো পর্যায়ে ছিল। ভারতের পাটশিল্প কাঁচামাল সংকটে ভুগত। আজ বাংলাদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করে ভারত বিদেশ থেকে মুনাফা আয় করছে। এই কাঁচামাল আমদানিতেও রয়েছে ডাম্পিং-এন্টি ডাম্পিং এর খেলা। এতে বাংলাদেশের লাভ নেই বললেই চলে।

বর্তমান বাংলাদেশের পাট শিল্পের করুণ দশা আজ কারও অজানা নয়। উপমহাদেশের বৃহত্তম পাটকল আদমজী বন্ধের পিছনেও ভারতের হাত থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের বিপণন মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ এর একটি মতামত খেয়াল করি। তিনি বলেছেন,

“২০০২ সালের দিকে আদমজি জুট মিল বন্ধ হয়ে যায় বিশ্বব্যাংকের ফর্মুলায়। ওইসময় বিশ্বব্যাংকের লোনে ইন্ডিয়াতে বড় মিল স্থাপিত হয়েছে। এতে ইন্ডিয়া লাভবান হলো, আমাদের সব বায়ার তারাই পেল।”

পণ্য আমদানি রপ্তানিতে বাংলাদেশ ভারতকে যে পরিমাণ শুল্ক ছাড় দিয়েছে ভারত এর বিনিময়ে তেমন কিছুই করেনি। বিশ্লেষকরা বাংলাদেশ ভারতের বাণিজ্য ঘাটতির অন্যতম কারণ হিসেবে ভারতীয় নীতিকে দায়ী করেছেন।

সাফটা চুক্তিতে উল্লিখিত পণ্যের শুল্ক হ্রাসের ব্যাপারে ভারত কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। আবার বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য পণ্যতে ভারত ২০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করে থাকে। অন্যদিকে ভারত যে ৫১৩ টি পণ্যের উপর শুল্ক ছাড় দিয়েছে এর মধ্যে ৩৫০ টি পণ্য বাংলাদেশের পক্ষে কোনভাবেই রপ্তানি করা সম্ভব না।

বিপরীত পক্ষে ভারতের পণ্যে শুল্কহার কমতে কমতে বর্তমানে ৪৫.৫ ভাগে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯৩-৯৪ সালে ভারতীর পণ্যের ওপর শুল্কহার ধার্য ছিল শতকরা ৩০০ ভাগ। ১৯৯৪-৯৫ সালে তা কমিয়ে আনা হয় ৬০ ভাগে। একসময় বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে ভারতের পক্ষ থেকে ট্রানজিট ও চট্রগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয় উল্লেখ করতো। এখন ভারত এই ট্রানজিট সুবিধা পেয়েছে। দেখার বিষয় বাণিজ্য ঘাটতি কমে কিনা।

বাংলাদেশের সরকারি থিংকট্যাঙ্ক বিআইডিএস এর গবেষক কেএসএম মুরশিদ এর গবেষণা বলছে, ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ লাভ সীমিত। অন্যদিকে বিভিন্ন সময়ে ভারত বাংলাদেশকে ঋণ দিয়ে থাকে। বন্ধু দেশ আমাদেরকে ঋণ দিবে এটা ভালো কথা। কিন্তু এখানেও কথা রয়েছে। ভারত সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় ঋণ দিয়ে থাকে। এর ফলে ঋণদাতা দেশই লাভবান হয় বেশি। এই ঋণের মূল কথা হল ঋণের অর্থ যেসব প্রকল্পে ব্যয় হবে তার কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও সেবা ভারত থেকে কিনতে হবে। এসব প্রকল্পে ভারতের লোকেরও কর্মসংস্থান হবে। এখানে আমাদের প্রাপ্তির পাল্লা ভারী না হালকা তা সহজেই বুঝতে পারা যায়।

আঞ্চলিক কানেকটিভিটি নিয়ে বর্তমান সময়ে জোরশোরে আলোচনা চলছে। বিশেষ করে বিবিআইএন করিডোরের ব্যাপারে কথা হচ্ছে। এই করিডোর বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরো এগিয়ে যেত। কিন্তু ভারতের কারণে এই করিডোর এখনও আলোর মুখ দেখেনি। এখানে জানিয়ে রাখি এই বিবিআইএন ( বাংলাদেশ- ভূটান- ভারত-নেপাল) করিডোরের পূর্বনাম ছিল দক্ষিণ এশীয় উন্নয়ন চতুর্ভুজ ( SAGQ). এই প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। এত বছরের এই কানেকটিভিটি আশার মুখ দেখেনি। এর জন্য অনেক বিশ্লেষক ভারতকেই দায়ী করেছেন। তারা বলছেন, ভারত শুধু চায় দ্বিপাক্ষিকতা, বহুপাক্ষিকতা ভারতের নীতি নয়।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতার আলোকে নেপালের জলসম্পদকে কাজে লাগানোর কথা বলে আসছে। এ ব্যাপারেও ভারত বাংলাদেশকে কোনো সহযোগিতা করেছে বলে জানা যায় না। ভারত ভূটান ও নেপালের জলসম্পদকে নিজের কাজে লাগিয়েছে। ভারত নেপালের ৪ টি নদীতে (কর্ণালী, পঞ্চেশ্বর, সপ্তকোষী ও বুড়িগন্ধকী) স্টোরেজ ড্যাম নির্মাণ করেছে। ভূটানের সাংকোশ নদীতে ড্যাম নির্মাণে ভারতের সাথে ভূটানের চুক্তি রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘নেপালে যে জলসম্পদ রয়েছে তা কাজে লাগিয়ে এক লাখ মেগাওয়াটের ওপর বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা সম্ভব, যা শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারত, এমনকি সুদূর পাকিস্তানেও নিয়ে যাওয়া সম্ভব।’ ২০১৭ সালে ভূটানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরকালে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। ভারত এগিয়ে না আসায় তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।

এতসব আলাপের পর একটা বিষয় পরিষ্কার ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের নীতি নিজ সুবিধা নিশ্চিত করা। এখন বাংলাদেশকেও তাঁর ন্যায্য পাওনা আদায় করতে হলে কূটনৈতিক দর কষাকষিতে অধিক দক্ষ হতে হবে। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির মনে করেন ‘ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের অভ্যন্তরীণ বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের ধারণা অপেক্ষাকৃত দুর্বল। ফলে যেকোনো সম্পর্ক গড়তে বা কূটনৈতিক দর-কষাকষিতে আমরা যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছি না।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্কে আবেগের কানাকড়ি মূল্য নেই। ভারত যেমন জাতীর স্বার্থকে মূল্য দিয়ে কাজ করছে, বাংলাদেশকেও একই কাজ করতে হবে। ভারত বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। তবে তা যেন আমাদের প্রয়োজনকেও পূরণ করে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।

এজন্য কূটনৈতিক দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি আরও অধিক কৌশলী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। ভূ-কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে ফেলনা কিছু নয়। বাংলাদেশ যদি সৃজনশীল উপায়ে কূটনীতি চালিয়ে নিতে পারে তবে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান অধিক সংহত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

লেখকঃ গবেষক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন