Ads

বাগরাম বিমানঘাটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?

এম আর রাসেল

আফগানিস্তানকে বলা হয় এশিয়ার হৃৎপিণ্ড। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশটি বারবার ভূ-রাজনীতির খেলায় স্টেডিয়াম রূপে হাজির হয়েছে।ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন এই স্টেডিয়ামে পরাজিত হয়ে নিজের সাম্রাজ্য হারিয়েছে। সর্বশেষ এখানে জটিল ও দীর্ঘ এক খেলায় মেতে উঠেছিল বিশ্ব পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র।খেলায় শক্তিমত্তা ও পারদর্শিতা দেখাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধুরা মিলে জমা হয়েছিল বাগরাম নামক গ্রামে। অনেক আগে থেকেই সেখানে একটি ঘাটি ছিল। গ্রামের নামেই সেই ঘাটির নাম হয়েছে বাগরাম ঘাটি।

ঘাটিটি ঘিরে বিশ্ব রাজনীতির অনেক ইতিহাস রচিত হয়েছে। ভূ-রাজনীতির খেলোয়াডদের মধ্যে অনেকবার ঘাটিটির হাতবদল ঘটেছে। আফগানিস্তানকে সুরক্ষা দিতে ১৯৫০ – এর দশকে আমেরিকানরা প্রথম এই ঘাটিটি তৈরি করে।১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এখান থেকেই আফগানিস্তানে খেলার আসর জমিয়ে তোলে। সোভয়েত বাহিনী চলে গেলে তাদের স্থানীয় বন্ধুরা এর দায়িত্ব পায়। এটিকে কেন্দ্র করে আফগানিস্তানের স্থানীয় জনগণরাও খেলায় মেতে উঠেছিল।সর্বশেষ ২০০১ সালে স্থানীয় খেলাকে বৈশ্বিক রূপ দিতে আফগানিস্তানে আসে যুক্তরাষ্ট্র৷ ভূ-রাজনীতির এই খেলার জয়-পরাজয় নির্ভর করে সামরিক শক্তিমত্তার উপর।

যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় বাগরাম বিমানঘাটি দখল করে তার শক্তি জমা করতে শুরু করে। এখান থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বিগত ২০ বছর ধরে তার সকল কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডন্টরা সময়ে অসময়ে এই ঘাটি পরিদর্শন করেছেন। ২০০৬ সালে জর্জ বুশ, ২০১০ ও ২০১৪ সালে বারাক ওবামা, ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাগরাম ঘাটিতে এসেছিলেন।

ঘাটিটি আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতো। বাগরাম ঘাটি কাবুল থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এর আয়তন ৩০ বর্গকিলোমিটার।যুক্তরাষ্ট্র ঘাটিটিকে চিত্তাকর্ষক মিনি শহরে পরিণত করেছে। সামরিক সরঞ্জাম ও সাজোয়া যানের বাইরে চিত্তবিনোদনের জন্য নানা স্থাপনা গড়ে তুলেছে।

বাগরামে বিমান ওঠানামার জন্য দুটি রানওয়ে আছে। সর্বশেষ ১২০০০ ফিট দৈর্ঘ্যের রানওয়েটি ২০০৬ সালে ৯৬ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৈরি করা হয়। বিমান পার্ক করার জন্য ১১০ টি জায়গা রয়েছে৷ বিস্ফোরণ প্রতিরোধী দেয়াল দিয়ে এই জায়গাগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে।

এছাড়া এখানে রয়েছে তিনটি বড় হ্যাঙার, একটি কন্ট্রোল টাওয়ার ও অসংখ্য ভবন। বন্দিদের জন্য রয়েছে কারাগার যা আফগানিস্তানের গুয়ানতানামো নামে পরিচিত।চিত্ত বিনোদনের জন্য সুইমিং পুল, সিনেমা, স্পা, ফিটনেস সেন্টার, এমনকি বার্গার কিং ও পিৎজা হাটের মতো ফাস্ট ফুডের আউলেটও আছে। চিকিৎসার জন্য ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, অস্ত্রোপচারের জন্য তিনটি অপারেটিং থিয়েটার ও আধুনিক সরঞ্জামবিশিষ্ট দাঁতের ক্লিনিক রয়েছে।

ঘাটিটিতে প্রায় ২৮০০০ ট্রুপস, ৪০০০ কন্ট্রাক্টর, ৪০০০ যানবাহন ও ভারী মেশিনারি, ৫০ টি এয়ারক্রাফট, ১২০০ তাবু রয়েছে। এখানে একটি বিমানবন্দর রয়েছে যা যুক্তরাজ্যের গ্যাটউইক বিমানবন্দরের আয়তনের সমান। বিমানবন্দরটি প্রতিদিন ৬০০ ফ্লাইট উঠানামা করতে পারে।বাগরাম ঘাটিটির কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। বাগরাম আফগানিস্তানের পারওয়ান প্রদেশের বাগরাম জেলার একটি শহর। পারওয়ান প্রদেশ ও বাগলান প্রদেশের মধ্য দিয়ে গেছে সালান পাস। সালান পাসেই তৈরি করা হয়েছে ২.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সালান গিরিপথ।

যুক্তরাষ্ট্রের আইজেনহাওয়ার মেমোরিয়াল টানেল তৈরির আগে সালান গিরিপথই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ টানেল। গিরিপথটি আফগানিস্তানের উত্তর অঞ্চলের সাথে দক্ষিণ অঞ্চলের একমাত্র পরিবহন রুট। এজন্য অনেকে গিরিপথটিকে আফগানিস্তানের জীবন প্রবাহ বলে থাকেন।

অন্যদিকে, বাগরাম বিমানঘাটি ইরান থেকে ৫০০ মাইল পূর্বে ও চীন থেকে ৫০০ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। এখান থেকে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর উপরও নজরদারি করা সহজ।বুঝতে বাকি থাকে না ক্ষুদ্র আয়তনের এই বাগরাম ভূ-রাজনীতির খেলায় কতটা প্রভাব রাখতে পারে।

লেখকঃ গবেষক ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন-

ইব্রাহিম রাইসির জয় ইরানকে কোন পথে নিবে?

আরও পড়ুন