Ads

মিশরের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ: যুক্তি ও সময়

মূল: বুরহানুদ্দিন দুরান
অনুবাদ: মাসুম খলিলী

গোয়েন্দা প্রধান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে যোগাযোগের পরে উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেদাত ইন্নালের নেতৃত্বে তুরস্কের একটি প্রতিনিধি দল কায়রো সফর করার মধ্য দিয়ে তুরস্ক ও মিশর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে নতুন এক পদক্ষেপ নিয়েছে।

এই দুই দেশের মধ্যে আলোচনা তুর্কি এবং গ্রীক প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈঠকের মতো দেখা যায় না। সেই ফ্রন্টে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাপে থাকা অ্যাথেন্স তার সর্বোচ্চতম দাবি ত্যাগ না করে আঙ্কারার সাথে আলোচনায় অংশ নেয়। গ্রীস ভবিষ্যতের উত্তেজনা নিশ্চিত ভেবে কিছু সময় নেবার চেষ্টা করেছে।
এর বিপরীতে তুরস্ক ও মিশরের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন আঞ্চলিক অবস্থার উপর দৃঢভাবে স্থির রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেনে সৌদি আরবকে ত্যাগ করে ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি পূনর্বহাল করছে, যা মধ্য প্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্যকে চ্যালেঞ্জ করে।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফের বিতর্কিত রেকর্ডিং ফাঁস এ মনে হয় তেহরানও ওয়াশিংটনের সাথে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে চায়।অডিওটিতে জারিফ কাসেম সোলাইমানির বিষয়ে অভিযোগ করেন যে তিনি রাশিয়ার সাথে এক হয়ে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি আটকাতে চেয়েছিলেন।
সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, মধ্য প্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার জন্য মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সমন্বয়কারী ব্রেট ম্যাকগার্ক পরমাণু চুক্তি পুনর্বহাল করার বিষয়ে তাদের উদ্বেগের সমাধান করতে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএআই), মিশর ও জর্ডান সফর করবেন।
এদিকে, চীন ইরানের সাথে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের “কৌশলগত” চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং সৌদি আরামকোর শেয়ার কেনার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চলমান বিরোধে রাশিয়া সব পক্ষের সাথে তার সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করছে এবং সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) ইরানের সাথে “বিশিষ্ট” সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়ে কথা বলেছেন। বহুপক্ষীয় স্তরের ক্রিয়াকলাপকে স্বাগত জানানোর কারণে এটি সম্ভব হয়েছে।
এ কারণেই আঙ্কারা এবং কায়রোর মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক একটি নতুন অধ্যায়ে উপনীত হচ্ছে। এই সম্পর্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগরের সামুদ্রিক সীমানা নির্দিষ্টকরণ এবং লিবিয়ার পরিস্থিতির সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। আঙ্কারা এবং আবুধাবিয়ের মধ্যেও একটি নতুন অধ্যায় তৈরির বিষয়ও এর মাধ্যমে বুঝা যায়।

রিয়াদ-আঙ্কারা ফ্রন্ট
সৌদি আরব তুরস্কের পণ্য বর্জন অব্যাহত রেখেছে এবং তার সীমানার মধ্যে আটটি তুর্কি স্কুল বন্ধ করার পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে এটি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া থেকে কোন পক্ষকে সরায়নি।তবে এটি স্পষ্ট, রিয়াদ তুর্কিদের আগে ইরানীদের সাথে কথা বলতে চায় – সম্ভবত তার নিরাপত্তার জন্য বড় সমস্যা হুথি বিদ্রোহীদের আক্রমণকে থামানো এবং ইয়েমেন থেকে বেরিয়ে আসার একটি সম্মানজনক পথ খুঁজতে এটি করছে।

একই সময়ে, সৌদিরা জামাল খাশোগি হত্যার বিচারের বিষয়ে রিয়াদের অনুরোধের প্রতি তুরস্কের ‘সম্মানের’ অভিব্যক্তিটি পরীক্ষা করার চেষ্টা করেছে।
সর্বোপরি, বাইডেন প্রশাসনের সমঝোতার সুরটি এমবিএসের মনকে সহজ করেছে বলে মনে হয়, তবে ক্রাউন প্রিন্স জানেন যে খাশোগির ফাইলটি তার ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত  তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হয়ে রয়েছে।তেমনিভাবে, খাশোগি হত্যার ইস্যু তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যে আস্থা পুনঃস্থাপন করার ক্ষেত্রেও একক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

‘আরব জোট’-এর সমাপ্তি

ট্রাম্প-যুগের ‘আরব জোট’ এর পতন এবং মধ্য প্রাচ্যকে নতুন রূপ দিতে ব্যর্থতা সৌদিদের তাদের অবস্থা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে। দীর্ঘকাল ধরে রিয়াদ এবং তেহরানের মধ্যে বিরাজ করা রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক দূরত্ব যে অবস্থায় রয়েছে তাতে দ্রুত পরস্পরের সম্পর্কের উন্নয়নের পথ তৈরির সম্ভাবনা নেই।

ইরানবিরোধী ব্লকের নেতৃত্বদানকারী সৌদি আরব কী করে সফলভাবে ইরানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসার পর এখন মিলমিশের পথে বড় বাধার মুখোমুখি হবে না? তেহরান শিয়া সম্প্রসারণবাদ পরিত্যাগ করেছে এই বিশ্বাস করার কি কোনও কারণ সৃষ্টি হয়েছে?
এর বিপরীতে, ইরানে মধ্যপন্থী বা কট্টরপন্থী যেই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, গত চার দশক ধরে তারা যা অর্জন করেছে তা মজবুত করার প্রতিই দৃষ্টি দেবে। এই পরিস্থিতিতে, রিয়াদ বরং আঙ্কারার সাথে তার সম্পর্কটি বেশ দ্রুতগতিতে মেরামত করতে পারে।

মুসলিম ব্রাদারহুড
কিছু পর্যবেক্ষক মিশরের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে ‘ছাড়’ হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন অথবা তুরস্কের ব্যাপারে ‘মুসলিম ব্রাদারহুডকে বিক্রি করে দেওয়ার’ অভিযোগ উত্থাপন করেন।
অন্যরা বলছেন যে, তুরস্কের ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একে পার্টি) সক্রিয়তাবাদী নীতি একটি ‘সমাপ্তির’ কাছে চলে এসেছে এবং এই দলটি স্বীকার করে নিয়েছে যে “মুসলিম ব্রাদারহুড বেল্ট” ভেঙ্গে পড়েছে।

যারা এই ধরনের মূল্যায়ন করেন তারা একটি অবস্থার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছেন, যার ফলস্বরূপ তুরস্কের ব্যাপারে সবচেয়ে খারাপতম কোণ থেকে আঞ্চলিক গতিশীলতা এবং অন্যের সুবিধা দেখছেন। এটা বলাই বাহুল্য যে কর্তৃত্ববাদী শাসনকেন্দ্রগুলি থেকে পালিয়ে আসা ভিন্নমতাবলম্বীদের ‘বিক্রয়’ করার ধারণা একেবারেই প্রশ্নাতিত।

আঙ্কারা যে ধরনের আশ্রয়প্রার্থীদের স্বাগত জানিয়েছিল, তারা কোনওভাবেই তাদের নিজ দেশে ‘শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন’ করতে পারে নি।অধিকন্তু তুরস্ক, মিশর, সৌদি আরব, ইসরাইল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ সমস্ত আঞ্চলিক শক্তি একযোগে যার যার স্বার্থে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের জন্য চেষ্টা করছে।তুরস্কের উচ্চ স্তরের কাজ, এবং প্রয়োজনে কঠিন শক্তির ব্যবহার, মেনা, উপসাগরীয়, লোহিত সাগর এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরের আলোচনার টেবিলে দুর্বল না করে দেশটিকে শক্তিশালী করেছে।

অন্যান্য সমস্ত আঞ্চলিক শক্তির সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। তুরস্ক এই অঞ্চলের প্রভাবশালী খেলোয়াড় হিসাবে তার মর্যাদা হারাতে পারত, যদি তারা নির্দিষ্ট কিছু দেশের সাথে উত্তেজনা অনুভব না করত, যাদের সাথে এখন তারা সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা করছে।
আসুন আমরা ভুলে না যাই যে ২০১৩ সাল থেকে আরব বিদ্রোহীদের চূর্ণবিচূর্ণ করার চেষ্টাকারী শক্তিগুলি তুরস্ককেও লক্ষ্য করে আসছে। সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ কেবল পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে এবং তাজা মূল্যায়নের ফলাফল হিসাবে ঘটবে।

লেখকঃ কলাম লেখক ও ডেপুটি এডিটর, দৈনিক নয়া দিগন্ত

আরও পড়ুন