Ads

শত্রু শত্রু খেলা চলতেই থাকবে

এম আর রাসেল 

মধ্য এশিয়াকে ঘিরে পরাশক্তিগুলোর ‘গ্রেট গেম’ অজানা কোনো বিষয় নয়। রাশিয়ার কাছে এই গেম পরিচিত হয়েছিল ‘Tournament of Shadows’ নামে। নানা নামে এই অঞ্চল অভিহিত হয়েছে। কেউ বলেছেন ‘Black Hole’, আবার কেউ ‘নয়া উপসাগরীয় দেশ’৷ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য অঞ্চলটির গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। পূর্বে চলমান গ্রেট গেম একেবারে হারিয়ে যায়নি। নিত্য নতুন কৌশলে এই খেলা চলছে, শুধু খেলোয়াড বদলে যাচ্ছে।

তারেক শামসুর রেহমান তাঁর একটি প্রবন্ধে বলেছেন আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সেনা সরিয়ে নিলে এই অঞ্চলে চীন হবে গুরুত্বপূর্ণ এক ফ্যাক্টর। রাশিয়া Zone of Privilege Interest তথ্যের আলোকে এই অঞ্চলকে কবজায় রাখতে চায়। তবে চীন ক্রমশ রাশিয়ার সফট বেলিকে আয়ত্তে নিচ্ছে৷ বলে রাখি এই অঞ্চলের পথ ধরেই চলে গেছে বিখ্যাত সিল্ক রুট।

এক সময় রুশ ও ব্রিটিশদের খেলার প্রধান স্টেডিয়াম হয়ে উঠেছিল মধ্য এশিয়া। কালক্রমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্তমিত হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। পিটার দ্য গ্রেটের স্বপ্ন Warm Water Policy কে বাস্তব রূপ দিতে রাশিয়া মধ্য এশিয়ার দেশগুলো একে একে নিজের বলয়ে নিতে শুরু করে। কাজাখ, কিরগিজ, তাজিক, উজবেক, তুর্কমেন সবাইকে কাবু করতে পারলেও আফগান জাতির কাছে পরাজয় বরণ করে। এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাম্রাজ্য ভেঙে চুরমার হয়ে যায়৷

প্রতাপশালী রুশ বিশ্ব দুর্বল হয়ে পড়ে। অ্যাংলো স্যাক্সন বিশ্ব প্রবল প্রতাপে বিশ্বকে নিয়ে খেলায় মেতে উঠে। বলা হয় যে, নেপোলিয়ান যুদ্ধের পর থেকেই রুশ বিশ্বের সাথে অ্যাংলো স্যাক্সন বিশ্ব বৈশ্বিক আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে লিপ্ত আছে৷ ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর তা নতুন মাত্রা পায়।

অ্যাংলো স্যাক্সন বিশ্বের নেতা হিসেবে মূল খেলোয়াড় রূপে মাঠে আসে যুক্তরাষ্ট্র। অ্যাংলো স্যাক্সন বলার কারণ হল বর্তমান যুক্তরাষ্ট্র তো বলতে গেলে ইউরোপেরই সম্প্রসারিত রূপ। এইজন্য অবশ্য অনেকে বলে থাকেন পৃথিবীতে মহাদেশ মূলত ৩ টি। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা। ওশেনিয়াতেও ইউরোপীয়রা শাসন করছে৷

যুক্তরাষ্ট্র রুশ বিশ্বকে কাবু করতে ট্রাম্প কার্ড হাতে পেয়েছিল মধ্য এশিয়ায়। এই অঞ্চলে ছায়া যুদ্ধে লিপ্ত হয়েই রুশদের প্রতাপ কমিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল। বিশ্ব ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধকে দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছিল। প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছিল মুজাহেদীন বাহিনী। অস্ত্র তৈরি থেকে শুরু করে যুদ্ধের নানা কৌশল শিখিয়ে পড়িয়ে দক্ষ করেছিল।

বিপুল পরিমাণ একে-৪৭, আরপিজি-৭, স্টিংগার মিসাইল সরবরাহ করেছিল। নতুন প্রযুক্তিতে তৈরি অস্ত্রের পরীক্ষা করেছিল এই যুদ্ধে। অস্ত্র তৈরির সূত্রও কাগজে কলমে মুজাহেদিন বাহিনীকে শিখিয়েছিল। সূত্রগুলো আরবি সহ অন্য ভাষায় অনুবাদও করা হয়েছিল। সময়ের পরিক্রমায় যুক্তরাষ্ট্রের হাতে গড়া যোদ্ধারা তালেবান, আল কায়দা, বোকো হারাম, আল শাবাব সহ নানা সশস্ত্র সংগঠন তৈরি করে। আর একসময়ের প্রশিক্ষিত যোদ্ধারাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শত্রুতে পরিণত হয়।

মধ্য এশিয়ার এই ভূ-খণ্ড ঘিরেই রচিত হয় বিশ্ব পরিচালনার নতুন সূত্র। সন্ত্রাস নামক শব্দটিকে বিশেষ এক ধর্মের পাশে এঁটে দেয়া হল। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরুর মধ্য দিয়ে পুরো বিশ্বে নতুন মেরুকরণ ঘটল। ‘Either you are with us or you are with the terrorist’ সুর বিশ্ব ব্যবস্থায় নতুন যুগ শুরু করল।

আফগানিস্তানের ভূ-খণ্ডে শুরু হল এক সীমাহীন সমর। এর পাশাপাশি কখনও Responsibility to protect, কখনও মানবিক হস্তক্ষেপের নাম করে মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির বারুদ উসকে দেয়া হল। এক সময়ের CENTO, SEATO জোটের মিত্র দেশগুলোকে বিশাল বড় উপঢৌকন দেয়া হল বোমা ও বারুদ দিয়ে।

উপহারে রুষ্ট হয়ে একশ্রেণী অস্ত্র হাতে তুলে নিল,জন্ম নিল আইসিস নামীয় দল। এই দলের উত্থান কথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ নতুন মাত্রা যোগ করলো৷ দলটিকে ধ্বংস করতে দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলল। অবাক করা বিষয় হলো আধুনিক সব অস্ত্র ব্যবহার করেও আইসিসকে পুরোপুরি ধ্বংস করা গেল না।

মারতে না পারলেও তাদের তাড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে৷ শোনা যাচ্ছে নতুন খেলার মাঠ হবে আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল। সাথে পুরানো মাঠেও মাঝে মাঝে রিহার্সাল হতে পারে। ২০০৭ সালে বুশ প্রশাসন তৈরি করেছিল আফ্রিকম। এর পুরো রূপ হল United States Africa Command. উদ্দেশ্য হল ১০০০ ভাষাভাষী ৮০০ নৃ-গোষ্টীর ৫৩ টি দেশের সুবিশাল প্রাকৃতিক সম্পদের উপর আধিপত্য কায়েম করা।

২০০৭ সালে গঠন করা হলেও এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৮ সালে। ইউরোপের সামরিক কমাণ্ডকে এর সাথে একীভূত করা হয়েছে। সদর দপ্তর স্থাপিত হয় জার্মানিতে। শোনা যাচ্ছে চাদ এর প্রেসিডেন্ট ইদ্রিস ডেবীর মৃত্যুর পর নাইজেরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের এই কমাণ্ডের সদর দপ্তর আফ্রিকায় স্থানান্তরের কথা বলেছে।

এর আগে এই কমান্ডকে নব্য ঔপনিবেশিক শক্তি নামে অভিহিত করা হয়েছিল। তবে কি ইদ্রিস ডেবীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকায় দীর্ঘস্থায়ী ঘাটি গড়ার ছাড়পত্র পেতে চলেছে? উল্লেখ্য, ইদ্রিস ডেবী যে বিদ্রোহীদের গোলায় আহত হয়েছিলেন তারা দীর্ঘদিন লিবিয়ায় হাফতারের পক্ষে কাজ করছিল।

পুরানো মাঠকে যুক্তরাষ্ট্র একেবারেই পরিত্যাগ করছে না৷ পুরানো কৌশল ছায়া যুদ্ধের মাধ্যমে এই মাঠে উপস্থিতি জানান দিবে। আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে নিলেও পাশের দেশগুলোতে ঘাটি গড়ার খবর সেই তথ্যই দিচ্ছে। নতুন মিত্র ভারত যুক্তরাষ্ট্রের এই খেলায় হতে পারে প্রধান সাথী। এর আগে এই তালিকায় ছিল পাকিস্তান।

পামির নটের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা এই মাঠে শত্রু শত্রু খেলার মজাই আলাদা। কারণ নির্মেলেন্দু গুণ বলেছেন, ‘যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা।’ শত্রু শত্রু খেলায় শেষ বলে কিছু নেই। পামির, সাহেল, মারাবি অঞ্চলে নতুন করে এই খেলা জমে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷

আরও পড়ুন