Ads

শরণার্থীদের নিয়ে জুয়া খেলা বন্ধ করুন

হাসিবুর রহমান

বিপজ্জনক এক জুয়ায় মেতে ওঠেছেন বেলারুশ প্রেসিডেন্ট। ইউরোপে নিরাপদ ভবিষ্যত ও উন্নত জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাদের তিনি মাতৃভূমি থেকে উড়িয়ে এনেছেন, তাদের ঠেলে দিচ্ছেন অনিশ্চিত গন্তব্য ও ভয়াবহ বন্দিত্ত্বের দিকে। অভ্যন্তরীণ ক্ষত সারাতে ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর, ভীত-সন্ত্রস্ত শরণার্থীদের মোক্ষম দাওয়াই হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছেন তিনি। পোল্যান্ড-বেলারুশ সীমান্তে ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে যে মানবিক সংকট, তার দিকে তিনি ভ্রুক্ষেপ করছেন না একেবারেই।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের প্রতিক্রিয়া ইউরোপের পূর্ব সীমান্তে পরিলক্ষিত হবে- এমনটা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন আগেই। সেই সূত্র কষেই ইউরোপের দুয়ারের দেশগুলো নিচ্ছিলো শরণার্থীদের ঢেউ মোকাবিলার প্রস্তুতি। কিন্তু মাঝপথে তাদের সেই প্রচেষ্টায় জল ঢেলে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট লুকাশেংকো।

বিশ্বাসঘাতকের মতো পোল্যান্ড, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়ার পিঠে ছুড়ি বসিয়ে তিনি উন্মুক্ত করে দিয়েছেন বেলারুশের ভূমি। ইউরোপের ভাষ্য, তার কারণেই শরণার্থীরা বিষের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ইইউভুক্ত দেশগুলোতে। বিষাক্ত করে তুলছে দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব, হুমকির মুখে ফেলছে তাদের নিরাপত্তা।

ইইউ, পোল্যান্ড বা বেলারুশ–সব পক্ষই ভবিষ্যতের কথা ভেবে পরস্পরে কাদা ছোড়াছুড়ি করছে। কেউই বর্তমান পরিস্থিতির দিকে খেয়াল করতে আগ্রহী নয়। আগ্রহী নয়, সীমান্তে পড়ে থাকা শবসম মানুষগুলোর ভালমন্দের দিকে। যুযুধান পক্ষগুলো কেবল নিজেদের মনমতো শরণার্থীদের ঘুটি হিসেবে চালতেই আগ্রহী।

সংবাদমাধ্যমগুলো আমাদের জানাচ্ছে, এই মুহুর্তে পোল্যান্ড-বেলারুশ সীমান্তের অবস্থা খুবই নাজুক। হাজার হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষ, যাদের মাঝে যথেষ্ট পরিমাণ নারী-শিশুও বিদ্যমান, তারা অবস্থান করছেন খোলা আকাশের নীচে। লোকালয় থেকে দূরে, বেলারুশের বনে, খাদ্য-পানীয়র অভাবে তাদের ক্ষুধা নিবারণ করতে হচ্ছে বেলারুশ থেকে নিয়ে আসা পঁচা বিস্কুট ও নদীর নোংরা পানি খেয়ে। পাশাপাশি পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় ইতোমধ্যেই জটিল রোগে ভুগতে শুরু করেছে অনেক মানুষ।

এসবের সাথে যোগ হয়েছে সীমান্ত এলাকায় জরুরী অবস্থার ঘোষণা। সংশ্লিষ্ট দেশগুলো উপদ্রব এলাকায় চিকিৎসক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, এনজিও প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মী– কাউকেই যেতে দিচ্ছে না। ফলে শরণার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন জরুরী ত্রান ও চিকিৎসা সহায়তা থেকে।

উল্টো সংকট আরো গভীর করে তুলতে পোল্যান্ড, লাটভিয়া সেখানে সেনাসদস্যদের উপস্থিতি আরো বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। ভীতসন্ত্রস্ত, অসহায় এই মানুষগুলোকে নিষ্কৃয় করে রাখতে সশস্ত্র সেনাদের সমাবেশ ঘটানো- স্পষ্টতই সংকট সমাধানে নেতাদের স্বদিচ্ছার স্বল্পতার দিকেই ইঙ্গিত করে।

শরণার্থীদের দুর্দশার দাস্তান এতটুকুতেই শেষ নয়। আমরা খবর পাচ্ছি, এই সময়ে কুজনিচায়, যেখানে শরণার্থীদের সিংহভাগ অবস্থান করছেন, সেখানকার তাপমাত্রা হিমাঙ্কের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। ইউরোপের প্রবল শীতের ছোবলে এরই মধ্যে হতভাগ্য কয়েকজন শরণার্থীর নীল হওয়ার সংবাদও আমরা পেয়েছি।

এতদসত্ত্বেও বিবাদমান পক্ষগুলো নির্বিকার। শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশার দিকে কোনরুপ ভ্রক্ষেপ না করে উল্টো তারা আগ্রাসী হয়ে ওঠছে। কনকনে শীতে কাঁপতে থাকা মানুষগুলোর ওপরই তারা জলকামান নিক্ষেপ করে যাচ্ছে। জেনেভা কনভেনশনকে বৃদ্ধাঙুলী দেখিয়ে শরণার্থীদের একে অপরের দিকে “নিক্ষেপ” করছে।

পোল্যান্ডের দাবি, এবছরের শুরু থেকে সীমান্তে শরণার্থীদের যে ঢলের মোকাবিলা তারা করছে, তার হার আগের বছরগুলোর চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। আর এসবই ঘটছে বেলারুশের কারণে। ২০২০ সালে বেলারুশের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচন ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর ব্যাপক দমনাভিযানের প্রেক্ষিতে ইইউর আরোপিত অবরোধের শোধ তুলতেই বেলারুশ এমন হঠকারী পদক্ষেপ গ্রহন করছে বলে দাবি করছে ওয়ারশ।

পরিসংখ্যান ঘাটলে পোল্যান্ডের এই দাবির সত্যতাও মিলে অবশ্য। কুজনিচায় আটকে পড়া শরণার্থীদের অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যের– সিরিয়া, ইরাকের। তাদের সাথে যোগ হয়েছে তালে-বান ভয়ে ভীত বড় এক সংখ্যার আফগানরাও। নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল জানাচ্ছে, গত আগস্টের পর থেকে দেশ ছেড়ে ইরানমুখী হয়েছে প্রায় ৩ লক্ষ্য আফ গান। যাদের সিংহভাগেরই লক্ষ্য ইরান পেরিয়ে ইরবিল হয়ে বেলারুশ পৌঁছানো। নতুন এসব শরণার্থীদের কাছে তুরস্ক বা উত্তর আফ্রিকা হয়ে সাগর পেরিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেয়ে বেলারুশ-রুট বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে।

যারফলে প্রথমবারের মতো শরণার্থী-চাপে পড়ছে পোল্যান্ড।

বেলারুশের প্রতিবেশী দেশগুলোর অভ্যন্তরে জনগনের মনোভাব শরণার্থীদের প্রতি ইতিবাচক নয়। জনগণ তাদের জাতিসত্বার সুরক্ষার ব্যাপারে ভীত। ফলে দেশগুলোর শাসকগোষ্ঠী জাতীয়তাবাদী এই নয়া উদ্বেগ নিরসনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে। জাতির এহেন ক্রান্তিলগ্নে নায়ক হয়ে ওঠতে চাইছে। হারানো জনসমর্থন পুনরুদ্ধারের সুবর্ণ সুযোগ বলে একে মনে করছে। ফলে মাতেউস মোরাউইকি, আলিগারস কালভিতিসদের মতো রক্ষণশীল নেতা বা সদ্য অবসরফেরত ডোনাল্ড টাস্কের উদার নেতারাও লুকাশেংকো-জুয়ার চর্চা শুরু করেছেন।

নেতাদের এই পৈশাচিক জুয়ায় মেতে ওঠার ফলে ভুগতে হচ্ছে নিঃস্ব, ক্ষুধার্ত, ভীতসন্ত্রস্ত শরণার্থীদের। জীবন বাজি রেখে যারা মাতৃভূমি ত্যাগ করেছিলেন নিরাপদ ভবিষ্যতের প্রত্যাশায়, তাদেরই বিশ্বনেতারা বাজি রাখছেন স্বার্থসিদ্ধির জুয়ায়। এরচেয়ে নির্মম আর কিছু হতে পারে কি!

লেখক- শিক্ষার্থী

আরও পড়ুন