Ads

সমাজ বদলায় সময়োচিত প্রাজ্ঞ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপে, আবেগে নয়

জিয়াউল হক

কাদেসিয়া যুদ্ধ পরবর্তি পরিস্থিতি দ্রত বদলায় ইসলামের অনুকুলে। হাজার বসরের সমৃদ্ধ পারস্য সভ্যতা ইসলামের অনুকুলে অনেক অবদান রাখে। শিক্ষা, প্রশাসন সামরিক ও প্রযুক্তির উন্নয়নে, বেসামরিক ব্যবস্থাপনায় বিপ্লব ঘটে। ইসলামি ফিক্বহ ও হাদিস শাস্ত্রেও তারা অনন্য ভুমিকা পালন করেন। ইমাম বুখারি, মুসলিম ইবনে মাজাহ, তিরমিজী, ইমাম নাসাঈ সকলেই পারস্যের। জ্ঞানচর্চায় পারস্যের প্রাচিন ঐতিহ্য প্রতিফলিত হয়েছে ইসলামেও।

তবে সেই ধারায় ছেদ টানেন পারস্যের শাহ আব্বাস ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে (১৫৮৮), ক্ষমতাসীন হয়েই প্রথমবারের মতো ইরানকে শিয়া রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলেন। শাহ আব্বাসের হাতকে শক্তিশালী করতে ইংল্যান্ড হতে উড়ে আসেন (১৫৯৮) দুই ইংরেজ সহোদর, Sir Anthony Sherley এবং Sir Robert Sherley পর্যটকের ছদ্মবেশে।

এদেরই সহায়তায় শাহ আব্বাস ইউরোপ থেকে অস্ত্র সরঞ্জাম জোগাড় করলেন এবং দু’ভাইয়ের ছোটজন; Sir Robert Sherley‘কেই দায়িত্ব দিলেন ইরানি সেনাবাহিনীকে ঢেলে সাঁজানোর! পাঁচ বছরেই ফল ফলতে শুরু করলো। ১৬০২, ১৬১২ খৃষ্টাব্দে একবার করে এবং ১৬১৬ -১৬২৭ সময়কালে বেশ কয়েকবার ওসমানীয় খেলাফতের সাথে পারস্যের যুদ্ধ! পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের এই শিয়া শক্তিই পরবর্তি প্রায় দেড়শত বসর ওসমানীয় খেলাফতকে পেছন থেকে টেনে ধরে রাখে। খুবই চিত্তাকর্ষকই বটে! ইউরোপ যখন ওসমানিয় খেলাফতের থাবায় কম্পমান ঠিক তখনই ইংল্যান্ডের গোয়েন্দারা পারস্যে হাজির! অর্থাৎ, ব্রিটেন বিশ্বপরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল নীরবে।

মক্কায় ওয়াহাবীরা ১৭৯০ খৃষ্টাব্দে ওসমানীয় খেলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর নামে হাজীদের উপরে বর্বর নির্যাতন, হাজীদের ধনসম্পদ লুট, এমনকি, হারামের মধ্যেও হত্যাকান্ড সংঘটনের কারণে মক্কার কাজী তাদের কাফের হিসেবে ঘোষণা করেন। একইসাথে মক্কার শরিফ গালিব বিন মাসাদ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এ সময় ফ্রান্স মিশর দখল করলে মক্কাবাসী ফ্রান্সের, তথা, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোন ইউরোপীয় শক্তির আগ্রাসনের আশংকা করায় ওসমানীয় খলিফা শরিফ গালিবকে মক্কার জনগণকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেবার নির্দেশ দেন।

আশ্চর্যজনক বিষয়, এসময় হঠাৎ করেই গালিবের কাছে একজন Swiss পর্যটক John Lewis Burckhardt এলেন। বস্তুত তিনি ছিলেন British African Association এর কর্মচারীর ছদ্মবেশে ইংরেজ সরকারের প্রশিক্ষিত গুপ্তচর। কোম্পানীর হেড অফিস ছিল লন্ডনে। তাকে প্রতিমাসে রিপোর্ট করতে হতো লন্ডনে। মক্কায় আসার আগে তাকে লিবিয়া ও মিশরে ক’বছর রেখে নিখুঁত আরবি, ইসলামি ইতিহাস, সাহিত্য এবং শরিয়া শেখানো হয়। অর্থাৎ বিশ্বপরিস্থিতির মতো মক্কার পরিস্থিতিতেও ইংল্যান্ড নজর রেখে এজেন্ট তৈরি করছিল !

ইংল্যান্ডের বন্ধুরাষ্ট্র ফ্রান্স ১৮৪০ সাল থেকেই সিরিয়া-ফিলিস্তিনে তাদের মিশনারী স্কুলগুলোর প্রায় লক্ষাধিক শিক্ষার্থীকে আরব জাতীয়তাবাদ শেখায়। আরব মনোজগত ও সাংস্কৃতিতে উজ্জীবিত এরাই জীবনভর ওসমানীয় খেলাফতের বিরুদ্ধে কর্মতৎপর থেকে জমিন প্রস্তুত করলে একশ বছর পরে ইংল্যান্ডের গুপ্তচর; লরেন্স’কে (T. E Lawrence) হেজাজে শরিফ হুসেইন ও তার প্রতিদ্বন্দী সউদের কাছে বন্ধু (!) হিসেবে পাঠায়। ভাষা, সাহিত্য ও কালচারে আরবদের চেয়েও বড়ো আরব সেজে হেজাজবাসীকে আরব জাতিয়তাবাদে উস্কে, যুদ্ধে প্রশিক্ষিত করে আরবদের দিয়েই খেলাফতের কবর খুঁড়েছিল। ইতিহাস তাকে ‘গ্রেভ ডিগার অব অটোম্যানস’; খেলাফতের গোরখোড়ক বলেই জানে।

শরীফ হুসেন এবং ইবনে সউদ পরস্পর শত্রু ও ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দী হলেও ব্রিটেন উভয়ের সাথেই বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলেছে লরেন্সের মাধ্যমেই। তারই মাধ্যমে কায়রোর ব্রিটিশ দূত ম্যাকমোহনের সহায়তায় হুসেইনকে মাসিক সোয়া লক্ষ পাউন্ড চাঁদা ও প্রয়োজনীয় অস্ত্র জুগিয়েছে। যা দিয়ে হুসেইন ওসমানীয় খেলাফতের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধে নামে।

আবার হুসেইনকে ঠেকানোর জন্য তারই প্রতিদ্বন্দী ওহাবি গোষ্ঠী ইবনে সউদকেও সময়মত অস্ত্র রসদ, অর্থ সাহায্য ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে হুসেইনকে কোণঠাসা করেছে। প্রতারিত হুসেইন সবংশে পালিয়ে বাঁচেন জর্ডানে, তারাই আজও সেখানে শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। ইবনে সউদের অধস্তন বংশও আজ সেই একই চেতনায় সউদির তখতে!

শরিফ হুসেইন কিংবা ইবনে সউদ ও সতীর্থরা কেউই ইসলামের বিধান পালনে কমতি করেননি। তবে মনে লালন করেছেন নিখাঁদ আরব জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদের এ ছোবল থেকে আজও তারা বেরুতে পারেননি।

এরই ছোবলে একদিন খেলাফত ভেঙ্গে হেজাজে নিজ গোত্রের ক্ষমতা পেতে শরিফ হুসেইন এবং তার প্রতিপক্ষ ইবনে সউদ গং যে ফিলিস্তিনকে স্বেচ্ছায় ইহুদিদের ছেড়েছেন তা পূনরুদ্ধারে আজ উম্মাহকে তারা ডাকতে পারবেন না নৈতিক কারণেই। স্বেচ্ছায় ইহুদিদের ফিলিস্তিন দিয়ে যে স্বার্থ হাসিল করেছেন, তা আঁকড়ে রেখে ইহুদিদের কাছ থেকে সেই ফিলিস্তিন ফেরত চাইতেও পারবেন না। ফলে বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্ধারে উম্মাহর নেতৃত্ব দিতে আরবরা অপারগ। এর আগেও ক্রুসেডারদের হাত থেকে ফিলিস্তিন উদ্ধারে তারা ব্যার্থ হয়েছেন, সফল হয়েছিল কুর্দী সালাহউদ্দীন।

প্রশ্ন জাগে, দেড়শত কোটি সদস্যের এই উম্মাহ কার নেতৃত্বে বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্ধারে নামবে? কঠিন এ প্রশ্নটা ধীর মস্তিস্কে ভাবলেই দেখবেন, এক্ষেত্রে ন্যাটোর সদস্য তুরস্কের নেতৃত্বে মিশর, ইরান, মালয়েশিয়া আর আনবিক শক্তিধর পাকিস্থান’সহ প্রতিটি মুসলিম দেশের ঐক্যবদ্ধ কর্মপদ্ধতিই একমাত্র পথ।

পথটা তখনই কার্যকর হবে যখন উম্মাহর সদস্য হিসেবে আপনি নিজের চোখ-কান খোলা রেখে বিশ্বপরিস্থিতি যাচাই করে যথাসময়ে, যথাযথ স্বিদ্ধান্ত নিতে বা নেয়াতে পারবেন। তা না হলে কেবলমাত্র রাস্তায় রাস্তায় শ্লোগাণ হেঁকে বেড়াতে হবে, কিংবা ফেসবুকের পাতায় হ্যাশট্যাগ।

একটা সোজা ও সহজ কথা বলি, এতো সহজে কখনও দুনিয়া বদলায় না। দুনিয়া বদলায় সময়োচিত প্রাজ্ঞ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপে। উম্মাহ’র দেড়শত কোটি সদস্য, বিশেষ করে, রাজনীতিবীদ ও যুবপ্রজন্ম কি তা অনুধাবন করবেন? করলে সেটা কবে?

লেখকের প্রকাশিত আগের  লেখা- ইংল্যান্ড ও ইসলামঃ এক অনুসন্ধানী পথযাত্রা-৬

লেখকঃ ইংল‍্যান্ডের বেসরকারী মানসিক হাসপাতালের সাবেক সহকারী পরিচালক ও লেখক, ইংল‍্যান্ড

আরও পড়ুন