Ads

সাম্প্রতিক বাংলাদেশঃ হেফাজতে ইসলাম ও করোনা ভাইরাস

আসাদ পারভেজ

রাষ্ট্র মানে একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার ভূমি- যেখানে জনসমষ্টি থাকবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার থাকবে। অতঃপরনাগরিক ও সরকার পরস্পরের প্রতি আনুগত্য ও অধিকার সুনিশ্চিত করবে।রাষ্ট্র পরিচালনা বডির প্রতি আনুগত্য পোষণ করা নাগরিকের দায়িত্ব। সেটি গণতান্ত্রিক, রাজতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক, একনায়ক কিংবা সমাজতান্ত্রিক হোক, তাতে কোনো প্রশ্ন আসে যায় না। দেশে দেশে সরকারগুলো যেকোনোভাবে আনুগত্য আদায় করে নিচ্ছে। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে নাগরিকরা কি অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে কিংবা সরকার জনগণের অধিকার পূরণে তৎপর কি-না।সত্যি বলতে, বিশ্বের নানা দেশে জনগণের প্রতি সরকারের অবহেলা আকাশচুম্বি।

আমাদের দেশে আইনের শাসন বেশ নিম্নমুখী। অথচ সরকারের সাথে জনগণের সম্পর্ক স্বার্থের বৃত্তে সুনিবিড় হওয়ার কথা। সুশাসন বলতে গেলে একেবারেই নেই। যার অভাবে আমাদের দুর্নীতিগ্রস্ত এমন পরিণতি।

লাগামহীন অনিয়ম আর দুর্নীতি রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে ঝেঁকে বসেছে। জনগণের চিন্তা-চেতনার মাঝে অপরাধপ্রবণতা চরমভাবে কাজ করছে। নারী নিগৃহ ও সহিংসতা, ডিজিটাল আইনে মতপ্রকাশের অধিকার সঙ্কুচিত, চিকিৎসা ক্ষেত্রে অবহেলা, স্বাস্থ্য খাতে সমন্বয়হীনতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভঙ্গুর অবস্থা, অর্থনীতির বেহাল দশা, নৈতিক চরিত্রের চরম বিপর্যয় যেমন বেড়েছে, তেমনি ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা রাষ্ট্রকে করে তুলছে অনিরাপদ।

দেশ ও দেশের বাইরে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার অবতারণা করতে গিয়ে প্রথমে বলতে হয়- ইসলামোফোবিয়ার নামে ঘৃণ্য অপকর্মের কারণেই বেশকিছু ঘটনার জন্ম হচ্ছে। ইসলামোফোবিয়া হচ্ছে এমন একটি রাজনৈতিক শব্দ- যা দ্বারা ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণ করাকে বুঝানো হয়। এক কথায় Anti-Muslim Sentiment তৈরি করা। নিন্দার্থে ব্যবহৃত এমন কাজগুলো বন্ধ করা না গেলে বিশৃঙ্খলা নিসন্দেহে বাড়বে- বিশ্বব্যাপি।
ফ্রান্সের মতো দেশগুলো বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত নবি মুহাম্মাদ সা.-কে নিয়ে নিয়মিত অপমানজনক ব্যাঙ্গার্থ করে যাচ্ছে। দেশটির সরকারপ্রধান যখন এমন কাজে জড়িয়ে পড়েন, তখন বলতেই হয় ফ্রান্স রাষ্ট্রটিই ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দিতে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। ইউরোপকে সাথে নিয়ে মার্কিন সরকার প্রতিনিয়ত মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে অহেতুক আগ্রাসী আক্রমণ চালাচ্ছে। যাতে করে মুসলমানদের রক্তে বিশ্বমাটি রঞ্জিত হচ্ছে। লাখো মুসলিম নর-নারী বাস্তুচ্যুত হচ্ছে।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত যাকে বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ বলা হয়। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে তাদের আগ্রাসী আচরণ সাম্রাজ্যবাদকে ছাড়িয়ে চরম ধর্মীয় উন্মাদনায় মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করছে। ১৫২৭ সালে নির্মিত ঐতিহাসিক ‘বাবরি মসজিদ’ ১৯৯২ সালে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর সেবকরা বর্বরদের মতো আক্রমণ চালিয়ে ধ্বংস করে। অতঃপর তারা ক্ষান্ত হয়নি। মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির বানাচ্ছে।অবশ্য তা আদালতের তথাকথিত রায়ের মধ্য দিয়ে। আদালত স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করে নিয়েছিল যে, বিতর্কিত জমিতে মসজিদ ছিল। যেখানে শত শত বছর ধরে নামাজ পড়া হচ্ছে, সেই স্থানকে মসজিদ হিসেবে মান্যতা দেওয়া উচিত। তাহলে একই আদালত মসজিদের জায়গায় মন্দির বানানোর নির্দেশ দিলো কোন যুক্তিতে?
বিশ্বাস বা আস্থার মর্যাদা রাখতে বিতর্কিত জমিতে রামলালা বিরাজমানের নামে দেওয়া হল। এটা কি আদৌ যুক্তিযুক্ত? রামচন্দ্র আদৌ ছিলেন কি না, কোথায় জন্মেছিলেন, সে সবের কোনও প্রামাণ্য দলিল কি রয়েছে? নেই। রাম শুধু কাব্যে রয়েছেন। (আনন্দবাজার পত্রিকায় ভারতের সাবেক বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য- ২০১৯)। আদালতের কাজ ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করা নয়। অকাট্য প্রমাণ এবং প্রামান্য দলিলপত্রের ভিত্তিতে আদালতকে সিদ্ধান্তে যেতে হয়- যা ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট করেনি।

ভারতীয় সরকার নতুন করে মথুরা ও কাশীতে মসজিদ ভাঙ্গার প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে। তদুপরি ভারতীয় মুসলমানদের নানা রকম অস্থিরতার (সিআইএ এবং এনআরসি) মধ্যে রেখেছে। এসবের কারণেই সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে জনাব মোদির আগমনের বিরোধিতা হেফাজতে ইসলাম করেছে।তারা শুধু একজন মানুষের বিরোধিতা করেছে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে সরকার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালনের বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছিল। সে উপলক্ষে নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা এবং ভারতের সরকারপ্রধানদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি প্রচারের সাথে সাথে তৌহিদী জনতার বিশাল একটা অংশ বিরোধিতা শুরু করে। এ বিরোধিতার মূল ও একমাত্র অংশ জনাব নরেন্দ্র মোদি। কেননা তিনি যে উগ্রবাদ পোষণকারী একজন ব্যক্তি তা বিশ্ব আগে থেকেই জানে। গুজরাটের মূখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি মার্কিন মুল্লকে ছিলেন নিষিদ্ধ। কিন্তু কেনো। অবশ্যই উগ্রবাদের কারণে। তাকে কেন্দ্র করে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের কারণ ঐ একটাই। সত্যি বলতে ২৬ মার্চ, ২০২১ সালে দেশের এমন একটি মহা আনন্দের দিনে তার মতো উগ্রবাদী মানুষকে অতিথি করার একান্ত প্রয়োজন কি ছিলো- স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।

ভারত রাষ্ট্রের প্রতি স্বাধীন বাংলাদেশ কৃতজ্ঞতা দেখাতে যেহেতু চেয়েছে, তখন তো ভারতের রাষ্ট্রপতিকে দাওয়াত দিলেও চলত। সরকার প্রধানের প্রতি পূর্ণ সম্মান জানিয়ে বলছি- আপনার আশে-পাশের মানুষগুলো আরেকটু বুদ্ধি খাটালে এবং সর্তক হলে হয়তো-বা আরো ভালো কিছু হতো। দেশের এমন পরিস্থিতি আজ আমাদের দেখতে হতো না। সতেরটি তাজা প্রাণের প্রদীপ দুই-তিন দিনে নিভে যেতো না।

পথে-ঘাটে হেফাজতের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে শোনা যায়, মোদির আগমণের বিরোধিতা হেফাজতে ইসলাম করবে কেনো। প্রশ্ন হলো- হেফাজত কি রাজনৈতিক দল। অনেকে বলেন- হেফাজত বিএনপি ও জামাতের ভিকটিম হিসেবে কাজ করছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের ক্লিয়ার হতে হবে- হেফাজত কি স্বাধীনতা ও সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের বিরোধিতা করেছে, ভারত নামক রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছে, নাকি ধর্মবিদ্বেষী মোদির বিরোধিতা করেছে।

সকলের জ্ঞাতার্থে বলতে হচ্ছে যে- হেফাজতে ইসলাম এমন একটি সময়ের ক্লান্তি লগ্নে গঠিত হয়েছিল, যখন অহেতুক ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়েছিল তথাকথিত মিডিয়া। ইসলামোফোবিয়ার নামে ধর্মের বিরুদ্ধে যারা কাজ করবে, তাদের প্রতিরোধ ও সংশোধন করার প্রয়াসে দলটি গঠিত হয়েছিল। হেফাজতে ইসলাম কোনো দলের অবশ্যই ভিকটিম হতে পারে না। যারা বলছে তাদেরও রয়েছে অসৎ উদ্দেশ্যে।

আন্দোলনের কেন্দ্র বায়তুল মোকাররম।কিন্তু কেনো? শাহবাগ যেমনটা নাস্তিকদের দখলে, তেমনি মুসল্লিদের দখলে বায়তুল মোকাররম চত্বর কি? শাহবাগে নাস্তিকদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে পুলিশ। অপরদিকে কেনো জানি মসজিদ চত্বরের মসল্লিদের আক্রমণ করে কিছু কিছু সময় কতিপয় পুলিশ সদস্য। কারণটা জানা একান্ত জরুরি।

২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররমে যতমানুষ জুমার নামাজ পড়েছিলো সবাই কি হেফাজতের লোক? সবাই কি সরকার বিরোধী ছিলো? জাতীয় মসজিদের একাধিক পেশ ইমাম আমাকে স্নেহ করেন। তাই তো মসজিদটিতে প্রায়ই নামাজ পড়তে যাই। সেই দিন নামাজ পড়তে আমিও গিয়েছিলাম বায়তুল মোকাররমে। রবের অশেষ মেহেরবানিতে বেঁচে গেলাম। দলীয় কর্মীদের হিংস্র আচরণ থেকে জনৈক জনাব মোঃ নুর নবি (পিএ টু সিনিয়র পোস্ট মাষ্টার) এবং জনাব আনোয়ার হোসেন (পরিদর্শক, ঢাকা জিপিও) নিরাপদে আশ্রয় দেন আমাকে। সার্বিক সহায়তা করেছিলেন কর্তব্যরত র‌্যাব। ধন্যবাদ তাদেরকে।

ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে গবেষণায় দেখা যায়, জনাব মোদির আগমণকে কেন্দ্র করে ২৫ মার্চ বৃহস্পতিবারও পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল। মতিঝিল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মোদি বিরোধি মিছিলে হামলা হয়েছে।

সন্ধ্যায় শাহবাগ এলাকায় মশাল মিছিলেও হামলা হয়েছে। মোদি বিরোধী এসব মিছিলের আয়োজন ইসলামিক দলগুলো ছাড়াও বামপন্থিদের বড়ো একটা অংশও করেছিল। ছাত্র অধিকার আন্দোলন কড়া ভাষায় মোদির আগমনের বিরোধিতা করেছে।

২৬ মার্চ শুক্রবার অতিথি মোদি আশার দিনে দেশের কোথাও হেফাজতে ইসলামের কোনো কর্মসূচি মূলত ছিল না। তারপরও বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে নিরাপত্তা বেষ্টনীতে রাখা হয়েছিল বায়তুল মোকাররমকে। নামাজ শেষে কিছু অতিউৎসাহি মুসল্লি জুতা-স্যান্ডেল দেখিয়ে মিছিল শুরু করলে, অন্য মুসল্লিরা বাধা দেন। বাধা দেওয়া মুসল্লিদের একটা অংশ চলে যেতে সক্ষম হলেও কিছু অংশ আটকা পড়েন। অতঃপর আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মসজিদের বাইরে থেকে পালটা বিক্ষোভে অংশ নেয়। শুরু হয় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ। উভয় পক্ষকে আহ্বান জানিয়েও পুলিশ ব্যস্থ হয়। প্রশ্ন থেকে যায়, হঠাৎ করে মসজিদের বাইরে এতো লীগ কর্মী আসল কখন। তারা কি আগে থেকেই ওখানে অবস্থান নিয়েছিল।

‘তারপরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার তাগিদে ১ হাজার ১৩৭টি গুলি (৮২৭টি রাবার ও ৩১০টি সিসা) ছুড়েছে পুলিশ। এ সময় ৯৩টি কাঁদানে গ্যাসের শেলও নিক্ষেপ করা হয়। যদিও উভয় পক্ষকে নিবৃত করা পুলিশের কাজ, তথাপি পুলিশ সবকিছু ছুড়েছে মসজিদের ভেতরে থাকা মুসল্লিদের ওপর। অবশ্য বাইরের ছবি তুলতে গেলে লীগের ছেলেরা সাংবাদিকদের ওপর হামলা করে। কারও কারও ক্যামেরা ও মুঠোফোন কেড়ে নেওয়া হয়।’ মার্চ ২৮, ২০২১, প্রথম আলো।

মুহূর্তের মধ্যে বায়তুল মোকারমের উদ্ভট পরিস্থিতির কথা মিডিয়া ও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর হাটহাজারী, বাহ্মণবাড়ীয়া ও মুন্সিগঞ্জসহ দেশের নানা জায়গায় বিক্ষোভে মাদ্রাসা ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসে। পরিস্থিতি নাজুক হতে থাকে। ৪৮ ঘন্টার মধ্যে জীবন প্রদীপ নিভে গেল ১৭টি তাজাপ্রাণের। কে নিবে এর দায় ভার? এরা তো স্বাধীন দেশেই জন্ম নিয়েছিল। এরা এদেশেরই নাগরিক।

জনাব মোদির আগমন এবং বিক্ষোভে মানুষের লাশ পড়া যেমন সরকারের জন্য বিব্রতকর, তেমনি বিশ্বদরবারে মোদিও হয়েছেন প্রশ্নাতীত। তাই আমরা ধারণা করেছি যে, হেফাজতের ওপর সরকারের একটা খড়গ নেমে আসতে পারে। তবে বিষয়টি জনাব মামুনুল হক যে এভাবে সহজ করে দিবেন, তা আমাদের কিঞ্চিৎ পরিমাণ ধারণা ছিল না।

৩ এপ্রিল মাওলানা মামুনুল হক তার স্ত্রীকে নিয়ে সোনারগাঁ রিসোর্টে যাওয়ার পরে অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্ম হয়। থ্রি স্টারখ্যাত রিসোর্টের ভেতরও একজন মানুষ অনিরাপদ হওয়াটা এবং আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা-কর্মীদের আক্রমণ জনমনে ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য হোটেলে দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে গেলেও হোটেলের নথিতে প্রথম স্ত্রীর নাম উল্লেখ করা দূর্ভাগ্যজনক। পরবর্তী সময়ে সরকার নানা মামলায় হেফাজতের নেতাদের গ্রেফতার করতে থাকেন। পরিশেষে চুরি, জখম, হুমকি ও ধর্মীয় কাজে বাধা দেয়ার মামলায় গ্রেফতার করেন মাওলানা মামুনুল হককে।

তেজগাঁও বিভাগের ডিসি হারুন সাহেবের ভাষ্য মতে, মামুনুল হক তিনটি বিয়ের কথা নাকি স্বীকার করেন। তবে পরের দুইটির কোন প্রকার কাবিন নামা করেননি বলেও বিবৃতি দিয়েছেন। একই সাথে ডিসি হারুন আরেকটি গুরুতর অভিযোগ করেন, সরকার উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টা নাকি করেছিলেন মামুনুল হক। এমন অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে বলব মামুনুল হক বাস করেন বোকার রাজ্যে আর এমন অপরাধে অবশ্যই রাষ্ট্রীয় আইনে তার বিচার করা দরকার। অভিযোগ মিথ্যে হলে, বিতর্কিত ডিসি হারুন সাহেবের বিরুদ্ধে অবশ্যই সরকার ও পুলিশ ডিপার্টমেন্ট যথাযথ ব্যবস্থা নিবেন। এরই মধ্যে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ঘোষণায় বলেন- মাওলানা মামুনুল হকের দ্বিতীয় বিয়ে ইসলামি শরিয়তের আলোকে হয়েছে। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই।

যা হোক, তৃতীয় বিয়ে নিয়ে আমরাও চুলছেড়া বিশ্লেষণ করে যাচ্ছি। ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক দ্বিতীয় বিয়ে শুদ্ধ হলেও রাষ্ট্রীয় আইনে কাবিন না করার কারণে দুই বছরের অধিককাল তার জেল ও অর্থদন্ড হতে পারে। একজন মামুনুল হক অপরাধে জড়াতে পারেন। কিন্তু মাওলানা মামুনুল হকের কাছে এই জাতি এমনটা নিঃসন্দেহে আশা করেনি। এমন পরিস্থিতির কারণে মামুনুল হকের ব্যক্তিগত জীবনে কিঞ্চিৎ ক্ষতি হলেও, এদেশের ইসলামি অঙ্গনে চরম ক্ষতি যে হয়েছে, তা অকপটে বলা যায়।

বিষয়টি হলো- একজন মেহমানকে সম্মান জানানো এ দেশের জনগণের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু তিনি যদি গুজরাটের মোদি হন, তাহলে বিরোধিতা হওয়াটা তো স্বাভাবিক। তিনি অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেন, অথচ আমাদের সীমান্তে মানুষ মারেন। কে না জানে তিনি যে গুজরাটের খুনি মোদি।তিনি তো দ্বৈত নীতির একজন মানুষ। তিনিই কিনা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে সম্প্রীতি শিখাতে চান। এ দেশ মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ. কে. ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কবি নজরুল আর ঘোষক জিয়ার বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশে মোদি না আসলে কি-বা ক্ষতি হতো।

জন মুখে শোনা যাচ্ছে যে, মামুনুল হকের গ্রেফতারের জন্য সরকার নাকি এবারের লকডাউন দিয়েছে। কথাটা সত্যি নয়। অবশ্য লকডাউনের কারণে তার গ্রেফতার পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়েছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ভারত, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও বাংলাদেশে চরমভাবে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। করোনা মহামারি বিশ্ব মানচিত্রে চরম ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। একে মোকাবিলা করতে সকলের ঐকান্তিক মানসিকতা ও সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। ভ্যাকসিন বের হয়েছে, মানুষের দেহে পুশও হয়েছে। তবে শতভাগ কার্যকর হয়নি। তাই এ থেকে নিজ, পরিবার ও জাতি তথা বিশ্বের মানবকুলকে বাঁচাতে হলে সচেতনতার বিকল্প অন্য কিছু হতে পারে না।

২০ এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপি ১৪,২৯,৪৬,৫৯১ জন আক্রান্তের বিপরীতে মৃত্যু হয়েছে ৩০,৪৭,০৯২ জনের। তার মধ্যে দেশে ৭,২৭,৭৮০ জন শনাক্তের মধ্যে মারা গেছেন ১০ হাজার ৫৮৮ জন (পুরুষ ৭৮২৭ জন, নারী ২৭৬১ জন)। এরই মধ্যে আমদানিকৃত ভ্যাকসিনের সংকট দেখা দিয়েছে। এ মুহূর্তে সরবরাহকারী দেশ যোগান দিতে ব্যর্থ। জাতির স্বার্থে সরকার প্রধানকে অনুরোধ করব, একাধিক দেশ থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করার তড়িৎগতিতে উদ্যোগ গ্রহণ করুন। সুযোগ থাকলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে কাজে লাগান।

গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, শত বছর বা তারও অধিক সময় পরপর মহামারি বিশ্বকে আঘাত করে। প্রথম দিকে করোনা ভাইরাসের প্রাথমিক লক্ষণ ছিল শ্বাসযন্ত্রে ব্যাঘাত এবং জ্বর ও শুকনো কাশি । পরে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যার মাধ্যমে ফুসফুসে আক্রমণ করে মানুষের জীবনে চরম পরিণতির জানান দিত। বর্তমানে এর গতি-প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটেছে। কোনো প্রকার লক্ষণ ছাড়াই মানুষকে শেষ পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এমন মহামারী থেকে মেধা, ধর্মীয় মূল্যবোধ আর সচেতনতাই জাতিকে সঠিক পথ দেখাতে পারে।আমরা কোনো কুসংস্কারে আবদ্ধ না হয়ে একে মোকাবিলা করব, ইনশাআল্লাহ।

মহামারি সম্পর্কে নবিজিও সতর্ক করে নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,

‘যদি তোমরা শুনতে পাও, কোনো জনপদে প্লেগ বা অনুরূপ মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, তা হলে তোমরা সেখানে যাবে না। আর যদি তোমরা যে জনপদে অবস্থান করছ তথায় এর প্রাদুর্ভাব ঘটে, তবে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না’ (বোখারি, আস-সহিহ ৫/২১৬৩; মুসলিম, আস-সহিহ ৪/১৭৩৮, ১৭৩৯)।

বিশ্ব নবি মোহাম্মাদ সা. ১৪শত বছর আগে সংক্রমণ প্রতিরোধে বিচ্ছিন্নকরণ (কোয়ারেন্টিন) ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছেন।

বর্তমান সময়ে অতি সতর্কতার কারণে মানব জীবন হাঁফিয়ে উঠেছে। বেঁচে থেকেও জীবনমৃত মনে হচ্ছে। তবে বাড়াবাড়ি হয় এমন কাজ করা যাবে না। বিশেষ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম মেনে চললেই একে প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেমন- আমরা প্রত্যেকে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার এবং তিন ফিট দূরত্ব বজায় রেখে স্বাভাবিক চলাচল করব। করমর্দন ও কোলাকুলি পরিহার করে মুখে সালাম দিব। নির্দিষ্ট কাজ যেমন- পয়ঃনিষ্কাশনের পর এবং খাবারের আগে ও পরে সাবান বা অ্যালকোহল দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিব। নির্দিষ্ট সময় অন্তর হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করব। প্রয়োজন ছাড়া মুখমন্ডলে হাত লাগাবো না। একান্ত দরকার হলে হাত ধুয়ে তারপর চোখ, মুখ ও নাক স্পর্শ করব। রোগটি মূলত হাঁচি-কাশি ও কফ-থুথু থেকে ছড়ায়। তাই এমন কাজে সতর্ক থাকব। মুখমন্ডলে টিস্যু একবার ব্যবহার করে ফেলে দিব। সুষম খাবার খাব। অসুস্থ হলে যথাসময়ে বিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিব। মানসিকভাবে অতিরিক্ত চাপ পরিহার করব।

করোনা মহামারীর বিপর্যয়কর পরিস্থিতিকে একদল সেবক জাত-বর্ণ বিবেচনা না করে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন- তারা ডাক্তার। অনেকে বলবেন, এ তো তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু এমনভাবে বলা যাবে না। তারা নিজ ও পরিবারকে ঝুঁকির মধ্যে রেখেই মানব সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের জানাই সালাম ও অভিনন্দন। এরা বর্তমান সময়ে দেশ ও জাতির শ্রেষ্ট সন্তান।

অথচ অনাকাঙ্খিতভাবে পথে-ঘাটে সময়-অসময়ে চোর, বদমায়েশ থেকে শুরু করে প্রশাসনের কতিপয় লোকেরা পর্যন্ত বিরক্ত এবং অসহযোগিতা করছে- ডাক্তারদের। গত ১৮ এপ্রিল রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে দিনের বেলায় পুলিশ চেকপোস্টে পরিচয়পত্র দেখা নিয়ে বিএসএমএমইউ-এর নারী চিকিৎসক হয়রানির শিকার হন। এ নিয়ে ডাক্তার-পুলিশ মুখোমুখি। ডা: জেনির ভাষ্য মতে, নিউ মার্কেট থানার ওসি কাইয়ুম তাকে ভুয়া ডাক্তার বলেই ক্ষান্ত হননি, একই সাথে যৌন ব্যবসায়ী পাপিয়ার সাথেও তুলনা করেছেন। ডাক্তারদের সংগঠন স্বাচিপ ডা: জেনিকে অযাচিতভাবে হেনস্তাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে। অপরদিকে ডা: জেনিকে দায়ী করে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে।

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি। এমন সময়ে দুর্নীতি আর অনিয়মের কলঙ্ক গ্রাস করেছে স্বাস্থ্য খাতকে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা বিভাগের তথ্য মতে, সর্বশেষ ঢাকায় করোনা চিকিৎসায় বিশেষায়িত হিসেবে বিবেচিত ৯টি হাসপাতালে ৯৫টি খাতের কেনাকাটায় ৩৭৫ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে। এসব ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের শাস্তি দেওয়া অতিব জরুরি।

আমরা বিশ্বাস রাখি, বিশ্বভ্রমান্ডের মালিক মহান আল্লাহ পৃথিবীকে প্রাণচঞ্চল করতে আমাদের সুন্দর চলাচলের আবারও ব্যবস্থা করবেন।

লেখক: গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন