Ads

আদিত্য কবির সেতু, সুলতানা রেবু এবং একটি যোদ্ধা পরিবার

শেলী জামান খান

আদিত্য কবির সেতু’র মৃত্যুর খবরটি শুনেই চট করে মনে পড়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শামসুন নাহার হল জীবনের কতশত স্মৃতি! আমাদের সময় শামসুন নাহার হলের হাউস টিউটর ছিলেন সুলতানা রেবু।মনে পড়ল রেবু আপা এবং তার তিনটি সন্তানের কথা।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই শামসুন নাহার হলের আবাসিক ছাত্রী ছিলাম। প্রথম দর্শনেই রেবু আপার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। লম্বা ছিপছিপে একহারা গড়নের সুন্দরী সুলতানা রেবু। মুখে সবসময় মুচকি হাসি। আমরা কয়েকজন বন্ধু অচিরেই তার ভক্ত হয়ে উঠলাম। রেবু আপার সাজগোজ, তার মত টিপ পরা, হাতে শাখা পরা, শাড়ি পরা, হাসি সবকিছুই নকল করতে শুরু করলাম।

সেই আশির দশকের কথা। মেয়েদের হলে তখনও চলছে সূর্যাস্ত আইন। সূর্য ডোবার সাথে সাথেই বীরেন দাদু বা হরলাল দাদু গেট বন্ধ করে দিতেন। হাউস টিউটর অফিসে শুরু হোত রোল কল বা নাম ডাকা। হাজিরা খাতা হাতে বসতেন রেবু আপা, ডলি আপা, সুলতানা আপা। কোন কোন দিন গেইট দিয়ে ঢুকতে একটু দেরী হয়ে যেতো। মুখে রক্ত তুলে দিতাম ভোঁদৌড়। হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকতাম হাউস টিউটরদের রুমে। রেবু আপা মুচকি হেসে বলতেন, ‘ওকে, দেখেছি চেহারা। এবার যাও।’ আমরা হাসতে হাসতে বের হয়ে আসতাম।

বাইরে, মূল ভবন সংলগ্ন সবুজ মাঠটিতে আমরা ব্যাডমিন্টন খেলতাম। সেখানে প্রায়ই এসে জড় হতো রেবু আপার বাচ্চারা। সেতু, খেয়া, অভীক।

সেই সময়টায় ওদের প্রায় প্রতিদিনই দেখতাম। ওরা আসতো রেবু আপার পিছু পিছু।আমরা ওদের সাথে খুব দুষ্টুমি করতাম। খেলতাম। গল্প করতাম। সে কতকাল আগের কথা!আমরা জানতাম, রেবু আপা’র হাসবেন্ড ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কবি হুমায়ুন কবির। তাদের প্রেম থেকে পরিনয় হয়েছিল। বিয়ের তিন বছরের মাথায় হুমায়ুন খুন হয়েছিলেন। পেছনে রেখে গেছেন দু’টি নাবালক সন্তান এবং গর্ভবতী স্ত্রীকে।

আমার একবার প্রচন্ড জ্বর হয়েছিল। ১০৫ ডিগ্রীর মত। আমার তখন দ্বিতীয় বর্ষ চলছে। থাকি ২০০৩ নম্বর রুমে। আমার রুমমেট ছিল হাসি আর মুক্তি। মুক্তি দৌড়ে রেবু আপার কোয়াটার থেকে একজগ ঠান্ডা পানি আর বরফ নিয়ে এলো। তা দিয়ে হাসি আর মুক্তি মিলে আমার মাথায় পানি দিতে শুরু করল। একজন শরীর মুছিয়ে দিল। পরে রেবু আপা এলেন দেখতে। আম্বুলেন্স কল করে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হল আমাকে। একরাতেই জ্বর হাওয়া হয়ে গেল।

রেবু আপা পরদিন হাসতে হাসতে বললেন, ‘ওটা ছিল ভালুকে জ্বর।’

তারপর কত যুগ চলে গেছে। আমি তরুনি থেকে মধ্যবয়সি হয়েছি। পরে জেনেছিলাম সেতু’র ‘কবি আদিত্য কবির’ হয়ে ওঠার কথা। শুনলাম, খেয়া’র লেখক অদিতি কবির হয়ে ওঠার গল্প। অভিকের ভালো নাম যে অনিন্দ্য কবির, তা আদিত্য কবিরের মৃত্যুর খবরটি পড়তে পড়তেই জানলাম।

আদিত্য কবির সেতু’র কথা ভাবতে গিয়ে কেবলই মনে পড়ল ছোট্টবেলার হ্যাংলা পাতলা, রোগা মত সেই কিশোর ছেলেটির কথা। সেই শুকনো পটকা ছেলেটি যে কালে কালে এমন গুণীজন হয়ে উঠেছিল, সে খবরও জানতে পারিনি। তার বয়স যে প্রায় পন্চাশ হয়েছিল, তাও কি বিশ্বাসযাগ্য?

সত্যি সময় যেন আসলেই পাখির ডানায় ভর করে উড়ে চলে যাচ্ছে!

শুধু মাঝে মাঝে যখনই দেশে যাই, একবার হলেও শামসুন নাহার হলে যাই। তখন খুব রেবু আপার কথা মনে পড়ে। তাঁকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সেই আগের মতই, কোকরান চুল, কনুই অবধি লম্বা হাতার ব্লাউজ, কপালে লাল টিপ, দুই হাতে শাঁখা-পলা পরা, ক্ষিনাঙ্গী রেবু আপাকে দ্রুত হেঁটে অফিসে ঢুকতে দেখা যাবে। মুখে তার সেই চিরপরিচিত মিষ্টি হাসিটি থাকবে অমলিন। কোন এক বিচিত্র কারনে, এই হাস্যমূখি মানুষটিকে বেশীরভাগ ছাত্রীরাই ভয় করতো। সমীহ করে দূরে সরে থাকতো।এমনি দৃঢ়-কোমল একটি ব্যক্তিত্ব ছিল তার মধ্যে। আবার সেই তাকেই দূর থেকে দেখার, অনুসরন করার একটি অদমনীয় আকর্ষণ কাজ করতো সবার মাঝে।

আহা, সেই রেবু আপা। রেবু আপার কথা মনে হলেই অবধারিতভাবে চোখের সামনে ভেসে ওঠে আরও কতশত স্মৃতি। মনে পড়ে আরও একজন স্বনামধন্য মানুষের নাম। তিনি হলেন রেবু আপার দ্বিতীয় এবং প্রাক্তন জীবনসঙ্গী অভিনয় শিল্পী পিযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়। কয়েক যুগ পর পীযুষদার সাথে আমার একাধিকবার দেখা হয়েছিল অভিজাত ঢাকা ক্লাবে। ২০১৯ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতি অনুষ্ঠানে আমাদের পরমাত্মীয় রুমি ও কাজল দম্পতির আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম ঢাকা ক্লাবে। সেখানে মন্চে দাঁড়িয়ে পড়ছিলাম আমার লেখা কবিতা, ‘সতের বছর পর’!

মন্চ থেকে নেমে আসতেই আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে দু’জন স্বনামধন্য মানুষ হাত উঁচু করে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। একজন আমাদের নিউ জার্সির অতি পরিচিত মুখ, বিজ্ঞানী নুরান নবী। হাসিমুখে জানতে চাইলেন, ‘আপনি নিউ ইয়র্কে থাকেন?’

অন্যজন, যিনি সাংস্কৃতিক জগতের অতি পরিচিত মুখ, সুদর্শন সেলিব্রেটি, আমাদের রেবু আপার প্রাক্তন। যাকে দেখলেই মনে পড়ে যায় শামসুন নাহার হল, হাউস টিউটর কোয়াটার, রেবু আপার কথা। হলরুমের বারান্দায় বসে এই মানুষটিকে এক নজর দেখার জন্য আমাদের ছিল তরুনিসুলভ নানা কৌতুহল, নানা কসরত! তাই আমার শামসুন নাহার হলের স্মৃতির উনিও একটি অংশ।

অবাক বিস্ময়ে তিনি জানতে চাইলেন, ‘আপনি নিউ ইয়র্কে থাকেন? সতেরো বছর পর দেশে এলেন?’

তারপর ঢাকা ক্লাবের শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে, ফটো সেশন করতে করতে, ঢাকা ক্লাবের সুস্বাদু ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে তাঁর সাথে টুকটাক আরও অনেক কথা হলো। কথা প্রসঙ্গে একফাঁকে আমি শামসুন নাহার হলের স্মৃতিচারণ করলাম তাঁর সাথে। জানালাম, আশির দশকে আমি শামসুন নাহার হলের আবাসিক ছাত্রী ছিলাম। তারপর আগ্রহভরে তাকিয়ে রইলাম তার মুখের দিকে। যদি সেখানে অতীতের কোন ছায়া পড়ে, সেই আশায়। কিন্তু খুব পরিশীলিত স্মিত হাসিমুখে তিনিও খানিকটা স্মৃতিচারণ করলেন।বললেন, ‘হুম, সেই আশির দশক। অবশ্যই স্মৃতিময়। কিন্ত আমাদের জীবনতো কোথাও থেমে থাকার না। জীবন চলে জীবনের নিয়মে। দিন বদলের সাথে জীবনও বদলে যায়।’

একসময় আমাদের কথা ফুরিয়ে গেলো। কুশলী অভিনেতার মতই আমরা কোন নাম উচ্চারণ না করে, কোন আভাষ বা ইঙ্গিত না দিয়ে বিদায় নিলাম!

আদিত্যর মৃত্যুর পর যখন এই প্রসঙ্গটি নিয়ে লিখলাম, তখনই পীযুষদার ছোট বোন শুক্লা গাঙ্গুলির কাছে শুনলাম, পিযুষ-রেবু দম্পতির ঘরে তাদের একটি কন্যা সন্তান হয়েছে। যার নাম অপর্ণা। ১৯৭৩ বা ৭৪ এর দিকে পিযুষ-রেবু জুটি বেঁধেছিলেন। শুনেছিলাম নানা ভুল বোঝাবুঝি এবং প্রচন্ড তিক্ততার মধ্য দিয়ে তাদের দাম্পত্যের অবসান ঘটেছিল। পীযুষদা নতুন করে জুটি বাঁধলেও রেবু আপা একাকিই রয়ে গেছেন।
এবার একটু পেছনে ফিরে যাই। তাহলেই জানা যাবে আদিত্য কবির সেতুর শেকড়ের সন্ধান। জানা যাবে সুলতানা রেবু, মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবির এবং তার যোদ্ধা পরিবারের সাতকাহন।

তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। সর্বহারা পার্টির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৭১ সালের জুন মাসে। বরিশালের আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানে। পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সিরাজ সিকদার। তিনি যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন। সিরাজ সিকদার যখন বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র, তখন তার সাথে পরিচয় হয় হুমায়ুন কবিরের। দুজনেই বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন। দুজনেই ছিলেন মার্কসবাদী। সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নতুন একটি দেশের স্বপ্ন দেখতেন তারা। হুমায়ুন কবির সিরাজ সিকদারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।

হুমায়ুন কবির, তার ছোটভাই ফিরোজ কবির, ছোট বোন আলমতাজ বেগম ছবি সবাই পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টিতে সক্রিয় সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। হাতের লেখা ভালো ছিল বলে দলের হয়ে পোস্টার লিখতেন কিশোরি ছবি। ছবি ছিলেন নবম শ্রেণির ছাত্রী। ফিরোজ কবিরের বন্ধু সেলিম শাহনেওয়াজও দলে যোগ দিয়েছিলেন । পড়তেন একই সঙ্গে। সেলিম শাহনেওয়াজ ও ছবি, একে অপরকে ভালোবাসতেন। এরা সবাই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেন। একাত্তরের ২৮ মে সেলিম শাহনেওয়াজ ও ছবির বিয়ে হয়। রণাঙ্গনের ক্যাম্পে। যুদ্ধ, গুলির শব্দ, বারুদের গন্ধের মধ্যেই বিয়ে হয়েছিল তাদের।

ছবি সিরাজ শিকদারের সঙ্গে অপারেশনে অংশ নিয়েছেন। স্বরূপকাঠির সন্ধ্যা নদীতে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে তাদের গেরিলা যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে সেলিম শাহনেওয়াজও ছিলেন। ছবির ছুঁড়ে দেয়া গ্রেনেডে গানবোটে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্য ও তাদের দোসররা মারা যায়। সিরাজ সিকদারের নির্দেশে ঝালকাঠির গাবখান চ্যানেলেও ছবি একটি সফল আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। হামলায় গানবোট ডুবে পাকিস্তানি সৈন্যরা মারা যায়। রাজাকারকে বেয়নেট চার্জ করার উদাহরণও আছে ছবির জীবনে।

যুদ্ধচলাকালীন সময়েই সিরাজ সিকদারের সঙ্গে মতের অমিল হয় ফিরোজ কবিরের। সেই কারনে দল থেকে বহিষ্কৃত হন ফিরোজ। এই বহিস্কারের বিরুদ্ধাচারণ করেছিলেন হুমায়ুন ও শাহনেওয়াজ। পরে পরিস্থিতির চাপে খুলনার তুতপাড়ায় সস্ত্রীক পালিয়ে গিয়েছিলেন সেলিম শাহনেওয়াজ। পার্টি কর্তৃক তার মৃত্যুদণ্ড জারির খবর তিনি জেনেছিলেন। আগস্ট মাসে ফিরোজ পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েছিলেন। ১৮ আগস্ট বরিশালে ব্যাপ্টিস্ট মিশন সংলগ্ন খালের পাড়ে দাঁড় করিয়ে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে পাকসেনারা হত্যা করেছিল।

কবি নির্মলেন্দু গুণের এক লেখায় অসহযোগ আন্দোলনে তার ও হুমায়ুন কবিরের সম্পৃক্ততার একটি চিত্র পাওয়া যায়। গুণ ও হুমায়ুন কবির পাবলিক লাইব্রেরির সামনের রাস্তা দিয়ে শাহবাগের দিকে ছুটে যাওয়া একটি ডাবল ডেকার বাসের গতিরোধ করেছিলেন। হুমায়ুন তখন গুণের কাছ থেকে একটা দিয়ালশাই চেয়ে নেন। তিনি আগুন লাগানোর কাজে ব্যাবহার করার জন্য তার প্রেয়সি সুলতানা রেবুর কাছ থেকে একটি রুমাল চেয়ে নিয়ে এসেছিলেন। হুমায়ুন কবির বলেছিলেন, ‘গুণ, আয় বাসে কী করে অগ্নিসংযোগ করতে হয়, তোকে শিখিয়ে দিচ্ছি। হুমায়ুনের কাছেই আমি বাসে অগ্নিসংযোগ করা শিখি।’

(আমার কণ্ঠস্বর, নির্মলেন্দু গুণ)

বীর মুক্তিযোদ্ধা এই দুই ভাই আর বোনটির জীবন এরপর নিদারুনভাবে বদলে গিয়েছিল। সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি এবং স্বয়ং সিরাজ সিকদার তাদের জীবনে বড় ধরনের আঘাত হয়ে আসে। কেবল মতের অমিলের কারনেই সর্বহারা পার্টিতে অসংখ্য খুনোখুনি হয়েছে। আর এর অশুভ শুচনা হয়েছিল এই পরিবারটি দিয়েই। ফিরোজ কবির শহীদ হয়েছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। কিন্তু পার্টির দলিলে তাকে বহিষ্কৃত হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছিল। সর্বহারা পার্টির ইস্তেহারে বলা হয়, ‘ফিরোজ কবির জীবিত অবস্থায় সর্বহারা পার্টির বিচারের আগেই পাকবাহিনীর হাতে নিহত হয়।’

যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে সিরাজ সিকদারের মতাদর্শের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন সেলিম শাহনেওয়াজ এবং হুমায়ুন কবির। ১৯৭২ সালের ৩ জুন সর্বহারা পার্টির প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল। সেদিন সেলিম শাহনেওয়াজকে হত্যার মধ্য দিয়ে দলটি উৎসব পালন করেছিল। তখন ছবি ছিলেন খুলনায়। শাহনেওয়াজ ঝালকাঠি থেকে ফিরছিলেন। শাহনেওয়াজ জানতেন তাঁর জীবনের সময় ফুরিয়ে আসছে। জানতেন, একবার দলে ঢুকলে আর জীবিত ফিরে যাওয়ার কোন উপায় নেই। শাহনেওয়াজকে হত্যা করা হয় লঞ্চঘাটে। লাশটি ভাসিয়ে দেওয়া হয় সুগন্ধা নদীতে।

‘আলমতাজ বেগম ছবি’ দেশের মানুষের মুক্তির জন্য মাত্র ১৬ বছর বয়সে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন সর্বহারা পার্টিতে। কিন্তু বাকি জীবন সেই তাঁকেই বেঁচে থাকার জন্য প্রচন্ড সংগ্রাম করতে হয়েছে। শাহনেওয়াজের মৃত্যুকালে ছবি ছিলেন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে জন্ম হয় তাদের মেয়ে সিমু। পুরো নাম সেলিম শাহনেওয়াজ সিমু।

সেলিম শাহনেওয়াজের মৃত্যুর খবর ছবি পেয়েছিলেন আরও তিন দিন পর। ৬ জুন যখন ছবি’র বড় ভাই হুমায়ুন কবিরকে হত্যা করা হয়। নিহত হবার দুদিন আগে হুমায়ুন ও রেবা দম্পতির বাসায় স্ত্রীসহ বেড়াতে গিয়েছিলেন শাহনেওয়াজ। সেই ছিল পরপর নিহত মানুষদ্বয়ের শেষ সাক্ষাৎ।

বহু পরে, হুমায়ুন কবির প্রসঙ্গে তাঁর স্ত্রী, সুলতানা রেবুর স্মৃতিচারণে জানা যায়, হুমায়ুন এবং রেবু দু’জনই বরিশাল শহরে বড় হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে কেউ কাউকে দেখেননি। হুমায়ুনের বড়বোন মমতা পড়তেন রেবুর সঙ্গে। গল্পের বই পড়ার নেশা থাকায় রেবু ও মমতা বই আদান-প্রদান করতেন। মমতা নিজে বই দিতে না পারলে ভাই হুমায়ুনের কাছ থেকে বই এনে দিতেন। ১৯৬৫ সালে রেবু এবং হুমায়ুন দুজনই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। একদিন লাইব্রেরির বারান্দায় প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে হুমায়ুনের সঙ্গে রেবুর নাটকীয় সাক্ষ্যাৎ হয়। রেবু’র হাতে ছিল লাইব্রেরি থেকে নেয়া অনেকগুলো বই। বাইরে প্রবল ঝড়বৃষ্টি। হুমায়ুনের ইচ্ছা ছিল বইসহ হল-গেট পর্যন্ত রেবু’কে পৌঁছে দেয়ার। কিন্তু রেবু বলেছিলাম, ‘যে ভার আমি বইতে পারি না, সেটা আমি নেই না।’ অধ্যাপক আহমদ শরীফের কাছে ঘটনাটি পরদিনই পৌঁছে গিয়েছিল। শরীফ স্যার উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, ‘চালিয়ে যাও, হবে।’

এই দুজনের সম্পর্ক নিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদও প্রবল উৎসাহী ছিলেন।

১৯৬৮-৬৯-এর দিকে কোন একটা কারণে তিনি একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে গিয়েছিলেন। হুমায়ুন কবির তখন করিডোরে তার কিছু সহপাঠীর সঙ্গে আবু সায়ীদকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাদের মধ্যে একজন বিশেষভাবে আবু সায়ীদের নজর কাড়লেন। তিনি মুগ্ধ হয়ে দেখলেন, ‘মাজা ফরসা রঙের ছিপছিপে দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটির লম্বা বেণী পিঠের উপর দুলছে, চাউনি সপ্রতিভ।’ বিকেলে হুমায়ুন বাসায় এলে বললেন, ‘বেশ সুন্দর তো মেয়েটি! কে? এত সুন্দর একটা মেয়ে তোমার সহপাঠিনী আর তুমি এখনো তার প্রেমে পড়োনি?’

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রশ্নে হুমায়ুন চাপা নিশ্বাস ফেলেছিলেন।মেয়েটার জন্য হুমায়ুন কবিরের ভেতরের কাতরতা আবু সায়ীদের চোখ এড়ায়নি। এর দিন কয়েক পরেই হুমায়ুন এসে ওদের প্রেমের সুখবরটা দিয়েছিলেন এভাবেই শুরু হয়েছিল রেবু এবং হুমায়ুনের মাতাল করা তুমুল প্রেম। তাদের কাব্যিক দিনরাত্রি। সুলতানা রেবু ছিলেন চোখে পড়ার মতোই এক মেয়ে। রেবু’কে নিয়ে লেখা প্রগতিশীল কবি হুমায়ুনের একটি বিখ্যাত প্রেমের কবিতা,

পার্শ্ববর্তিনী সহপাঠিনীকে

কি আর এমন ক্ষতি যদি আমি চোখে চোখ রাখি
পদাবলী প’ড়ে থাক সাতাশে জুলাই বহুদূর
এখন দুপুর দ্যাখো দোতালায় পড়ে আছে একা
চলো না সেখানে যাই। করিডোরে আজ খুব হাওয়া
বুড়ো বটে দু’টো দশে উড়ে এল ক’টা পাতিকাক।
স্নান কি করনি আজ? চুল তাই মৃদু এলোমেলো
খেয়েছ ত? ক্লাশ ছিল সকাল ন’টায়?
কিছুই লাগে না ভালো; পাজামা প্রচুর ধুলো ভরা
জামাটায় ভাঁজ নেই পাঁচদিন আজ
তুমি কি একটু এসে মৃদু হেসে তাকাবে সহজে
বলনি ত কাল রাতে চাঁদ ছিল দোতালার টবে
নিরিবিলি ক’টা ফুলে তুমি ছিলে একা।
সেদিন সকালে আমি, গায়ে ছিল ভাঁজভাঙা জামা
দাঁড়িয়ে ছিলাম পথে হাতে ছিল নতুন কবিতা
হেঁটে গেলে দ্রুত পায়ে তাকালে না তুমি
কাজ ছিল নাকি খুব? বুঝি তাই হবে।
ওদিক তাকাও দ্যাখো কলরব নেই করিডোরে
সেমিনার ফাঁকা হল হেডস্যার হেঁটে গেল অই।
না – না – যেও না তুমি চোখে আর তাকাব না আমি
বসে থাকি শুধু এই; এইটুকু দূরে বই নিয়ে
এ টেবিলে আমি আর ও টেবিলে তুমি নতমুখী।
(কুসুমিত ইস্পাত )

এই যুগলের বিয়ে হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। এরপর এলো ১৯৭১। শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ।এই সংগ্রামী তরুণ কবি’র উদ্যোগে একটি ‘আন্দোলন’ হিসেবে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। স্বাধীনতার পরপরই ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ এর নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’ গঠিত হয়। এ পর্যায়ে হুমায়ুন কবির ও কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’ এর আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ লেখক শিবিরের তৎকালীন তরুণ কর্মীদের মধ্যে ছিলেন, আহম্মদ ছফা, ফরহাদ মাজহার, রফিক কায়সার, মুনতাসীর মামুন, হেলাল হাফিজ, রফিক নওশাদ প্রমুখ।

তারপর এলো ১৯৭২ সালের ৬ জুনের একটি রাত। সময় প্রায় সাড়ে নয়টা। হুমায়ুন পরিবার তখন থাকতেন ছেলে সেতু ও মেয়ে খেয়াকে নিয়ে ইন্দিরা রোডের একটি ভাড়া বাড়িতে। হুমায়ুন কখনো খালি গায়ে থাকতেন না। গরম বা ঠান্ডায় গায়ে গেঞ্জি থাকতই। কিন্তু সেই রাতে প্রচন্ড গরম পড়েছিল বলেই হুমায়ুন খালি গায়ে ছিলেন। ক্লান্ত, অন্তস্বত্তা রেবু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাই হুমায়ুন খালি গায়ে বাইরে গেলেও তিনি জানতে পারেননি। প্রতিবেশীদের কেউ প্রথম দেখেন হুমায়ুন কবিরকে। বাসার সামনের খালি মাঠটায় উদোম গায়ে পড়ে ছিলেন তিনি। খবর শুনে বেবিট্যাক্সি ডেকে দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাঁচানো যায়নি। গুলিটা মাথার পেছনে বন্দুক ঠেকিয়ে করা হয়েছিল।

সর্বহারা পার্টির খুব পরিচিত একজন , হুমায়ুনেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু , তাকে বাইরে ডাকলে খালি গায়েই তিনি বের হয়েছিলেন তার সঙ্গে। সামনের মাঠেই অপেক্ষায় ছিলেন আরেকজন। এই দু’জনেরই কেউ পেছন থেকে গুলি করে হুমায়ুনকে। ফিরোজ কবিরকে বহিস্কার, সেলিম শাহনেওয়াজ ও হুমায়ুন কবির হত্যা ওতপ্রতভাবে জড়িত ছিল। এখনও সন্দেহভাজন, স্বনামধন্য, একজন কবি’র নাম উচ্চারিত হয় হুমায়ুনের মৃত্যুকে ঘিরে। যিনি এখনও জীবিত আছেন।

সিরাজ সিকদারের সাথে মতবিরোধের জেরে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে হুমায়ুন কবির পরিবার। ঐ সময়টায় বিপ্লবী দলগুলোর প্রতি তরুণদের একটি বড় অংশের বিশাল কৌতুহল ও আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থানের কারণেই সর্বহারা দলে যোগ দেওয়ার প্রবল আগ্রহ তৈরি হয় তরুন প্রজন্মের মধ্যে। আজকের বিখ্যাত অনেক খ্যাতনামা লোক, কবি, সাহিত্যিকই সেই সময়ে এই গুপ্তদলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতচেতা মনোভাবের কারনে অত্যন্ত অল্প সময়ে জীবন দিতে হলো প্রতিভাবান এই মানুষটিকে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বলেছেন, ‘হুমায়ুনের প্রথম কবিতার বইয়ের নাম ছিল ‘কুসুমিত ইস্পাত’। এই ফুল আর ফলা একই সঙ্গে ছিল ওর মধ্যে। প্রেমের কোমলতার পাশাপাশি বিপ্লবের রক্তস্নানেও ছিল ওর একইরকম উৎসাহ।’

তাঁর মৃত্যুর পর বন্ধু কবি ফরহাদ মজহার পুলিশি জেরার মুখে পড়েছিলেন। লেখক আহমদ ছফার লেখায় ফরহাদ মজহারের প্রতি সন্দেহের ইঙ্গিত ছিল। যদিও হ‌ুমায়ুন কবিরের পরিবার তাঁদের প্রতি কোন সন্দেহ প্রকাশ করেননি। হুমায়ুন কবিরের প্রতি উৎসর্গকৃত কণ্ঠস্বর পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় ফরহাদ মজহার তার কবিতায় লিখেছিলেন, ‘আমি তোকে ডেকে বলতে পারতুম অত দ্রুত নয় হুমায়ুন, আস্তে আস্তে যা’!

সেলিম শাহনেওয়াজের হত্যার সাথে জড়িত রিজভি এর কিছুদিন পরেই আরেক উপদলের হাতে বরিশাল শহরের তৎকালীন ডগলাস বোর্ডিং-এর সামনে নিহত হয়। তবে খুব কম সময়ের মধ্যেই সিরাজ সিকদারের জীবনেও বিপর্যয় নেমে এসেছিল। সিরাজ সিকদারের ধরা পড়া নিয়েও প্রচলিত আছে ব্যক্তিগত সম্পর্কের নানা গল্প।

‘কুসুমিত ইস্পাত’ এর কবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ূন কবীরের সন্তান আদিত্য কবির সেতু।যার বাবা, চাচা এবং ফুফু ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। সেই অকুতোভয়, শহীদ যোদ্ধা পরিবারের সন্তান ছিলেন আদিত্য। তাই অমিত সাহস এবং কবিতা ছিল তার রক্তে । পেয়েছিলেন জন্মগত প্রতিভা!

২০২০ সাল যেন একেকটা কূঠারাঘাত করে চলেছে আমাদের মর্মমূলে! আমরা কেবলই রক্তাক্ত, শোকাহত হচ্ছি। দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে আমাদের শিল্প সাহিত্যের অঙ্গন!আদিত্য চলে গেছেন! কিন্তু আমার মানস চোখে ভাসছে রেবু আপার শোকার্ত মুখ। তার সজল চোখ। আহা, রেবু আপার সেই ছেলেটা। সেই আদিত্য! মনটা খুব, খুব খারাপ হল শুনে।

আহা, রেবু আপা, এত বড় কষ্ট, এত কঠিন আঘাত আপনি কী করে সইবেন?

(তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতাঃ
উইকিপিডিয়া
এবং
কবি হুমায়ুন কবির: বিপ্লবের ভেতর-বাহির, শওকত মাসুম আরক, তৃতীয় সংখ্যা, ২০১৬, বরিশাল।)

লেখকঃ সাহিত্যিকক ও সাংবাদিক।

আরও পড়ুন