Ads

ভারতের বিস্মৃত স্বাধীনতা সংগ্রামী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ

।। খুশবন্ত সিং ।।

অনুবাদ: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের প্রাক্কালে লক্ষ লক্ষ মুসলিম তাদের বাড়িঘর, সম্পত্তি ত্যাগ করে পাকিস্তানে যেতে বাধ্য হচ্ছিল, হিন্দু-শিখ বনাম মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গায় যখন হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হচ্ছিল এবং বাধ্য করা হচ্ছিল অসংখ্য মানুষকে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করতে। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, যিনি ধর্মের ভিত্তিতে ভারতকে বিভক্ত করার পরিণতি সম্পর্কে পূর্বেই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন, তিনি জুমা মসজিদের সিঁড়ি থেকে দিল্লির বিপুল সংখ্যক হতাশাগ্রস্ত মুসলমানের উদ্দেশে বক্তৃতা করেন। তিনি জীবনভর তার বক্তৃতা ও লেখায় মুসলমানদের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে যেসব কথা বলেছেন, তাতে কর্ণপাত না করায় তিনি তাদের তিরস্কার করেন। তিনি বলেন, “আপনারা হয়তো স্মরণে নেই যে, এখন যা ঘটছে সে সম্পর্কে আমি যখন আপনাদের বলেছি, তখন আপনারা আমার জিহ্বা কেটে দিয়েছেন; আমি যখন কথাগুলো লেখার জন্যে কলাম তুলে নিয়েছি, তখন আপনারা আমার হাত কেটে ফেলেছেন; আমি যখন আপনাদের সঠিক পথে পরিচালনা করতে চেষ্টা করেছি, আপনারা তখন আমার পা ভেঙে দিয়েছেন; আমি যখন ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছি, আপনার তখন আমার পিঠ ভেঙে দিয়েছেন।”

মাওলানা আজাদ যখন ১৯১২ সালে কলকাতায় তার সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন, তখন তিনি তার মুসলিম ভাইদের কাছে ধারাবাহিকভাবে একই কথা বলেছেন। তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখে এবং এ সংগ্রামে হিন্দুদের সামনের কাতারে অংশগ্রহণ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার জন্যে তাদের তিরস্কার করেন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন তাকে “কংগ্রেসের শো-বয়” হিসেবে অভিহিত করেন এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় মুসলিম যখন মুসলিম লীগের পৃথক আবাসভূমির দাবির প্রতি সমর্থন জানায়, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তখনো ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থনে অটল ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী নিতান্ত অনিচ্ছায় এবং জওহরলাল নেহরু ও সরদার বল্লভভাই প্যাটেল যখন দেশভাগে সম্মতি দান করেন, তখনো কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে মাওলানা আজাদ একা দেশভাগের বিরোধিতা করেন।

বিরান পথে চলার শক্তি, তিনিই সঠিক এবং অন্যেরা ভুল এই বিশ্বাসে অবিচল থাকার সাহস তিনি কোথা থেকে পেয়েছেন? সন্দেহাতীতভাবে তা একটি উৎস থেকে এসেছে, তা হচ্ছে, কোরআন।

১৮৮৮ সালে আজাদ এক ভারতীয় পিতা ও এক আরব মায়ের ঘরে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রথম ভাষা ছিল কোরআনের ভাষা, আরবি। তার পিতার পূর্বপুরুষরা ইসলামী ধর্মতাত্ত্বিক ছিলেন এবং তিনিও একই ধারা অনুসরণ করবেন বলে আশা করা হয়েছিল। তার পরিবার এক পর্যায়ে কলকাতায় চলে আসে, যেখানে আজাদ উর্দু ও ফারসি ভাষা আয়ত্ত্ব করেন। তিনি সংক্ষিপ্ত একটি পর্যায়ে সকল ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে অজ্ঞেয়বাদের আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং দৃশ্যত নিজেকে জাগতিক ভোগবিলাসে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি আবার ইসলামের পথে ফিরে আসেন এবং তার সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক জীবনের সূচনায় তিনি উপলব্ধি করেন যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দুদের সঙ্গে ভারতীয় মুসলমানদেরর অংশগ্রহণ করা মুসলমানদেরও কর্তব্য।

তার বয়স যখন মাত্র বিশোর্ধ, তখন তিনি “আল-হিলাল” নামে একটি উর্দু সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের প্রকাশনা শুরু করেন। পত্রিকাটি দ্রুত পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠে এবং প্রচার সংখ্যা ২৯,০০০ এ উন্নীত হয়, যা ওই সময় একটি উর্দু পত্রিকার জন্যে কম ছিল না। যদিও তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিষয়ের ওপর লিখতেন, কিন্তু লেখাগুলোতে প্রতিফলিত তার জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সরকারকে অসন্তুষ্ট করে। ফলে আল-হিলালের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয়। মাওলানা আজাদ “আল-বালাগা” নামে আরেকটি সংবাদপত্রের প্রকাশনা শুরু করেন। ১৯১৬ সালের আল-বালাগা’র একটি সংখ্যায় তিনি ঘোষণা করেন যে, তিনি কোরআনের উর্দু তরজমা করতে শুরু করেছেন এবং এরই মধ্যে সুরা আল-ইমরান পর্যন্ত প্রথম তিনটি সুরা তরজমা করেছেন এবং তিনি ওই বছরের শেষ নাগাদ সমগ্র কোরআনের উর্দু তরজমা শেষ করবেন বলে আশা করছেন। কিন্তু তা হওয়ার ছিল না।

১৯১৬ সালের ৩ মার্চ ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্টেও আওতায় তাকে কলকাতা ত্যাগে বাধ্য করা হয়। অধিকাংশ প্রাদেশিক সরকার তাকে তাদের প্রদেশে প্রবেশাধিকার দিতে অস্বীকার করে। তার জন্যে যাওয়ার জন্যে খোলা ছিল শুধু বোম্বে প্রেসিডেন্সি অথা বিহার। তিনি বিহার বেছে নেন, কারণ এটি কলকাতার কাছে এবং রাঁচিতে বসবাস শুরু করেন। তিনি কোরআনের আরেকটি অধ্যায় সুরা আন-নিসা’র তরজমা সম্পন্ন করেন। সেখানে অবস্থানকালে তার বিরুদ্ধে আটকাদেশ জারি করে তার সকল কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়। তিনি বিহারের গভর্নর লর্ড সিনহা’র কাছে আপিল করেন (লর্ড সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিনহা, বিহার ও উড়িষ্যার প্রথম ভারতীয় গভর্নর, বাংলার প্রথম ভারতীয় এডভোকেট জেনারেল, ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের প্রথম ভারতীয় সদস্য এবং ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার প্রথম ভারতীয় সদস্য)। এক পক্ষকাল পর তাকে তার কাগজপত্র ফেরত দেওয়া হয়।

এ ঘটনা সিআইডি’র প্রধান স্যার চার্লস ক্লিভল্যান্ডকে ক্রদ্ধ করে। তিনি দিল্লি থেকে রাঁচিতে এসে পুনরায় মাওলানা আজাদের কাগজপত্রের মধ্যে উস্কানিমূলক কোনোকিছু আছে কিনা, তার পরীক্ষা করে দেখার জন্যে পুনরায় কাগজপত্র আটক করেনন। তাকে কাগজগুলো ফেরত দেওয়া হবে আশায় তিনি তার তরজমা ও ভাষ্য লেখার কাজ অব্যাহত রাখেন এবং ১৯১৮ সালে সমগ্র কোরআনের তরজমা শেষ করেন। আটকাবস্থা থেকে মুক্তি লাভ করে তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে তার কাগজপত্র ফেরত চান। দীর্ঘদিন পর তাকে তার কাগজপত্র ফিরিয়ে দেওয়া হলে তিনি সেগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রেখে গোছানোর কাজ শেষ করার আগেই ১৯২১ সালে সরকার কংগ্রেসকে বেআইনি ঘোষণা করে এবং নভেম্বর মাসে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। তৃতীয়বারের মতো তার সকল কাগজপত্র আটক করে ও একটি চটের বস্তায় ভরে নিয়ে যাওয়া হয়। পনেরো মাস পর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। তাকে তার কাগজপত্র ফেরত দেওয়া হয় ছিন্নভিন্ন, দলামোচড়া অবস্থায় এবং বহু পৃষ্ঠা পুরোপুরিই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মাওলানা আজাদের মনোবল ভেঙে যায় এবং ভাগ্য প্রতিকূল ভেবে তার উদ্যোগ পরিত্যাগ করেন।

পাঁচ বছর পর তিনি ১৯২৭ সালে তিনি আবারও তার কাজ শুরু করেন। ১৯৩০ সালের ২০ জুলাই তিনি কোরআনের তরজমা ও ভাষ্য লেখার কাজ শেষ করেন, যখন তিনি মিরাট কারাগারে আটক ছিলেন। এভাবে ‘তরজুমানুল কোরআন’ এর তিনটি খণ্ড সৃষ্টি থেকে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের চেতনার দৃঢ়তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, একটি গ্রন্থ তরজমা করার এই আবেগ তিনি কেন পোষণ করেছেন, যে গ্রন্থটি উর্দু, ইংরেজি এবং বিশ্বের অধিকাংশ ভাণায় বহুবার অনূদিত হয়েছে? মাওলানা আজাদ উপলব্ধি করেছিলেন যে, কোরআনের যে অনুবাদগুলো বিদ্যমান, সেগুলোতে কোরআনের বাণীর এমন শব্দগুলোর নিগূঢ় মর্ম উঠে আসেনি, যেগুলো সহজ ও স্পষ্ট ছিল, যাতে নিরক্ষর আরব উপজাতির লোকজন সহজে বুঝতে পারে। এটা ঘটে মহনবীর প্রজন্মের সকলে মৃত্যুবরণ করার পর ইসলাম অনারব জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার পর্যায়ে। তখন গ্রিক, ইরানি ও বৌদ্ধ ধর্মবিশ্বাসের অনেক ধারণা কোরআনের ব্যাখ্যার মধ্যে স্থান করে নিয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে সহজ আরবি শব্দের অর্থের স্থলে ভাষ্যকারদের ব্যক্তিগত ধ্যানধারণা অনুযায়ী বিভ্রান্তিকর অর্থবহ শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। এ সময়ে সুফিদের আবির্ভাব ঘটে, যারা কোরআনের বাণীর লুকায়িত বা অন্তর্নিহিত মর্ম অনুসন্ধান করেন, অথচ কোরআনের বাণীতে কোনোকিছু লুকায়িত ছিল না।

কোরআনের একটি আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কোরআন হচ্ছে, “একটি উজ্জ্বল আলো, যা মানুষের সামনে এবং তাদের ডানদিকে জ্বলজ্বল করবে (৬৬:৮)।” নবীর ওপর নাজিলকৃত অহিগুলোকে নতুন বিশ্বাসের ভিত্তি বলে দাবি করা হয়নি, বরং ইব্রাহিম, মূসা ও ঈসার মতো নবীদের দ্বারা ঘোষিত বিশ্বাসের অনুস্মারক বলা হয়েছে। কোরআনে আরো বলা হয়েছে যে, “এটা কোনো মনগড়া কাহিনি নয়, বরং পূর্ববর্তী বাণীগুলোতে নিশ্চিতকরণ, সকল বিষয়ের ব্যাখ্যা এবং যারা বিশ্বাসী, তাদের জন্য নির্দেশনা ও অনুগ্রহ (১২:১১১।”

মাওলানা আজদের উদ্দেশ ছিল, কোরআনের পদ্ধতিতে কোরআনকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা। কোরআনে যে শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, তিনি সেগুলোর তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার বাইরে যাননি বললেই চলে এবং তিনি তার যুক্তিগুলোকে ক্ষুরধার করার উদ্দেশে বর্ণিত হাদিস থেকেও উদ্ধৃতি দিয়েছেন খুব কম।

আজাদ যদিও তখন বয়সে তরুণ এবং তার ইউরোপীয় ভাষাজ্ঞান কম ছিল, কিন্তু হাতের কাছে ধর্ম বা দর্শনের যা কিছু পেয়েছেন তা নিবিড়ভাবে পাঠ করেছেন। অতএব অনিবার্যভাবেই তার ওপর মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকদের দারুণ প্রভাব পড়েছিল। তাদের মধ্যে তার ওপর সবচেয়ে অধিক প্রভাব ছিল দ্বাদশ শতাব্দীর ইসলামী ধর্মতাত্ত্বিক ইমাম গাজালির, যিনি আজাদের মতোই অবিশ্বাস ও সংশয়ের মধ্যে কাটিয়ে ধর্মের পথে ফিরে এসেছিলেন। গাজালি সুফিবাদের দিকে ফিরেন; কিন্তু মাওলানা আজাদ সুফি ঘরানার হওয়া সত্ত্বেও সুফিবাদ পরিহার করেন। তবুও তিনি সুফি দরবেশ সারমাদের প্রশংসা করেছেন, যাকে উলেমারা ধর্মদ্রোহী হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেন এবং মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আদেশে যার শিরোচ্ছেদ করা হয়। সারমাদের সবুজ রঙের সমাধি দিল্লির জুমা মসজিদের পূর্বপ্রান্তের সিঁড়ির ধাপগুলোর কাছেই, এর কাছেই মাওলানা আজাদকে দাফন করা হয়েছে। দরবেশ সারমাদ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “তিনি দাঁড়িয়েছিলেন প্রেমের মিনারের ওপর, যেখান থেকে কাবা ও মন্দিরের প্রাচীরের উচ্চতাকে একই উচ্চতা বিশিষ্ট মনে হতো।

এটা উল্লেখ করার মতো একটি বিষয় যে, মাওলানা আজাদের সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব কবি আল্লামা ইকবাল, যিনি তার সম্প্রদায়ের ভবিষ্যত নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন, এবং আজাদের মতোই ইসলামী সূত্রগুলো থেকে তার অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন, তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পথ অবলম্বন করেন। ১৯০৫ ও ১০১০ সালের মধ্যে তারা উভয়ে বিদেশ সফরে গমণ করেন। ইকবাল যান ইউরোপে এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার জীবনীশক্তি ও প্রাণোচ্ছলতা তাকে গভীরভাবে মুগ্ধ কওে এবং অবক্ষয় ইসলামী দুনিয়াকে যেভাবে গ্রাস করেছে, সে সম্পর্কে তিনি আরো সচেতন হয়ে উঠেন। এ সম্পর্কে তিনি তাঁর অভিব্যক্তি ঘটান তার বিখ্যাত কবিতা ‘শিকওয়া’য় (অভিযোগ)। কবিতাটি যদিও আল্লাহকে সম্বোধন করে লেখা, কিন্তু এর মধ্যে তিনি মূর্তি বিধ্বংসকারী বিজয়ীদের অতীত গৌরবের কাহিনি জ্বালাময়ী ভাষায় তুলে ধরেন।

মাওলানা আজাদ ভ্রমণ করেন ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্তি অর্জনের উদ্দেশে সংগ্রামরত মুসলিম দেশগুলো এবং উপলব্ধি করেন যে, ইসলামের পুনর্জাগরণের একমাত্র উপায় মুসলমানদের সেই চেতনায় উজ্জীবিত করা, যে চেতনাকে আল্লাহ তাঁর অহি হিসেবে নবীর ওপর নাজিল, অর্থ্যাৎ কোরআনের মাধ্যমে মহনবীর ওপর দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। ইকবাল অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ইসলামের ইতিহাস থেকে; মাওলানা আজাদ তার অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেছিলেন কোরআন ও মহানবীর জীবন থেকে। আল্লামা ইকবাল এই উপসংহারে পৌছেন যে, মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক এবং মুসলমানদের মুক্তি ও সমৃদ্ধিও সম্ভাবনা নিহিত তাদের নিজস্ব একটি রাষ্ট্রের মধ্যে। মাওলানা আজাদ দ্বি-জাতি তত্ত্বকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেন এবং তিনি পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণাকে কোরআনের শিক্ষার পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেন।

তিনি উর্দুতে তিন খণ্ডে কোরআনের যে তর্জমা করেছেন, তার প্রথমটি সুরা আল-ফাতিহা সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। সাত আয়াত সম্বলিত সুরায় সামান্য কয়েকটি করে শব্দ, মাওলানা আজাদ তরজমা করেছেন:

“পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে,

সকল প্রশংসা শুধু আল্লাহ’র, যিনি সৃষ্টি জগতের সবকিছুর প্রভু,

যিনি নিতান্ত করুণাময় ও ক্ষমাশীল,

যিনি বিচার দিবসের মালিক,

আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।

আমাদের সরল পথ প্রদর্শন করো,

সেই মানুষের পথ, যাদের তুমি পুরস্কৃত করেছ,

তাদের পথ নয়, যাদের ওপর তোমার শাস্তি আপতিত হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।”

সুরা ফাতিহাকে কোরআনের মূল নির্যাস, পর্যাপ্ত এবং চিন্তা রাজ্যের ভাণ্ডার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেহেতু এটি কোরআনের সর্বাধিক উচ্চারিত অংশ, মহানবীর ওপর নাজিলকৃত একটি অহির মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে যে: “আমরা আপনাকে সাতটি আয়াত দিয়েছি বার বার উচ্চারিত হওয়ার জন্যে এবং মহান কোরআন দিয়েছি (১৫:৮৭)।” মহানবী নিজেও স্বীকার করেছেন যে, “সুরা ফাতিহা কোরআনের সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ সুরা এবং এর সঙ্গে তুলনীয় অন্য কোনো সুরা নেই।”

নবী কখনোই নতুন একটি ধর্ম প্রচারের দাবি করেননি, বরং যারা প্রকৃতিপূজা, পূর্বপুরুষের পূজা, প্রাণী পূজা এবং মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয়েছিল, তাদেরকে সরল পথে ফিরিয়ে আনেন। ইশ্বরের সর্বাধিক ব্যবহৃত দুটি নাম ‘আল্লাহ’ ও ‘রব’ দুটিই প্রকৃতপক্ষে প্রাক ইসলামী যুগের নাম। আল্লাহ সত্যিই মহাবিশ্ব এবং এর স্রষ্টা হিসেবে বিস্ময়ের বিস্ময়: ‘হে আল্লাহ! শিখদের ‘ওয়াহ গুরু’ ঠিক একই রকম। ‘রব’ একটি সমন্বিত শব্দ, যার যার অর্থ প্রদানকারী বা আরবিতে ‘আল-রাজ্জাক,’ একই সাথে তিনি শিক্ষক, মনিব এবং প্রভু। কোরআন শুরু হয়েছে আল্লাহর প্রতি ‘হামদ’ (প্রশংসা) ও ‘বিসমিল্লাহ’ (আল্লাহর নামে) দিয়ে এবং তাঁর দুটি মহান গুণ হচ্ছে ‘দয়াশীল’ (আর-রহমান) এবং ‘ক্ষমাশীল’ (আর-রহিম) দিয়ে। এরপর ‘প্রদানকারী’ বা ‘রব’ হিসেবে তার গুণাবলীর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে, তিনি মহাবিশ্বের প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণকারী (রাব্বুল আলামিন)।

মাওলানা আজাদ জীবনের জন্যে অত্যাবশ্যকীয় জিনিসগুলোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন — মানুষ ও প্রাণীর খাদ্য সরবরাহের জন্যে বাতাস, পানি ও মাটি — যা আল্লাহ পর্যাপ্ত পরিমাণে দান করেছেন। কোরআনের বলা হয়েছে, “এবং আমি আকাশ থেকে পরিমাণ মতো পানি বর্ষণ করে থাকি, অতঃপর আমি তা মাটিতে সংরক্ষণ করি এবং আমি তা অপসারণও করে নিতেও সক্ষম। এরপর আমি তা দ্বারা তোমাদের জন্যে খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান সৃষ্টি করেছি, যার মধ্যে তোমাদের জন্যে থাকে প্রচুর ফল এবং তোমরা তা আহার করো (২৩: ১৮-১৯)।”

মাওলানা আবুল কালাম আজাদ সৃষ্টির উদ্দেশ সম্পর্কে হিন্দু ও ইসলামী বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেছেন। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে, ‘মহাবিশ্ব হচ্ছে, ইশ্বরের ‘লীলা’ (ক্রীড়া) এবং অবাস্তব। অন্যদিকে ইসলাম সৃষ্টির উদ্দেশ আল্লাহর নিজস্ব ইচ্ছা বা পরিকল্পনা।’ কোরআনে বলা হয়েছে: ‘আমরা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং এ দু’য়ের মধ্যবর্তী যা কিছু আছে তা ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি, আমরা এসব সৃষ্টি করেছি যথাযথ উদ্দেশে, কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা বোঝে না। নিশ্চয়ই ফয়সালার দিন তাদের সবার জন্য নির্ধারিত সময় (৪৪: ৩৮-৪০)।” আল্লাহর অস্তিত্বের পক্ষে মাওলানা আজাদ একটি সুস্পষ্ট যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। মানুষের পক্ষে তার প্রকৃতিগত কারণেই বিশ্বাস করা সম্ভব নয় যে, একজন কর্মী ছাড়া কোনো কর্ম সম্পাদিত হতে পারে, কোনো নিয়ন্ত্রক ছাড়া শৃঙ্খলা আসতে পারে, একজন পরিকল্পনাবিদ ছাড়া কোনো পরিকল্পনা তৈরি হতে পারে, কোনো নির্মাতা ছাড়া একটি অট্টালিকা হতে পাওে এবং কোনো নকশাবিদ ছাড়া একটি নকশা তৈরি হতে পারে।

আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ সম্পর্কে মাওলানা আজাদ বলেছেন, যারা আল্লাহর অস্তিত্বের কথা জানতে চায়, তারা তা অবশ্যই দেখতে পায় এবং এর স্বপক্ষে তিনি কোরআনের আয়াতের উদ্ধৃতি দেন: “মানুষ তার খাদ্যের প্রতি খেয়াল করুক, আমিই প্রথম বিস্ময়কর উপায়ে বিপুল পরিমাণে পানি বর্ষণ করেছি, অত:পর আমি ভূমিকে বিদীর্ণ করেছি, এবং এরপর তাতে উৎপন্ন করেছি শস্য, আঙ্গুর এবং ঔষধি গাছগাছড়া, এবং ফল ও গবাদিপশুর জন্য তৃণ, তোমাদের এবং তোমাদের গবাদিপশুর কল্যাণে (৮০: ২৪-৩২)।”

কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, আল্লাহ যদি আসলেই সর্বশক্তিমান, ন্যায়পরায়ণ ও ক্ষমাশীল হয়ে থাকেন, তাহলে ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত এবং বন্যার মতো দুর্যোগ কেন নিরীহ মানুষের জীবনের এত ক্ষতিসাধন করে? কোরআনে এর উত্তর দেওয়া হয়েছে যে, ভালো কিছুর দ্রুত অবসান ঘটলেও যা কিছু কল্যাণকর তা পৃথিবীতে টিকে থাকে।

কোরআনে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে যে, সত্য সবসময় মিথ্যার ওপর বিজয়ী হয়। আল্লাহ ‘আল-হক্ব — সত্যপরায়ণ। কোরআন বলেছে, “আমি সত্যকে মিথ্যার ওপর নিক্ষেপ করি এবং এরপর সত্য মিথ্যাকে পুরোপুরি বিচূর্ণ করে (২১:১৮)।” মিথ্যা ও পাপকর্মের পরিণতি হিসেবে শাস্তি সহসাই আপতিত হয় না; কারণ মানুষকে তওবার সময় মঞ্জুর করা হয়। কোরআনে বলা হয়েছে: “আমি তাদের সঙ্গে থাকি, যারা অপেক্ষা করে (১০:১০২)।” কিন্তু তওবা করার সময় পার হয়ে যায় না। তওবা খুলে দেয় ক্ষমার পথ; বিসর্জিত প্রতি বিন্দু অশ্রু পাপের দাগ মুছে দেয়। নবী স্বয়ং আশ্বাস দিয়েছেন, “যে ব্যক্তি নিষ্ঠার সঙ্গে তওবা করে, সে সেই ব্যক্তির মতো যে কখনো কোনো পাপ করেনি। আজাদ এই উপদেশ অনুসরণ করেছেন। তার মতে, “আমরা যখন আমাদের মতো সৃষ্টিকেই ক্ষমা করতে শিখিনি, তখন আল্লাহর কাছ থেকে আমাদের ক্ষমা আশা করার কী কোনো অধিকার আছে?”

একটি লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হচ্ছে, ইসলাম খ্রিস্টধর্মের মতো শত্রুদের ক্ষমা করে দেওয়ার জন্যে তাদের অনুসারীদের উদ্বুদ্ধ করে না (যা প্রকৃতি বিরুদ্ধ), ইসলাম শুধু ক্ষমা করতে বলে: ‘পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়।’ ইসলামে প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার দেওয়া হলেও ক্ষতির পরিমাণকে সীমিত করে দিয়েছে। প্রচলিত ধারণার বিপরীতে, কোরআন মুসলমানদের কখনো কাফির বা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক যুদ্ধ করার পরামর্শ দেয় না। যারা বিশ্বাসীদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন চালায় অথবা কোরআন ও নবী বিরুদ্ধাচরণ কওে কেবল তাদের বিরুদ্ধেই সহিংসতা অনুমোদিত। এর বাইরে কোনো ব্যক্তি যা তার জন্যে উপযুক্ত বলে মনে করেন, তা বিশ্বাস করার ক্ষেত্রেও তিনি স্বাধীন। কোরআনে বলা হয়েছে: “দ্বীন পালনের ব্যাপারে কোনো ধরনের জোর জবরদস্তি নেই। সঠিক পথ ভুল পথ থেকে স্পষ্টভাবে পৃথক হয়ে গেছে। অতএব, যে মিথ্যা প্রভুদের অস্বীকার করবে, এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ঈমান আনবে, সে অবশ্যই এমন এক মজবুত হাতল ধরবে, যা ভাঙার কোনো আশঙ্কা নেই। আল্লাহ সব শোনেন, সব জানেন (২:২৫৬)।

আল্লাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ হচ্ছে, তিনি ‘আদালত’ — ন্যায়বিচারক; তিনি বিচার দিবসের প্রভু। মাওলানা আজাদ জোর দিয়েছেন যে, ঐশ্বরিক ন্যায়বিচার সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়; বরং এটা পুরোপুরি নির্ভর করে কার্যকারণের নিয়মের ওপর — অর্থ্যাৎ কেউ যা বপন করবে, ফসলও তাই তুলবে।

অন্যান্য ধর্মতাত্ত্বিকদের থেকে মাওলানা আজাদের একটি বক্তব্যে মতপার্থক্য ছিল যে, ‘এক সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ধারণা কোনও বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া নয়, বরং যার সঙ্গে পৃথিবীর সূচনা হয়েছিল তার পুনরুজ্জীবন। কোরআন লেছে, ‘মানুষ প্রথমে কেবল একটি ধর্মের মধ্যে ছিল; এরপর তাদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হলো’।

মাওলানা আজাদ আরো বিশ্বাস করতেন যে, আল্লাহ সম্পর্কে ইসলামের ধারণা ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের চেয়ে উন্নত; কারণ ইহুদিরা ইশ্বরকে ‘পছন্দনীয় মানুষের’ ইশ্বর হিসেবে গণ্য করেছিল, অন্যদিকে খ্রিস্টানরা ইশ্বরকে মানবিক করেছিল যেভাবে তারা যিশুকে ‘ঈশ্বরের পুত্র’ হিসেবে গণ্য করেছে।

আল্লাহকে সংজ্ঞায়িত করতে অস্বীকার করার দিক থেকে কোরআন উপনিষদের কাছাকাছি। উপনিষদ ইশ্বরকে ‘নেতি, নেতি’ — এটা নয়, এটা নয়’ বলেছে, কিন্তু কোরআনে অধিকতর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা, জ্ঞানের আধার, ন্যায়বিচারক, ক্ষমাশীল এবং আরো অনেক গুণের অধিকারী হিসেবে গ্রহণ করেছে।

মহানবী সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন, যাতে কেউ তাঁকে আল্লাহর অবতার হিসেবে বিবেচনা না করার সুযোগ পায়। তিনি যখন ইন্তেকাল করেন, তাঁর শ্বশুর ও ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর জনমন্ডলীর উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন: তোমরা যারা মুহাম্মদের ইবাদত করতে তারা জেনে নাও, মুহাম্মদ মারা গেছেন, এবং যারা আল্লাহর ইবাদত করতে তারা জেনে নাও, আল্লাহ চিরন্তন, তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন। তাঁর কোনো মৃত্যু নেই।” আল্লাহ ইবাদতের একমাত্র অস্তিত্ব, এর ওপর বিশেষ জোর দিয়ে কোরআনে আল্লাহর একক সার্বভৌমত্বে অংশীদারীত্বকে পুরোপুরি হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।

বিশ্বের একটি প্রধান নিয়মই হচ্ছে যে, মানবজাতিকে অবশ্যই সরল পথে পরিচালিত করার জন্যে নির্দেশনা বা হিদায়াত লাভের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে, যা প্রধানত তাদের দ্বারাই পদদলিত হয়, যারা সঠিক পথে আছে বলে দাবি করে, যারা অন্যায় করে, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের অজ্ঞানতার কারণে অন্যায় করে এবং তারাই হিদায়াতে পথে আসে।

কোরআনে বিধৃত আল্লাহর ‘একত্ব’ এবং সমগ্র মানবজাতির ভ্রাতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থার কারণেই মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ধর্মীয় পার্থক্যের ভিত্তিতে পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, “আপনার জাতি, আপনার দেশ, জাতীয়তা এবং জীবন বা কর্মক্ষেত্র যেখানে বা যেমন হোক না কেন, আপনি যদি শুধু এক আল্লাহর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তাহলে অন্যান্য সকল থেকে আপনি মুক্ত হতে পারবেন। আল্লাহর একত্বের মাঝে আপনার হৃদয় মিলিত হবে; আপনি অনুভব করতে শুরু করবেন যে, সমগ্র পৃথিবী আপনার বাড়ি এবং সমগ্র মানবজাতি অভিন্ন সত্তা এবং আপনারা সকলে একটি পরিবার গঠন করেছেন – ‘আয়াল আল্লাহ’ — আল্লাহর পরিবার।”

 

(খুশবন্ত সিং এর “এক্সট্রাঅর্ডিনারি ইন্ডিয়ানস: অ্যা বুক অফ প্রোফাইলস” থেকে)

 

আরও পড়ুন